“ছেলেটি ব্রাহ্ম পরিবারের । বাবা স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক । মা একজন কবি । ভােরবেলায় মায়ের গলায় বাজতাে ব্রাত্মসঙ্গীত । বাবা পড়তেন উপনিষদের শ্লোক । প্রতিদিন প্রভাতে ছেলেটির প্রবেশ ঘটত পবিত্রতার পথে শান্তির ভেতর দিয়ে ।
বাড়ির কর্মচারিরা সবাই তাকে ভালবাসত । তাদের বাগানে যে মানুষটি কাজ করত , সে ঘাস কাটতে কাটতে গল্প বলত । তার ধারালাে কাস্তে যখন সশব্দে ঘাসের ওপর বয়ে যেত , তখন ছেলেটির শিশু প্রাণে ব্যথা বাজত । আর লােকটি তখন তাকে স্বপ্নিল লােভ দেখিয়ে প্রবােধ দিয়ে বলত , কিছু ভেবাে না খােকাবাবু , কদিনের ভেতর আবার সুন্দর কচি ঘাস বের হবে । বাড়িতে যে চাষির মেয়ে কাজ করত , সন্ধ্যায় নিদ্রিত শিশুদের ঘুম থেকে জাগিয়ে কঁঠালকাঠের পিঁড়িতে বসিয়ে পিলসুজের ম্লান আলােয় খেতে দিয়ে গল্প শােনাত নাটকীয় ভঙ্গীতে । সেসব শুনতে শুনতে ছেলেটির মন স্বপ্নিল হয়ে উঠত ।
ছেলেটির বেশিরভাগ সময় কাটত ছােট ভায়ের সঙ্গে হাডুডু , মার্বেল খেলা আর কুস্তি করে । সময় কাটত প্রজাপতির পেছনে দৌড়ে , ঘুড়ি উড়িয়ে কিংবা চারপাশের গাছপালা , পশু – পাখি , ফল – ফুল , মেঘ কিংবা আকাশ দেখে মুগ্ধ হয়ে ।
ছেলেটি একটু বেশি বয়সে স্কুলে ভর্তি হল । ভর্তি হল বরিশালের ব্রজমােহন স্কুলে । ছাত্র হিসেবে সে ছিল মধুর স্বভাবী , কিছুটা একাকী । স্কুলের ভাল ছাত্র ছিল বলে মাস্টারমশাইরা তাকে সকলে স্নেহ করতেন । স্কুলের উঁচু শ্রেণিতে পড়ার কালে কয়েকজন সহপাঠীদের সঙ্গে ঘরােয়া সাহিত্য সভা গড়ে উঠল , তাকে কেন্দ্র করে তাদের বাড়িতে মায়ের প্রশ্রয়ে । মা তাে একজন কবি । তিনি ছেলে ও ছেলের বন্ধুদের সঙ্গে সাহিত্যকে তালিম দিতে নানা আলােচনা ও তর্কবিতর্ক করতেন । এভাবেই ছেলেটির মনে গড়ে উঠতে লাগল সাহিত্যপ্রীতি ।
স্কুলে পড়াকালীন সেই ছেলেটির সাহিত্য রচনার সূত্রপাত । বাংলা এবং ইংরাজি উভয় ভাষাতেই কবিতা রচনা তাকে নেশার মত পেয়ে বসল । মায়ের যত্নে ও উৎসাহে তার কাব্যপ্রতিভা দিন দিন বিকাশ লাভ করতে লাগল ।
ছেলেটি ১৯১৫ খ্রিঃ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করে ভর্তি হল ব্রজমােহন কলেজে । আই . এ . পাশ করল ( ১৯১৭ খ্রিঃ ) প্রথম বিভাগে । তারপর ইংরাজিতে অনার্স নিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি . এ . পাশ করে , ১৯২১ খ্রিঃ ইংরাজি নিয়ে এম . এ . পাশ করল । আইন পড়তে পড়তেই ছেলেটি সিটি কলেজে চাকরি পেয়ে গেলে , তার আইন পড়া আর হল না । ছেলেটির তখন নতুন অধ্যাপক জীবন । অধ্যাপনার ফাঁকে যে সময় পেত , ছেলেটি তা খরচ করত কবিতা লেখার ভেতর দিয়ে । কলকাতার নাগরিক কোলাহলের ভেতর দিয়েও ছেলেটির চোখে ধরা দিত বরিশালের প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলের চিত্ররূপময় ঐশ্বর্য । সৌন্দর্যের গভীর আকর্ষণ তাকে প্রকৃতি থেকে প্রকৃতির দিকে ক্রমশ তাড়িয়ে নিয়ে যেতাে । তার চোখে ভেসে উঠত — কৃয়চূড়া গাছের নিচে কোমল ঘাস , ফুলের প্রাচুর্যে ভরা গন্ধরাজের ঝাড় , মেহেদী গাছের বেড়ার প্রান্তে নীল জবা কিংবা মাধবীলতার ঐশ্বর্য । চোখে ভেসে উঠত — নষ্ট শশা , পচা লাউ কুমড়া , ঝাউপাতা , মুথা ঘাস , লাল বটফল , চোরকাটার যত সব অবহেলিত তুচ্ছতা । তার নাকে এসে বিভাের করে তুলত কাঠালি চাপার তীব্র মধুর গন্ধ । ছেলেটি প্রকৃতি – প্রেমিক । প্রকৃতির রূপ রস গন্ধে সে মুগ্ধ । তার কবিতায় এ সবেরই প্রাধান্য ।
কে এই ছেলেটি ? প্রকৃতির নিগূঢ় রহস্য নিয়ে যার কবিতায় লীলাখেলা । একদিকে অধ্যাপনা , আর অন্য দিকে কবিতা নিয়ে যার দিনযাপন ?
ছেলেটির নাম জীবনানন্দ দাশ । তাঁর জন্ম ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯ খ্রিঃ বরিশালে । পিতার নাম সত্যানন্দ দাশ । মাতা বিখ্যাত কবি কুসুমকুমারী । মায়ের সাহিত্য প্রতিভা লাভ করেছিলেন জীবনানন্দ । তার কাব্যপ্রতিভা বিকাশলাভ করেছিল কবি – মাতার প্রযত্নে ও উৎসাহে ।
জীবনানন্দ দাশের সিটি কলেজের অধ্যাপনার মেয়াদ ছ’বছর ( ১৯২২-২৮ ) । কবিতায় অশ্লীলতার অভিযােগে তিনি কলেজের চাকরি হারান । সে – সময় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তার কবিতা আধুনিক বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে খুব আলােড়ন এনেছিল । নারীর শরীরের কিছু গােপন নাম কবিতার প্রয়ােজনে শব্দ হয়ে উঠেছিল তার কবিতায় । এটাই নাকি তার অপরাধ !
এরপর তিনি দিল্লীর রামযশ কলেজে অধ্যাপনা করেন । দিল্লীতে অধ্যাপনা করা কালীন জীবনানন্দের বিবাহ হয় লাবণ্যদেবীর সঙ্গে । এরপর ১৯৩৫ খ্রিঃ বরিশালে ব্রজমােহন কলেজে চাকরি পেলেন জীবনানন্দ । এখানে একনাগাড়ে তের বছর অধ্যাপনা করেন । সিটি কলেজে অধ্যাপনার কালে তার কাব্যগ্রন্থ ‘ ঝরা পালক ’ প্রকাশিত হয়েছিল । এখন প্রকাশিত হল ‘ ধূসর পাণ্ডুলিপি ‘ ।
অধ্যাপক হিসেবে জীবনানন্দ জনপ্রিয় ছিলেন না । তার লাজুক ও শান্ত স্বভাব সকলের কাছ থেকে তাকে ক্রমশ আড়াল করে তুলেছিল । সহকর্মরা কেউ কেউ মনে করতেন , তিনি অসামাজিক ও বিরক্তিকর । কলেজের যত নীরস এবং কঠিন বই । পড়ানাের দায়িত্ব কৌশল করে দেওয়া হয়েছিল তাকে । ফলে , তাকে খুব গুরুগম্ভীর বিষয় গুরুগম্ভীর ভাবে পড়াতে হতাে । কলেজের কুটিল সহকর্মীদের সঙ্গে তার হৃদ্যতার সম্পর্ক ছিল না । তারা জীবনানন্দকে কবিতার উদ্ধৃতি সহযােগে পরিহাস করতেন । অধ্যাপক হেরম্ভ চক্রবর্তী তার পিছনে বেশি লাগতেন । নীল জলে সিঙিমাছ ’ নামে একটি ব্যঙ্গ কবিতা লিখে তিনি জীবনানন্দকে আক্রমণ করেছিলেন । বরিশালের তৎকালীন মহকুমা শাসক অবনীমােহন কুশারী একবার জীবনানন্দকে ও হেরম্ভ চক্রবর্তীকে নিয়ে নৌকায় মফঃস্বল সফরে গিয়েছিলেন । জীবনানন্দের মানসিক সঙ্গতির সঙ্গে সেই ভ্রমণ বেশ খাপ খেয়ে গিয়েছিল । কিন্তু অবনীমােহন জীবনানন্দের কবিতার একটি পংক্তি , ‘ দেখনি কি উড়ে গেল প্রান্তরের কাক ? ’ বারবার আবৃত্তি করে বিড়ম্বিত করেছিলেন । সুতরাং জীবনানন্দের স্বস্তি কোথায় ?
১৯৪৭ খ্রিঃ দেশ বিভাগ হলে একসময় ব্রজমােহন কলেজ ছেড়ে দিয়ে তিনি কলকাতায় চলে আসেন । কলকাতায় ‘ স্বরাজ ’ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে কিছুদিন কাজ করেন । পরে ১৯৫১ খ্রিঃ খড়গপুর কলেজে অধ্যাপনা এবং ১৯৫৩ খ্রিঃ হাওড়া গালর্স কলেজে অধ্যাপনা করেন । এরপর ১৯৫৪ খ্রিঃ চাকরি থেকে অবসর নেন ।
জীবনানন্দের আরও প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ — ‘ বনলতা সেন ’ , ‘ মহাপৃথিবী ’ , ‘ সাতটি তারার তিমির ’ ‘ বনলতা সেন ‘ কাব্যগ্রন্থটি তাকে পরম খ্যাতি এনে দিয়েছিল । নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্র সাহিত্য সম্মেলন ‘ বনলতা সেন ‘ কাব্যগ্রন্থের জন্য ‘ রবীন্দ্র পুরস্কার ’ প্রদান করেন । তার মৃত্যু – বছরে প্রকাশিত হয়েছে ‘ শ্রেষ্ঠ কবিতা ।
১৯৫৪ খ্রিঃ ১৪ অক্টোবর । সেদিন জীবনানন্দ অসুস্থ শরীরে রােজকার অভ্যাস মত বৈকালিক ভ্রমণে বেরিয়ে ছিলেন । একা একা ঘুরতে ঘুরতে লেকমার্কেট থেকে দুটো ডাব কিনে বাড়ির দিকে ফিরছিলেন । তখন সময় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা । জীবনানন্দ রাসবিহারীর দক্ষিণ দিকের ফুটপাথে রাস্তা পেরিয়ে ট্রাম লাইনের কাছাকাছি এসে দাড়ালেন । দেখলেন , একটা ট্রাম আসছে । ভাবলেন , সামনের স্টপে ট্রামটা দাড়াবে । অন্যমনস্ক ভাবে কোনােদিক ভুক্ষেপ না করে তিনি রাস্তা পেরােতে গেলেন । হঠাই ঘটে গেল দুর্ঘটনা । ট্রামের ক্যাচারের মধ্যে সবুজ ঘাসের ওপর পড়ে রয়েছে দূর্ঘটনাগ্রস্ত তার পিষ্ট ক্লান্ত প্রাণ । ২২ অক্টোবর রাত এগারােটা চৌত্রিশ , শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে । বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশের জীবনাবসান হয় ।
❤ ‘ আমার কাব্যপ্রেরণার উৎস নিরবধি কাল ও ধূসর প্রকৃতির চেতনার ভিতরে রয়েছে বলেই তাে মনে করি । তবে সে প্রকৃতি সব সময়েই যে ধূসর তা নয় । মহাবিশ্ব – লােকের ইশারা থেকে উৎসারিত সময় চেতনা , Consciousness of time as a univer sal , তা আমার কাব্যে একটি সঙ্গীত সাধক অপরিহার্য সত্যের মত ।
— জীবনানন্দ দাশ
❤ ‘ সকলেই কবি নয় , কেউ কেউ কবি ।’
— জীবনানন্দ দাশ”