” ছেলেটির জন্মগ্রহণ করেছিল তখনকার পূর্ববঙ্গের রংপুরে । তাদের আদি নিবাস ছিল বগুড়ার বিহারগ্রামে । স্কুলে পড়ার সময়ে তার রংপুরের বাড়িতে কুস্তির আখড়া তৈরি করেছিল । শরীর গঠন করার উদ্দেশ্যে সে সমবয়সীদের নিয়ে কুস্তি ও নানাবিধ কসরৎ চর্চা করতে লাগল ।
সে সময়টা ছিল পরাধীন ভারতবর্ষের জাগরণের যুগ । সর্বত্রই স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ক্রমে ক্রমে জোরালাে হয়ে উঠছে । কি শহরে কি গ্রামে সর্বত্রই ইংরাজ বিতাড়নের একটা উন্মাদনা । বাংলায় প্রথম গুপ্ত সমিতি ব্যারিস্টার পি . মিত্রের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ( ১৯০২ খ্রিঃ ) অনুশীলন সমিতি নামে । এমন গুপ্ত সমিতিগুলিতে কুস্তি , লাঠিখেলা , কসরৎ , অসিখেলা , পিস্তল ছোড়া প্রভৃতি গােপনে শেখানাে হতাে ।
এই কিশাের ছেলেটির স্কুলের পাঠ শেষ হবার আগেই বান্ধব সমিতিতে ১৯০৩ খ্রিঃ যােগদান করে দেশের সেবায় কাজের যুক্ত হয়ে পড়ে এবং ক্রমে সে বিপ্লবী দলের একজন সক্রিয় কর্মী হয়ে ওঠে । রংপুরে তখন জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ।ছেলেটি সেই বিদ্যালয়ের ছাত্রদের লাঠিখেলা ও মুষ্টিযুদ্ধ প্রভৃতি শিক্ষার দায়িত্ব নিয়ে ছাত্রদেরকে গড়ে তুলতে থাকে । তার এমন উদ্যম ও সাহসিকতা দেখে বিপ্লবী বারীন ঘােষ ( ১৯০৬ খ্রিঃ ) তাকে কলকাতার যুগান্তর দলের কার্যালয়ে নিয়ে আসেন । সেই সময় পূর্ববঙ্গের ছােটলাট ছিলেন রামফিল্ড ফুলার । সে ছিল খুবই অত্যাচারী । তাকে হত্যা করার জন্য এই উদ্যমী ছেলেটিকে নিয়ােগ করা হল । কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেই চেষ্টা ফলবতী না হওয়ায় ছােটলাট ফুলার রক্ষা পেলেন ।
কে সেই ছেলেটি ? ছেলেটির নাম প্রফুল্ল চাকী । তার জন্ম ১৮৮৮ খ্রিঃ পূর্ববঙ্গের রংপুরে । তার পিতার নাম রাজনারায়ণ চাকী ।
১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের কথা । প্রফুল্ল তখন মানিকতলার বােমার আড্ডায় বাস করছেন । সেই সময় সিদ্ধান্ত হল কলকাতার প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে হবে । ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড খুবই অত্যাচারী ছিলেন । স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অন্যায়ভাবে শাস্তি দিতেন । সেই সময় সুশীল সেন নামে এক বিপ্লবী বালককে বেত্রদণ্ডে শাস্তি দেওয়ায় বিপ্লবীরা ঠিক করেছিলেন — এই কিংসফোর্ডকে হত্যা না করলেই নয় । এই ভার পড়ল ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকীর ওপর ।
ইংরেজ সরকার সেই সময় সিদ্ধান্ত নিল কিংসফোর্ডকে নিরাপদ রাখার জন্য কলকাতা থেকে বদলি করে মজঃফরপুরে পাঠাতে হবে । ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল প্রস্তুতি নিয়ে মজঃফরপুরে চলে এলেন এবং কিংসফোর্ডের আবাসের কাছাকাছি এক ধর্মশালায় উঠে তার গতিবিধি লক্ষ করতে থাকলেন । কিংসফোর্ড যত্রতত্র যান না , কেবল ইউরােপীয় ক্লাবে তাস খেলতে আসেন , এসব অবগত হয়ে তারা দুজন ক্লাবের কাছে আত্মগােপন করে রইলেন একদিন সুযােগের অপেক্ষায় ।
সেদিন ছিল ১৯০৮ খ্রিঃ ৩০ শে এপ্রিল বৃহস্পতিবার । রাত সাড়ে আটটা । তারা দেখলেন কিংসফোর্ডের ফিটন গাড়িটি তার আবাসগৃহের গেট দিয়ে বের হয়ে আসছে । আর কালবিলম্ব নয় , বােমা নিক্ষেপ করলেন । বােমা বিস্ফোরণের শব্দে শহর কেঁপে উঠল । একরাশ কুণ্ডলীকৃত ধোয়ার ভেতর ভাঙাচোরা ফিটন উল্টে পড়ল । ভাগ্যক্রমে কিংসফোর্ড মারা পড়লেন না । সেই গাড়িতে তিনি ছিলেন না । ছিলেন মিসেস ও মিস কেনেডি । ভুলক্রমে তাঁরাই নিহত হলেন ।
বােমা নিক্ষেপ করেই প্রফুল্ল ও ক্ষুদিরাম দুজনে ছুটতে লাগলেন রেল লাইন ধরে । বিপ্লবী দলের মন্ত্রগুপ্তি অনুসারে কাউকে কারাের নাম জানানাে হত না । ক্ষুদিরাম জানতেন তার সঙ্গীর নাম দীনেশ রায় । আর প্রফুল্ল জানতেন তার সঙ্গীর নাম হরেন সরকার । রেল লাইন ধরে ছুটতে ছুটতে ক্ষুদিরাম চলে গিয়েছেন ওয়াইনী স্টেশনের দিকে আর প্রফুল্ল চল্লিশ মাইল দূরের সমস্তিপুরের দিকে ।
পরের দিন সকালে ওয়াইনী স্টেশনে হাজির হতে ক্ষুদিরাম ধরা পড়লেন দুই কনস্টেবলের হাতে । আর ওদিকে প্রফুল্ল নিরাপদে সমস্তিপুর রেল কোয়ার্টারের পাশ দিয়ে স্টেশনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন । এক অচেনা দেশপ্রেমিক যুবক দেশের মুক্তিকামী প্রফুল্লকে স্টেশনের দিকে এমন বিধ্বস্ত পােশাকে রাতজাগা ক্লান্ত চেহারা ও নগ্নপদে যেতে নিষেধ করে , নতুন কাপড় ও জুতাে কিনে দিয়ে ভােল পাল্টাতে পরামর্শ দিলেন , যাতে পুলিশের সন্দেহের হাতে না পড়েন । তিনি প্রফুল্লকে সারাদিন নিজের বাড়িতে রেখে সতর্কভাবে সন্ধ্যার পরে শুভকামনা করে স্টেশনে পৌঁছে দিলেন ।
প্রফুল্ল কলকাতার ট্রেনের অপেক্ষারত যাত্রীদের ভিড়ের মধ্যে বসেছিলেন প্ল্যাটফর্মে । হাতে মােকামাঘাটের একটি টিকিট । সেদিন প্ল্যাটফর্মে হাজির ছিল সিংভূমের কুখ্যাত পুলিশ সাব ইনসপেক্টর নন্দলাল ব্যানার্জী । প্রফুল্লর পায়ের নতুন জুতাে দেখে কেমন তার সন্দেহ হল । তাকে পলাতক আসামী ভেবে শেষ পর্যন্ত মােকামাঘাটে পৌছে প্রফুল্লকে গ্রেপ্তারের উদ্যোগ করতে , প্রফুল্ল ধরা না দিয়ে প্ল্যাটফর্মে ছুটতে লাগলেন । পাহারাওয়ালাদের হাতে ধরা পড়া থেকে অব্যাহতি নেই বুঝে নিজের রিভালভার বের করে নিজের কপালে করলেন গুলি । নির্ভীক বিপ্লবী প্রফুল্লর দেহ লুটিয়ে পড়ল প্ল্যাটফর্মের ওপর ।
মৃত্যুর পর প্রফুল্ল চাকীর গুলিবিদ্ধ দেহটি পাঠিয়ে দেওয়া হল সনাক্ত করার জন্য মুজঃফরপুরে ক্ষুদিরামের কাছে । সহযােগী বন্ধুর মৃতদেহ দেখে ক্ষুদিরাম চিনতে পারলেন । সনাক্ত করলেন — দীনেশ রায়ের মৃতদেহ বলে ।
পুলিশ কর্তাদের হুকুমে প্রফুল্লর মৃতদেহ থেকে গলা কেটে মাথা বিচ্ছিন্ন করা হল এবং কেরােসিনের টিনে স্পিরিটে ডুবিয়ে মাথাটি ভাল করে সনাক্ত করার উদ্দেশ্যে কলকাতায় আনা হল ।
❤ ‘ ক্ষুদিরাম যে যুবকের মৃতদেহ দেখিয়া পুলিশের নিকট তাহাকে দীনেশচন্দ্র রায় নামে পরিচিত করিয়া দিল , তাহার প্রকৃত নাম প্রফুল্ল চাকী ।
— সঞ্জীবনী পত্রিকা ( ১৪ মে , ১৯০৮ )”