হাড় ক্ষয়ের ৮ কারণ

অস্টিওপোরোসিস হলো হাড়ের ক্ষয়জনিত রোগ। রোগটিতে সহজেই হাড় ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, নারীদের অস্টিওপোরোসিসের হার বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অস্টিওপোরোসিস ফাউন্ডেশনের মতে, ৮০ শতাংশ অস্টিওপোরোসিস রোগীই হলো নারী। অস্টিওপোরোসিস কিন্তু অনিবার্য রোগ নয়, জীবনযাপনে কিছু পরিবর্তন এনে রোগটির ঝুঁকি কমানো যায়। কেবল ক্যালসিয়ামের অভাব নয়, কিছু নিরীহ অভ্যাসও অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এখানে হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়ার ৮টি কারণ দেয়া হলো।

দীর্ঘসময় বসে থাকা : নিষ্ক্রিয় জীবনযাপনে অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। নিউ ইয়র্কের ব্রোনক্সে অবস্থিত মন্টেফিয়োর হেলথ সিস্টেমের অর্থোপেডিকসের অ্যাটেন্ডিং ফিজিশিয়ান জোনাথান লি বলেন, ‘হাড় হলো জীবন্ত কলা (লিভিং টিস্যু), যা ভারের প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখায়। হাঁটাচলা, ভারোত্তোলন ব্যায়াম ও টেনিসের মতো খেলা খেলে হাড়ের ওপর ভার প্রয়োগ করা যায়, যা হাড় গঠনকারী কোষগুলোকে উদ্দীপ্ত করবে। আপনি হাড়কে যত বেশি ব্যবহার করবেন, তত বেশি খাপ খাওয়াতে পারবে ও মজবুত হবে। অন্যদিকে হাড়কে ব্যবহার না করলে হাড়ের ক্ষয় হতে থাকে।’ তাই বয়স্ককালে অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি কমাতে এখন থেকেই ভারোত্তোলন ব্যায়াম করতে পারেন, অর্থাৎ এমন ব্যায়ামে অভ্যস্ত হোন যা হাড়ের ওপর ভার ফেলবে। ডা. লি বলেন, ‘অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধের একটি উত্তম উপায় হলো নিয়মিত হাঁটা।’

উচ্চ প্রোটিনের খাবার : পালিও ডায়েট ও অ্যাটকিনস ডায়েটের মতো মাংস-ভিত্তিক খাদ্যাভ্যাস হাড়ের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। এসব ডায়েট অনুসরণ না করেও যারা প্রচুর মাংস খান তাদেরও হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়ার ঝুঁকি বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রয়োজনের চেয়ে বেশি প্রোটিন খেলে হাড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু কিভাবে? এ প্রসঙ্গে ডা. লি বলেন, ‘উচ্চ প্রোটিনের খাবার খেলে কিডনিগুলো শরীর থেকে বেশি করে ক্যালসিয়াম বের করে দেয়। কিন্তু ক্যালসিয়াম হাড় গঠনের অন্যতম প্রধান উপকরণ বলে এটি কমে গেলে হাড়ের খনিজ ঘনত্বও কমে যায়। এটা অস্টিওপোরোসিসে ভোগাতে পারে।’

লবণাক্ত খাবার: হাড় ক্ষয়ের আরেকটি ডায়েটারি ফ্যাক্টর হলো লবণের আসক্তি। ডা. লি বলেন, ‘উচ্চ লবণ গ্রহণে রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। যেহেতু কিডনিগুলো শরীর থেকে লবণ বের করে দিতে কাজ করে, তাই রক্তপ্রবাহ থেকে ক্যালসিয়ামও দূর হয়ে যায়।’ দ্য এন্ডোক্রাইন সোসাইটির সভায় উপস্থাপিত জাপানের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, চল্লিশোর্ধ্ব যেসব নারী উচ্চ পরিমাণে লবণ খেতেন তাদের মধ্যে ফ্র্যাকচারের হার লবণে অনাসক্ত নারীদের তুলনায় চারগুণ বেশি। তাই শেষ বয়সে হাড়ের সমস্যায় জর্জরিত হতে না চাইলে কতটুকু লবণ খাচ্ছেন খেয়ালে রাখুন। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিদিন ২,৩০০ মিলিগ্রামের বেশি লবণ খাওয়া উচিত নয়।

রোদ এড়িয়ে চলা: এটা ঠিক যে ত্বকে ক্যানসারের ঝুঁকি এড়াতে সানস্ক্রিন ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু তাই বলে এটা ভুলে গেলে চলবে না যে শরীরে ক্যালসিয়ামের কাজে সহায়তার জন্য ভিটামিন ডি এরও প্রয়োজন রয়েছে। ডা. লি বলেন, ‘শরীরে ক্যালসিয়ামের শোষণ ও ব্যবহার সফল করতে ভিটামিন ডি লাগে। ক্যালসিয়াম ব্যতীত মজবুত হাড়ের কথা কল্পনাও করা যায় না, কারণ এটা হলো হাড় গঠনের অন্যতম প্রধান উপকরণ।’ যারা প্রায়সময় ইনডোরে অবস্থান করেন তাদের শরীরে ভিটামিন ডি এর অভাব হয়। শরীর পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি না পেলে ক্যালসিয়াম থেকেও বঞ্চিত হয়, যার প্রভাব পড়ে হাড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অস্টিওপোরোসিস ফাউন্ডেশনের মতে, ৫০ এর কম বয়সি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন ৪০০-৮০০ আইইউ ভিটামিন ডি প্রয়োজন। বয়স ৫০ পার হলে প্রয়োজন বেড়ে ৮০০-১,০০০ আইইউ হয়। কিছু সময় রোদে কাটিয়ে শরীরকে ভিটামিন ডি তৈরির সুযোগ দিতে পারেন। ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবারও খেতে পারেন। রোদে কাটানোর মতো সময় না থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্টও সেবন করতে পারেন।

কফির আসক্তি: কফি শুরুর দিকে উপকার করলেও পরবর্তীতে হাড়ের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। ডা. লি বলেন, ‘ক্যাফেইন হাড়ের ওপর যে প্রভাব ফেলে তা আসলেই বয়স্ক নারীদের জন্য বড় সমস্যার কারণ হতে পারে। ক্যাফেইন কেন হাড়ের ঘনত্ব কমায় তা গবেষণা করতে গিয়ে গবেষকরা জেনেছেন যে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ইস্ট্রোজেনের অভাবে এমনটা ঘটে। তাই যেসব নারীর মেনোপজ হয়েছে, অর্থাৎ মাসিকের স্থায়ী পরিসমাপ্তি ঘটেছে তাদের কফি পানে অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি বেশি।’ তাই আপনার হাড় ক্ষয়ের অন্যান্য রিস্ক ফ্যাক্টর থাকলে কফি পরিহারের কথা ভাবতে পারেন। অথবা প্রতিদিন প্রচুর কফি পানের অভ্যাস থাকলে তা কমানোর চেষ্টা করাই ভালো।

ওজন কমে যাওয়া: শরীরের ওজন ভারসাম্য হারিয়ে বেশি বেড়ে গেলে অথবা কমে গেলে কোনোটাই হাড়ের জন্য মোটেই ভালো নয়। হাড়ের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে শরীরের ওজন স্বাস্থ্যকর পর্যায়ে থাকা চাই। শরীরের ওজন খুব কমিয়ে ফেললে হাড়কে বেশ ভুগতে হবে। ডা. লি বলেন, ‘ব্যায়ামের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে হাড়ের ওপর ভারসাম্যপূর্ণ ভার পড়ছে। হাড়কে উদ্দীপ্ত করে স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটাতে এটার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু শরীরের ওজন অতিরিক্ত কমে গেলে সহজেই ভারসাম্য বিনষ্ট হতে পারে। বডি মাস ইনডেক্স ১৯ এর কম হলে এটাকে অস্টিওপোরোসিসের রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচনা করা হয়।’ হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথে প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুসারে, এক ইউনিট (প্রায় পাঁচ থেকে আট পাউন্ড) বিএমআই বাড়লে হাড় ক্ষয়ের ঝুঁকি ১২ শতাংশ কমে যায়। ওজন খুব কমে গেলে শরীর পুষ্টিহীনতায় ভুগতে পারে। শরীরে পুষ্টির অভাব যত বেশি হয়, হাড় ক্ষয়ের ঝুঁকিও তত বেড়ে যায়।

য়াইনের আসক্তি : ইউনিভার্সিটি অব অরিগনের একটি গবেষণা বলছে, অতিরিক্ত ওয়াইন বা অ্যালকোহল পানে হাড় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ডা. লি বলেন, ‘ওয়াইন বা অ্যালকোহল পান করলে জিআই ট্র্যাক্টের পক্ষে ক্যালসিয়াম শোষণ করা কঠিন হয়ে যায়। এ ধরনের পানীয় প্যানক্রিয়াস ও লিভারকেও প্রভাবিত করে, যা ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি এর ওপর প্রভাব ফেলে। অ্যালকোহল শরীরের বিভিন্ন হরমোনকেও প্রভাবিত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, করটিসলের মাত্রা বেড়ে গিয়ে হাড়ের খনিজ ঘনত্ব কমে যেতে পারে।’ তিনি আরো জানান, ‘নারীরা উচ্চ পরিমাণে অ্যালকোহল পান করলে ইস্ট্রোজেনের মাত্রা কমে যায়। এটাও অস্টিওপোরোসিসের দিকে ধাবিত করে।’ গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যালকোহল হাড় গঠনকারী কোষ অস্টিওব্লাস্টের জন্য বিষাক্ত।

কোমল পানীয় : গবেষণায় দেখা গেছে- কোলার মতো সোডা বা কোমল পানীয় হাড়ের ঘনত্ব কমিয়েছে, কিন্তু এর কারণ এখনো স্পষ্ট নয়। টাফটস ইউনিভার্সিটির গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন, যেসব নারী নিয়মিত (প্রতিদিন তিন থেকে চার বার) কোলা সোডা পান করেছেন তাদের নিতম্বে হাড়ের ঘনত্ব কম ছিল। গবেষণাটি দ্য আমেরিকান জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনে প্রকাশিত হয়। এই গবেষণার গবেষকদের তত্ত্ব হলো, কোমল পানীয়ের ক্যাফেইন বা ফসফরিক অ্যাসিড হাড় থেকে ক্যালসিয়াম টেনে নিতে পারে। কিন্তু ডা. লি বলেন যে ফসফরিক অ্যাসিডকে দায়ী করার জন্য যথেষ্ট প্রমাণ নেই। এছাড়া কোমল পানীয়ের প্রতি আসক্ত হলে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ তরল (যেমন- দুধ) পানের প্রবণতা কমে যায়। এটাও অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি বাড়ায়।

Related posts:

পদার্থ কাকে বলে ? পদার্থ ও বস্তু কি এক ?
প্রশ্ন : মূল্যায়ন কাকে বলে ? মূল্যায়ন কয় প্রকার ও কী কী ? যে - কোনো একপ্রকার মূল্যায়নের বিবরণ দি...
একক পাঠ পরিকল্পনা কাকে বলে ? পাঠ পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা লিখুন । এর সুবিধা লিখুন ।
শিক্ষা পরিকল্পনা কাকে বলে ? শিক্ষা পরিকল্পনার শ্রেণিবিভাগ করুন । যেকোনো একপ্রকার পরিকল্পনার বিবরণ দি...
ধারণা মানচিত্র কাকে বলে ? এর বৈশিষ্ট্য লিখুন । বাস্তবায়নের উপায় লিখুন । এর গুরুত্ব লিখুন ।
পাঠ একক বিশ্লেষণ কাকে বলে ? পাঠ একক বিশ্লেষণের স্তর বা ধাপগুলি লিখুন
অন্তর্ভুক্তিকরণে ( সমন্বিত শিখনে ) প্রদর্শিত শিল্পকলার কীভাবে প্রয়োগ করবেন
প্রদর্শিত শিল্পকলার লক্ষ্য , বৈশিষ্ট্য , গুরুত্ব ও বাস্তবায়নের কৌশল
প্রাথমিক স্তরে পাঠদানের ক্ষেত্রে নাটকের ব্যবহার
মূল্যবোধ শিক্ষায় বিদ্যালয় ও শিক্ষকের ভূমিকা
মূল্যবোধ || মূল্যবোধের বৈশিষ্ট্য || প্রাথমিক স্তরে মূল্যবোধের শিক্ষার গুরুত্ব
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের শিক্ষায় তথ্য ও সংযোগসাধন প্রযুক্তির ভূমিকা
সমন্বয়িত শিক্ষণে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের সমস্যা ও সাফল্য
পাঠক্রম পরিব্যাপ্ত শিক্ষণবিজ্ঞানে তথ্য ও সংযোগসাধন প্রযুক্তির ব্যবহার
পাঠক্রম পরিব্যাপ্ত শিক্ষণবিজ্ঞানে তথ্য ও সংযোগসাধন প্রযুক্তির ব্যবহার
উদাহরণসহ প্রকল্প পদ্ধতির বিবরণ
পূর্বসূত্রজনিত শিখন ( Contextualization ) কাকে বলে ?
জ্ঞান , পাঠক্রম , পাঠ্যবই , শিক্ষার্থী ও শিক্ষণবিজ্ঞানের মধ্যের সম্পর্ক
অনুসন্ধান পদ্ধতি
জ্ঞান নির্মাণ কীভাবে হয় উদাহরণসহ আলোচনা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page