“অসাধারণ মেধা ও স্মৃতিশক্তি নিয়ে জন্মেছিল ছেলেটি । যা পড়ত তা তন্ময় হয়ে পড়ত । তার ফলে একবার পড়াতেই পড়ার বিষয় তার আয়ত্বে চলে যেত । প্রায় সময় দেখা যেত সে বইয়ের পড়া পাতাগুলাে ছিড়ে ফেলে দিচ্ছে । তাই দেখে মা তাকে বকাবকি করলে , সে অক্লেষে বলত , ওসব পাতা তাে পড়া হয়ে গেছে ! ওগুলাে তাে আর দ্বিতীয় বার পড়ার দরকার নেই ।
গণিতে ছেলেটির অসাধারণ দখল । এন্ট্রান্স পরীক্ষার টেস্টে মাস্টারমশাই উপেন্দ্রনাথ বক্সী তাকে একশ নম্বরের মধ্যে ১১০ নম্বর দিলেন । কী ব্যাপার ! একশর মধ্যে ১১০ নম্বর দেওয়া যায় নাকি ? অন্যান্য শিক্ষকদের কাছে মাস্টারমশাই উত্তর দিয়েছিলেন , প্রশ্নপত্রে ১১ টি অঙ্কের মধ্যে ১০ টি কষতে বলা হলেও এই ছেলেটি ১১ টি অঙ্কই সঠিকভাবে কষেছে । শুধু তাই নয় , জ্যামিতি বিভাগের যে অতিরিক্ত একস্ট্রা দেওয়া হয়েছিল , সেগুলিরও দু – তিন রকম বিকল্প পদ্ধতিতে সমাধান করেছে ।
পড়াশুনায় এমন যে চৌকস ছেলে , সে কিন্তু দুষ্টুমিতে পিছিয়ে ছিল না । সে প্রায়ই ক্লাশের বন্ধুদের পিছনে লাগত ।
মাস্টারমশাইদেরও নাজেহাল করত । একবার মাস্টারমশাই ক্লাশে বলবিদ্যার বিষয় বােঝাচ্ছেন ।
বল x সরণ = কার্য ।
কিশাের ছেলেটির মাথায় তখন দুষ্টুমি জেগে উঠল । সে তখন না বােঝার ভান করে জানতে চাইল , একটা বড়াে পাথরকে অনেকবার ঠেলে শরীর ঘামে ভিজে গেলেও সরানাে গেল না , এই অবস্থায় কার্য বলা হবে কিনা !
ছেলেটি একসময় প্রেসিডেন্সি কলেজে আই . এস . সি . ক্লাসের ছাত্র । তখন শিক্ষক ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় । তার রসায়ন ক্লাসে এই ছেলেটিকে অন্য ছাত্রদের থেকে আলাদা করে তার বক্তৃতা মঞ্চের রেলিং – এর ওপরে বসিয়ে রাখতেন । যাতে সেই ছেলেটি অন্যান্য ছেলেদের সঙ্গে দুষ্টুমির সুযােগ না পায় ।
ছেলেটি ১৯০৯ খ্রিঃ এন্ট্রান্স পরীক্ষায় হিন্দু স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পঞ্চম স্থান লাভ করেছিল । আর প্রেসিডেন্সিতে আই এসসি পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়েছিল প্রথম । আর , অনার্স নিয়ে বি এসসি – তে প্রথম । মিশ্র গণিতে এম এসসি – তে প্রথম ।
কে এই ছেলেটি ? দুষ্টুমিতে তার জুড়ি নেই । পড়াশুনায় অসাধারণ । যার মেধা ও স্মৃতিশক্তি বিস্ময়কর । এম এসসি পরীক্ষায় ( ১৯১৫ খ্রিঃ ) সেই ছেলেটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯২ নম্বর পেয়ে যে রেকর্ড স্থাপন করেছে , এখন পর্যন্ত সেই রেকর্ড কেউ ভাঙতে পারেনি ?
সেই ছেলেটির নাম সত্যেন্দ্রনাথ । সত্যেন্দ্রনাথ বসু । জন্ম ১ জানুয়ারি ১৮৯৪ খ্রিঃ কলকাতায় । তাদের আদি বাসস্থান ছিল নদীয়া জেলার সুবর্ণপুরে । পিতার নাম সুরেন্দ্রনাথ বসু । এই ছেলেটি পরবর্তীকালে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানশিক্ষা ও বিজ্ঞানের প্রচারের কাজে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজেকে নিযুক্ত রেখে ভারতবাসীর সামনে এক অতুলনীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন ।
১৯১৭ খ্রিঃ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন স্যার আশুতােষ মুখােপাধ্যায় । তার ঐকান্তিক চেষ্টায় কলকাতায় বিজ্ঞানকলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় । সেই কলেজে স্নাতকোত্তর স্তরে পদার্থ বিদ্যায় পঠন পাঠনের জন্য তিনি সত্যেন্দ্রনাথ বসু , মেঘনাদ সাহা ও শৈলেন ঘােষকে ডেকে অধ্যাপনার দায়িত্ব দেন । তিনজনই তাে কৃতবিদ্য তরুণ ! সতেন্দ্রনাথ বসুর সহপাঠী মেঘনাদ সাহা বি এসসি ও এম এসসি – তে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছিলেন । বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ভাবেই পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ চালু হল ।
সত্যেন্দ্রনাথ বিজ্ঞানকলেজে পদার্থবিদ্যা ও গণিতের ক্লাশ নিতেন । ছাত্ররা সবাই খুশি । তার পঠন পাঠনে সবাই মুগ্ধ । তাই সবাই এই অধ্যাপককে শ্রদ্ধা ও সমীহ করত । কলকাতায় বিজ্ঞানের দরকারী সব বইপত্র সেই সময় পাওয়া সহজ সাধ্য ছিল না । জার্মান ভাষার বইপত্র ও পত্রিকা থেকে নতুন ধ্যান – ধারণার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য তাই সত্যেন্দ্রনাথকে জার্মান ভাষা শিখে নিতে হয়েছিল ।
সত্যেন্দ্রনাথ বসু তার প্রথম গবেষণাপত্র প্রস্তুত করলেন ১৯১৮ খ্রিঃ । এই কাজে তাকে সহযােগিতা করেছিলেন মেঘনাদ সাহা । গ্যাসের আয়তন , চাপ ও উষ্মতার মধ্যে যে সম্পর্ক রয়েছে এবং গ্যাসীয় অণুগুলির আয়তন দ্বারা তা কি প্রকারে প্রভাবিত হয় — এই ছিল প্রবন্ধের বিষয় । প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল ফিলজফিক্যাল ম্যাগাজিন নামে এক সুপ্রসিদ্ধ বিজ্ঞানপত্রিকায় । পরবর্তীকালে এটি ‘ সাহা – বােস অবস্থা সমীকরণ নামে বিজ্ঞানী মহলে পরিচিত হয় ।
সত্যেন্দ্রনাথ মেঘনাদ সাহার সঙ্গে যৌথভাবে এই সময় আর একটি কাজ করেন । অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব বিষয়ে আইনস্টাইন ও হার্মান মিনকায়ােস্কির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবরে অনুবাদ । মূল লেখাটি ছিল জার্মান ভাষায় । সেটি অনূদিত হয় ইংরাজিতে । ১৯২০ খ্রিঃ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল সেই প্রবন্ধগুলি ।
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের এক জটিল গবেষণার মধ্যে একদিন সত্যেন্দ্রনাথ আবিষ্কার করে ফেললেন তত্ত্বের একটি ভ্রান্তি । লিখে ফেললেন — ‘ প্ল্যাঙ্কের সূত্র ও আলােক কোয়া প্রকল্প ’ নামে একটি চার পাতার প্রবন্ধ । এদিক ওদিক সেটি প্রকাশ করতে বিফল হয়ে অবশেষে পাঠিয়ে দিলেন আইনস্টাইনের কাছে । শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আইনস্টাইন । আইনস্টাইনও তা ইংরাজি থেকে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে পাঠিয়ে দিলেন এক বিখ্যাত বিজ্ঞান জার্নালে । রাতারাতি তার এই মহা আবিষ্কারের সূত্রে সত্যেন্দ্রনাথ বসু বিশ্ববিজ্ঞানী মহলে সমাদর লাভ করলেন । একসময় ১৯২৫ খ্রিঃ সত্যেন্দ্রনাথ জার্মানিতে গেলে , আইনস্টাইন , প্ল্যাঙ্ক প্রমুখ বিজ্ঞানীরা তাকে সমাদরে বরণ করে নেন এবং তার চার পাতার প্রবন্ধটির জন্য বারবার উল্লেখ করেন ।
সত্যেন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যােগ দিয়েছিলেন । সেখান থেকে কাজ ছেড়ে ১৯৪৫ খ্রিঃ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের খয়রা অধ্যাপক পদে যােগ দেন ।
অলৌকিক প্রতিভার অধিকারী সত্যেন্দ্রনাথ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন বহু পূর্বেই । বােস সংখ্যায়ন আবিষ্কারের ৩৪ বছর পরে লন্ডনের রয়াল সােসাইটির সদস্যপদ ১৯৫৮ খ্রিঃ লাভ করেন । স্বদেশে তিনি যথাযােগ্য মর্যাদা পেয়েছেন । ১৯৫২ খ্রিঃ ছ’বছরের জন্য রাজসভার সদস্য হন । ১৯৫৬ খ্রিঃ দু’বছর ছিলেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য । হন জাতীয় অধ্যাপক ( ১৯৫৮ খ্রিঃ ) । লাভ করেছেন নানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডক্টরেট উপাধি । পেয়েছেন বিশ্বভারতী থেকে দেশিকোত্তম সম্মান এবং ভারত সরকারের ‘ পদ্মবিভূষণ ‘ ।
বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সত্যেন্দ্রনাথ ভারতকে জগৎসভার উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন । আর , এই দেশের মানুষের প্রতি ভালবাসায় তিনি মাতৃভাষা বাংলায় বিজ্ঞানের প্রচার ও প্রসারের কাজে নিজেকে নিয়ােজিত করেছিলেন । তার প্রচেষ্টায় ১৯৪৮ খ্রিঃ ‘ বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ গঠিত হয়েছিল । প্রকাশের ব্যবস্থা করেছিলেন এই পরিষদের মাসিক মুখপত্র ‘ জ্ঞান ও বিজ্ঞান ‘ ।
এই মহাবিজ্ঞানীর মহাপ্রয়াণ ঘটে ১৯৭৪ খ্রি ৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় ।
❤ ‘ এটা ঠিক যে , দেশ বলতে যদি দেশের লােককে বােঝায় , শুধুমাত্র শিক্ষিত বা নায়ক সম্প্রদায় না হয় , যদি মনে হয় , দেশের সাধারণ লােকই দেশ , তবে এরা শিক্ষিত হলেই তাে সে দেশকে উন্নত বলা যাবে ।’
— সত্যেন্দ্রনাথ বসু
❤ ‘ শান্তশিষ্ট সুবােধ বালকের সুনাম কলেজে আমার ছিল না । তাই কোনােদিন কোনাে কারণে , যা আমার এখন মনে নেই , ডাঃ রায়ের ( আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ) মনে হয়েছিল , ক্লাসের বক্তৃতা নিজে যথেষ্ট মনােযােগ দিয়ে শুনছি না এবং নিকটের বন্ধুদেরও চিত্তবিক্ষেপ ঘটিয়েছি ।’
— সত্যেন্দ্রনাথ বসু”