“ছেলেটি কলেজে পড়ে । মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের ব্রজনাথ কলেজে । সময়টা হচ্ছে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দ । তখন ভারতবর্ষ ইংরেজদের অধীন । সেই সময় ছাত্রটি বিপ্লবীদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হলাে । চোখের দৃষ্টিতে এক ক্ষিপ্রতা । বুকে এক সংকল্প । বিদেশী শক্তিকে যে – কোনাে উপায়ে তাড়িয়ে মাতৃভূমিকে স্বাধীন করতে হবে । মাতৃভূমিকে শৃঙ্খলমুক্ত করতে না পারলে জাতি হিসাবে আমরা প্রতিষ্ঠিত হতে পারব না । নিজের বাসভূমিতে পরবাসীর মতাে আত্মমর্যাদাহীন অপমানকর জীবন যাপন করতে হবে । তাই বিদেশী শক্তিকে বিতাড়িত করার প্রবল ইচ্ছা বুকে নিয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে ।
ছেলেটি একসময় কলেজ থেকে বি . এ . পাশ করে গেল । এরপর সে বাড়ি ফিরে যায় । স্বদেশী কর্মীরা জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে । ছেলেটি হলাে সেই স্কুলের একজন শিক্ষক । কিছু কিছু দেশপ্রেমিক তার মতাে শিক্ষক হয়েছে ।
কিন্তু সেই ছেলেটি একটু যেন ভিন্ন ধরনের । তার তেজোদীপ্ত কথায় আর আন্তরিক উচ্চারণে ছাত্রগুলাে কেমন যেন হয়ে ওঠে । শীর্ণকায় অতি সাধারণ চেহারার এই ছেলেটির অন্তর ছিল স্নেহ প্রীতি মমতায় পূর্ণ । সে সদাহাস্যময় ও সংযতবাক । তার সংস্পর্শে ছাত্রগুলাে নবজীবনের দীক্ষা নিতে থাকে । সেই ছেলেটি তাদের বিপ্লবী দল গঠনে নেতৃত্ব দেয় । তৈরি করে গােপন সংগঠন ‘ সাম্যাশ্রম ’ । কর্মীদের শরীরচর্চার জন্য স্থাপন করে পাড়ায় পাড়ায় ক্লাব । সশস্ত্র লড়াইয়ের জন্য শিক্ষা দিয়ে গঠন করে । রিপাবলিকান আর্মি । সেই ছেলেটিকে সকলেই ডাকতে লাগল ‘ মাস্টারদা ’ বলে । সে সকলের প্রিয় মাস্টারদা ।
কে এই মাস্টারদা ? তার নাম সূর্যকুমার সেন । সূর্য সেন । চট্টগ্রামের বীর বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেন । তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার সুপ্রসিদ্ধ নয়াপাড়া গ্রামে ১৮৯৪ সালের ২৩ মার্চ । তার পিতার নাম রাজমণি সেন । মাতার নাম শশীবালা দেবী ।
মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন । তাদের আত্মত্যাগ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ইতিহাসে একটি গৌরবােজ্জ্বল ইতিহাস রচনা করেছে ।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল । গভীর রাত্রিতে সর্বাধিনায়ক মাস্টারদার নেতৃত্বে ৬৫ জন অসম সাহসী যুবক চট্টগ্রাম শহরের দুটি অস্ত্রাগার দখল করে বিরাট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিল । তারা ধ্বংস করেছিল টেলিফোন টেলিগ্রাফের অফিস । যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করতে উপড়ে ফেলেছিল রেললাইন । সেদিন চট্টগ্রামকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে মুক্ত করে ইউনিয়ন জ্যাক নামিয়ে জাতীয় পতাকা তুলেছিলেন সূর্য সেন ।
কদিন পরে ২২ এপ্রিল ১৯৩০। জালাদাবাদ পাহাড়ে তার নেতৃত্বে বিপ্লবী বাহিনী সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হলাে । দু’ঘণ্টা ধরে চলে প্রচণ্ড যুদ্ধ । সরকারী বাহিনী পিছু হঠল । বিপ্লবের তীর্থভূমি রক্তস্নাত জালালাবাদ । তরুণ সেনানী ১২ জন শহীদ হলাে । ইংরেজ বাহিনীর পুনরাক্রমণে রাত্রির অন্ধকারে সূর্য সেন অন্যান্য বিপ্লবীদের সঙ্গে নিয়ে পাহাড়শীর্ষ ত্যাগ করে আত্মগােপন করলেন ।
আত্মগােপন পর্বে সূর্য সেন গেরিলা যুদ্ধের রণকৌশল গ্রহণ করেন । তার নিদের্শে বিপ্লবীদের অসম সাহসিক কাজ । অতর্কিতে হানা দিয়ে ইংরেজ শাসক কর্মচারী আক্রমণ ও নিধন । ইংরেজ মহলকে ব্যতিব্যস্ত করলেন তারা । করলেন বিপুল ভীতির সঞ্চার ।
১৯৩৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি । সূর্য সেন ছিলেন পটিয়া থানার গৈরলা গ্রামের এক গােপন আশ্রয় কেন্দ্রে । অতর্কিত ভাবে গুর্খাবাহিনীর হাতে ধরা পড়লেন তিনি । ধরা পড়তে হলাে একজনের বিশ্বাসঘাতকতায় । বিচারে সূর্য সেনের ফাসীর আদেশ হলাে । সহযােগী বিপ্লবীরা এদিকে বসে নেই । বিশ্বাসঘাতক নেত্র সেনকে ৯ জানুয়ারি ১৯৩৪ তারিখে হত্যা করে সে খবর তারা পৌছে দিলেন সূর্য সেনের কাছে । সূর্য সেন তখন চট্টগ্রাম জেলের কনডেম সেলে ফাসীর দিন গুনছেন ।
১২ জানুয়ারি ১৯৩৪ তারিখে ফাসীকাঠে তুলে দেওয়া হল তাকে । তার আগেই দুবৃত্ত ব্রিটিশ সেনা জেলের কক্ষে অত্যাচার করেই তাকে খুন করে । তারপর নিহত মাস্টারদার প্রাণহীন দেহ ঝুলিয়ে দেয় বর্বর সাম্রাজ্যবাদ ।
এভাবে একটি মহৎ বিপ্লবী জীবনের অবসান হলাে । অবসান হলাে স্বাধীনতার ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়ের রচয়িতার । চট্টগ্রাম বিদ্রোহের এই স্ফুলিঙ্গ সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে ছিল এক প্রচণ্ড দাবানল । সে দাবানলে দগ্ধ ক্ষতবিক্ষত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ অবশেষে একদিন পাততাড়ি গােটাতে বাধ্য হয়েছিল । তাই আজ ভারত স্বাধীন ।
❤ ‘ আদর্শ এবং একতা — এই আমার শেষ বাণী ।’ – সূর্য সেন”