প্রশ্ন : মূল্যবোধ শিক্ষায় বিদ্যালয় ও শিক্ষকের ভূমিকা লিখুন ।
উত্তর : ব্যক্তিজীবনে মূল্যবোধের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ইতিমধ্যেই আলোচনা করা হয়েছে । জন্ম থেকেই শিশু মূল্যবোধ নিয়ে আসে না । বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক এবং সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে শারীরিক , মানসিক , বৌদ্ধিক এবং প্রাক্ষোভিক বিকাশের মতো মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে । পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষেত্রে বিকাশের মতো সুচিন্তিত উপায়ে প্রস্তুত বিভিন্ন পাঠ্যক্রমিক এবং সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলির মাধ্যমে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা – শিখন প্রক্রিয়া এবং স্বতঃস্ফূর্ত শৃঙ্খলার সাহায্যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যুগোপযোগী মূল্যবোধগুলি বিকাশে শিক্ষকের বিশেষ ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।
নাগরিক হিসেবে প্রতিটি ব্যক্তির জানা উচিত কীভাবে বিভিন্ন উৎপাদিত বস্তু বণ্টিত হয় । বিষয়টি মাধ্যমিক স্তরের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত না হলেও শিক্ষক অন্যান্য বিষয়ে আলোচনাকালে প্রাসঙ্গিকভাবে তুলে ধরবেন । যেমন—
প্রথমত , শিক্ষার্থী যাতে সমাজের আর্থিক কাঠামোটি বুঝে উঠতে পারে , সে বিষয়ে তাদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান সরবরাহ করতে হবে ।
দ্বিতীয়ত , সমাজের আর্থিক কাঠামোটি বজায় রাখার এবং তার উন্নতিসাধনে ব্যক্তির ভূমিকা কী হওয়া উচিত , সে বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে হবে । এ দুটি কাজ পৃথকভাবে করা সঠিক হবে না । বিদ্যালয়ের প্রাসঙ্গিক পাঠ্যসূচির মাধ্যমে একই সঙ্গে তথ্য সরবরাহ করতে হবে । পাশাপাশি এই জ্ঞান ব্যক্তিজীবনে তাৎপর্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে হবে । তবেই অর্থনৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত হবে । শিক্ষার্থীর অর্থনৈতিক মূল্যবোধ জীবন পরিস্থিতিতে তাকে স্বাধীনভাবে তার অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সাহায্য করে । এ ব্যতীত অর্থনৈতিক মূল্যবোধ তাকে আত্মপ্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে এবং তার অন্তর্নিহিত বিভিন্ন চাহিদার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানে সহায়তা করে ।
শিক্ষক ও শারীরিক মূল্যবোধ : অর্থনৈতিক মূল্যবোধের ন্যায় শারীরিক এবং বিনোদনমূলক মূল্যবোধ শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গঠন করা একান্ত প্রয়োজন । আর এই ক্ষেত্রে শিক্ষকের বিশেষ ভূমিকা দেখা যায় ।
শিক্ষক ও শারীরিক মূল্যবোধ : অর্থনৈতিক মূল্যবোধের ন্যায় শারীরিক এবং বিনোদনমূলক মূল্যবোধ শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গঠন করা একান্ত প্রয়োজন । আর এই ক্ষেত্রে শিক্ষকের বিশেষ ভূমিকা দেখা যায় ।
প্রথমত , দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গঠন ও কার্যাবলি সম্পর্কে স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের মাধ্যমে জ্ঞান পরিবেশন করতে হবে ।
দ্বিতীয়ত , শারীরিক ও বিনোদনমূলক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হলে , শিক্ষার্থীদের পূর্বের জ্ঞানের তাৎপর্য বুঝতে হবে । কারণ কোনো জ্ঞান যখন ব্যক্তিগত অনুভূতির দ্বারা সম্পৃক্ত হয় তখনই মূল্যবোধ জাগ্রত হয় ।
তৃতীয়ত , যেহেতু শারীরিক এবং বিনোদনমূলক মূল্যবোধ ব্যক্তির দৈনন্দিন আচরণের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংযুক্ত , সেজনা এগুলি অনুশীলনের মাধ্যমে অভ্যাসে পরিণত করা প্রয়োজন । কর্মশিক্ষা এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিনোদনমূলক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে হবে ।
শিক্ষক ও সামাজিক মূল্যবোধ : জন্মের পর পরিবারের সদস্যরাই শিশুর মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার দায়িত্ব গ্রহণ করে । পরিবারের বয়স্করা কতকগুলি স্থায়ী মূল্যমানের ভিত্তিতে শিশুর আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে সচেষ্ট হয় । এই প্রক্রিয়ায় শিশুর মধ্যে কতকগুলি সামাজিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠে । আধুনিক চিন্তাবিদ্গণ নির্দিষ্ট সর্বজনীন কতকগুলি সামাজিক মূল্যবোধের কথা উল্লেখ করেছেন । এই ধরনের সর্বজনীন মূল্যবোধ জাগ্রত করার জন্য পরিকল্পিত শিক্ষার প্রয়োজন । শিক্ষকগণ বিভিন্ন পাঠক্রম এবং সহপাঠক্রম সূচির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধ তুলতে সচেষ্ট হবেন ।
সৌন্দর্যের মূল্যবোধ এবং শিক্ষক : মনোবিদগণের মতে সৌন্দর্যের মূলে আছে এক ধরনের মানসিক সংগঠন যাকে বলে কাস্তরস ( Aesthetic sentiment ) । সাধারণভাবে একেই সৌন্দর্যের মূল্যবোধ বলে । এই মূল্যবোধের দুটি আচরণগত দিক আছে — ব্যক্তিকে বস্তুজগতের সৌন্দর্য উপলব্ধিতে সহায়তা করা এর সুন্দরের সৃষ্টি । শিক্ষার দ্বারা এই মূল্যবোধের বিকাশ করতে গেলে দুটি দিকের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করতে হবে ।
বিদ্যালয়ের পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত সাহিত্য , গণিত , সংগীত , নৃত্য , অঙ্কন ইত্যাদি বিষয়ের মধ্য দিয়ে শিশুদের সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট করা হয় । একই সঙ্গে শিক্ষক বিষয়বস্তু উপস্থাপনে তার মধ্যে নিহিত সৌন্দর্যবোধকে ভাষা , শব্দক্ষেপণ , গতি এবং অঙ্গভঙ্গি করে মনোরম পরিবেশ গড়ে তুলবেন । এর ফলে শিক্ষার্থীগণও তাদের চিন্তাভাবনায় সুন্দরের সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে ।
বৌদ্ধিক মূল্যবোধ এবং শিক্ষক : শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৌদ্ধিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা হয় ।
এক্ষেত্রে শিক্ষকের করণীয়গুলি হল—
( ক ) বৌদ্ধিক মূল্যবোধ বিকাশের জন্য শিক্ষকের প্রথম কাজ হবে উপযুক্ত পাঠক্রম নির্ধারণ করা ।
( খ ) শিক্ষার্থীদের মধ্যে চিন্তন প্রক্রিয়ার উন্নয়ন ঘটাতে হবে ।
( গ ) শিক্ষণের সময় তথ্য মুখস্থ করার পরিবর্তে ধারণা গঠনের উপর গুরুত্ব দিতে হবে ।
( ঘ ) বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও ধারণার মধ্যে শিক্ষার্থীরা যাতে সমন্বয় ঘটাতে পারে সে দিকে লক্ষ রাখা ।
( ঙ ) পাঠ্যবই পড়ার পাশাপাশি অন্যান্য বই অধ্যয়ন করে জ্ঞানার্জনের স্পৃহা বৃদ্ধি করা ।
নৈতিক মূল্যবোধ এবং শিক্ষক : সাধারণভাবে যে মূল্যবোধ আমাদের নৈতিক আচরণকে ( ব্যক্তি এবং সামাজিক মানদণ্ড দ্বারা স্থিরীকৃত ) নিয়ন্ত্রণ করে তাকে নৈতিক মূল্যবোধ বলে ।
এই নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশে শিক্ষকের কর্তব্য হল—
( ক ) বিদ্যালয়ে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত ইতিহাস , ভূগোল , শিল্পকলা ইত্যাদি বিষয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশে সচেষ্ট হতে হবে ।
( খ ) বিভিন্ন শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষা কমিশন নৈতিক শিক্ষাদানের জন্য কর্মসূচির কথা উল্লেখ করছেন । শিক্ষক সেইগুলি যথাযথভাবে পালন করবেন ।
( গ ) নৈতিক মূল্যবোধ গঠনে কেবলমাত্র নৈতিকতা সম্পৰ্কীয় জ্ঞান অর্জন যথেষ্ট নয় , উক্ত জ্ঞান যাতে শিক্ষার্থীদের আচরণ নিয়ন্ত্রণে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে সে দিকে লক্ষ রাখতে হবে । শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ সম্পর্কিত কিছু অভ্যাস গঠনে সচেষ্ট হবেন । এই অভ্যাস গঠিত হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই নীতিভিত্তিক আচরণ সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনা লক্ষ করা যায় ।
( ঘ ) মূল্যবোধের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল আচরণ সম্পাদনে সামঞ্জস্যতা আনার চেষ্টা করা । তাই শিক্ষক শিক্ষার্থীদের আচরণের মধ্যে সামঞ্জস্যতা আনার চেষ্টা করবেন ।