ক্ষুদিরাম বসু

” মেদিনীপুরের এক গ্রামের ছেলে । দুই দাদা আর তিন দিদির পর সে মায়ের কোলে এলাে । ছেলেটি ষষ্ঠ সন্তান । এর মধ্যেই তার দুই দাদা মারা পড়েছে । সবে ধন নীলমণি এই ছেলেটিও যদি মারা পড়ে তাহলে পুত্র সন্তান তাে কেউ রইল না । যমরাজার দৃষ্টি কীভাবে এড়ানাে যায় ? 

 

 

গ্রামাঞ্চলে তখন এক সংস্কার খুব প্রচলিত । কেউ যদি এই সদ্যজাত সন্তানকে কিছু দিয়ে কিনে নেয় , তাহলে যমরাজার হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়া যাবে । এই সংস্কার অনেক আগে থেকেই চলন ছিল । আশেপাশে খুঁজলে দেখা যাবে , এককড়ি তিনকড়ি পাঁচকড়ি নামের মানুষজন । ছেলেবেলায় তাকে বাঁচাতে কেউ না কেউ প্রিয়জন কড়ি দিয়ে কিনে নিয়েছিল ।

 

 সংস্কারবশে তিন দিদির মধ্যে বড়দিদি অপরূপা তিন মুঠো চালের খুদ দিয়ে সেই ছেলেটিকে কিনে নিল । এখন নিক দেখি যমরাজা এই ছােট ভাইকে কেমন করে ছিনিয়ে নিতে পারে ?

 

 

ছেলেটি ক্রমে ক্রমে বড়াে হয়ে উঠতে লাগল । সে বেশ ছটফটে ও দুরন্ত । তবে সে কিন্তু বন্ধুবৎসল ছিল । বন্ধুদের সঙ্গে তার ভাব কম নয় । একদিন ছেলেটি ভর্তি হল মেদিনীপুর হ্যামিলটন স্কুলে এবং পরবর্তীকালে মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে । ছাত্র হিসেবে ছেলেটি যে খুব ভাল তেমন নয় । ইতিমধ্যে সে প্রথমেই হারিয়েছে মাকে এবং তার পরে বাবাকে । ছােটোবেলাতেই মা – বাবাকে হারিয়ে দিদির কাছে বড়াে হতে লাগল । তার খুদ দিয়ে কেনা ভাইকে সে কি পরম আদরে ও স্নেহে প্রতিপালন না করে পারে ? 

 

 

কে সেই ছেলেটি ? ছেলেটির নাম ক্ষুদিরাম । খুদ দিয়ে কেনা বলে তার এই নাম । তিনি বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু । যিনি ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেলেন দেশ স্বাধীনতার গান । বন্দেমাতরম্ । 

 

 

ক্ষুদিরাম স্কুলে পড়াকালীন স্বদেশিদের সঙ্গে মেলামেশা করতে লাগলেন । তিনি যে স্বদেশি হতে চান ! ভারতমাতার পরাধীনতার শৃঙ্খলমােচনে তাকে তাে অংশ নিতেই হবে ! মাতৃসমা দিদি অপরূপা দেবী তাকে নিষেধ করে থামাতে পারে না । কোন্ মুহূর্তে ইংরেজদের কোপানলে পড়ে বিপদের সম্মুখীন হয় তার ঠিক নেই । জামাইবাবু অমৃতলাল রায় তাকে আর তার বাড়িতে রাখতেই চাইলেন না । শেষে কি তারা এই শ্যালকটির জন্য ঘােরতর বিপদের মধ্যে পড়বে ? সাধারণ ছাপােষা মানুষ কেনই বা শাসকশ্রেণির শত্রু হবে ? তিনি তাই ক্ষুদিরামকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বললেন ।

 

 

ক্ষুদিরাম নিরাশ্রয় হলেন । তবু তাে একটু আশ্রয় চাই । তার এক পাতানাে দিদি ছিল এক মুসলমান পরিবারে । তিনি তার আশ্রয়ে উঠলেন । তা আবার ক’দিন ! সে – আশ্রয়ও তাকে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যেতে হল দেশের ডাকে । 

 

 

তেরাে বছর বয়সেই ক্ষুদিরাম মেদিনীপুরে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সংস্পর্শে আসেন । যােগ দেন যুগান্তর দলে । চলতে লাগল কাপড়বােনা , ব্যায়ামচর্চা ও গীতাপাঠ । এসব করতে করতে দেশের আন্দোলনে জড়িয়ে গেলেন । বিশেষ করে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ প্রতিরােধ আন্দোলনের সঙ্গে । চলতে থাকল বিলাদি দ্রব্য বয়কট , বিলতি লবণের নৌকা ডুবিয়ে দেওয়ার কাজ । বিপ্লবী পত্রিকা প্রচার চালাতে লাগলেন । ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুরে মারাঠা কেল্লায় এক প্রদর্শনীতে ‘ সােনার বাংলা পত্রিকা তিনি তখন প্রচার করছিলেন । বিপ্লবীদের এই পত্রিকা প্রচারের সময় পুলিশের হাতে তিনি গ্রেপ্তার হলেন । দুরন্ত ও দুর্জয় ক্ষুদিরাম পুলিশকে মেরে সেখান থেকে পালালেন । পরে ধরা পড়লেও অল্পবয়সী ছেলে বলে ছাড়া পেলেন তখন তিনি ।

 

 

 

গুপ্ত সমিতির অনেক টাকার প্রয়ােজন । ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে টাকার প্রয়ােজন মেটাতে লুঠ করলেন মেলব্যাগ । সেই বছরই বিপিনচন্দ্র পালের বিরুদ্ধে মামলা চলছিল । বিচারপতি ছিলেন কিংসফোর্ড । স্বদেশিদের প্রতি দণ্ড দানে সে ছিল নির্মম । বিপ্লবীরা ঠিক করলেন তাকে হত্যা করার । এই বিচারপতি বদলি হয়ে গেলেন মজঃফরপুরে । বিপ্লবীদল তাকে হত্যা করার ভার দিল ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকীকে । ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী এই ভার মাথায় তুলে নিয়ে হরেন সরকার ও দীনেশ রায় ছদ্মনামে চলে গেলেন মজঃফরপুর ।

 

 

 

 ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ৩০ এপ্রিল রাত্রি সাড়ে ৮ টা । তারা দুজন পথের পাশে অপেক্ষা করছিলেন কিংসফোর্ডের গাড়ির জন্য । কেন জানি ভুল হয়ে গেল । যে গাড়ি আসার কথা সে গাড়ির বদলে সেই সময় এসে গেল অন্য এক গাড়ি । ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী ভুল করে হত্যা করে ফেললেন নিরীহ দুই ইউরােপীয় মহিলাকে । 

 

 

নির্দিষ্টজনকে হত্যা করতে না পেরে এবং গােবেচারী দুজন মহিলাকে হত্যা করে । ক্ষুদিরাম দুঃখ পেলেন । তিনি গ্রেপ্তার হলেন । প্রফুল্ল ধরা পড়ার আগেই আত্মহত্যা করলেন ।

 

 

এরপর তাে বিচারের নামে প্রহসন । ক্ষুদিরামের ফাঁসির আদেশ হল । ফাঁসি দেওয়া হবে শুনে তিনি ভীত নন । হাসিমুখে জানালেন , মৃত্যুকে তিনি ভয় পান না । তার শেষ ইচ্ছা তার দিদিকে একবার দেখার । তবে তার শেষ ইচ্ছা পূরণ হয় নি । তারা দিদিকে ক্ষুদিরামের সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি । 

 

 

১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ১১ ই আগস্ট । মজঃফরপুর জেলে ভাের ছটায় ফাসি হয়ে গেল ক্ষুদিরামের । ফাঁসির আগেই নির্ভিক ক্ষুদিরাম হাসছিলেন । পাটাতনে পা দিয়েই ফঁসির দড়ি টানার প্রাকমুহূর্তে তিনি ধ্বনি তুললেন — ‘ বন্দেমাতরম্ ।

 

 

❤ ‘ একবার বিদায় দে মা …’

                           — বিখ্যাত লােকগান 

 

❤ ‘ শিশু হলেও ক্ষুদিরাম অগ্নিশিশু , একখানি বহ্নি – দীপ্ত তরবারি । 

                           —ভূপেন্দ্রকিশাের রক্ষিত রায়”

Related posts:

পদার্থ কাকে বলে ? পদার্থ ও বস্তু কি এক ?
প্রশ্ন : মূল্যায়ন কাকে বলে ? মূল্যায়ন কয় প্রকার ও কী কী ? যে - কোনো একপ্রকার মূল্যায়নের বিবরণ দি...
একক পাঠ পরিকল্পনা কাকে বলে ? পাঠ পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা লিখুন । এর সুবিধা লিখুন ।
শিক্ষা পরিকল্পনা কাকে বলে ? শিক্ষা পরিকল্পনার শ্রেণিবিভাগ করুন । যেকোনো একপ্রকার পরিকল্পনার বিবরণ দি...
ধারণা মানচিত্র কাকে বলে ? এর বৈশিষ্ট্য লিখুন । বাস্তবায়নের উপায় লিখুন । এর গুরুত্ব লিখুন ।
পাঠ একক বিশ্লেষণ কাকে বলে ? পাঠ একক বিশ্লেষণের স্তর বা ধাপগুলি লিখুন
অন্তর্ভুক্তিকরণে ( সমন্বিত শিখনে ) প্রদর্শিত শিল্পকলার কীভাবে প্রয়োগ করবেন
প্রদর্শিত শিল্পকলার লক্ষ্য , বৈশিষ্ট্য , গুরুত্ব ও বাস্তবায়নের কৌশল
প্রাথমিক স্তরে পাঠদানের ক্ষেত্রে নাটকের ব্যবহার
মূল্যবোধ শিক্ষায় বিদ্যালয় ও শিক্ষকের ভূমিকা
মূল্যবোধ || মূল্যবোধের বৈশিষ্ট্য || প্রাথমিক স্তরে মূল্যবোধের শিক্ষার গুরুত্ব
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের শিক্ষায় তথ্য ও সংযোগসাধন প্রযুক্তির ভূমিকা
সমন্বয়িত শিক্ষণে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের সমস্যা ও সাফল্য
পাঠক্রম পরিব্যাপ্ত শিক্ষণবিজ্ঞানে তথ্য ও সংযোগসাধন প্রযুক্তির ব্যবহার
পাঠক্রম পরিব্যাপ্ত শিক্ষণবিজ্ঞানে তথ্য ও সংযোগসাধন প্রযুক্তির ব্যবহার
উদাহরণসহ প্রকল্প পদ্ধতির বিবরণ
পূর্বসূত্রজনিত শিখন ( Contextualization ) কাকে বলে ?
জ্ঞান , পাঠক্রম , পাঠ্যবই , শিক্ষার্থী ও শিক্ষণবিজ্ঞানের মধ্যের সম্পর্ক
অনুসন্ধান পদ্ধতি
জ্ঞান নির্মাণ কীভাবে হয় উদাহরণসহ আলোচনা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page