“ছেলেটির নাম দুখু মিয়া । দুখু মিয়া নাম রেখেছে তার গরীব বাবা । মায়ের অনেক দুঃখ ও শােকের মধ্যেই তার জন্ম । কেননা , আগে তার চার চারটে ভাই জন্মেছে ও মরেছে ।
গরীব ঘরে অনেক কষ্টের মধ্যে দুখু মিয়া দুমুঠো খেয়ে পরে কোনাে রকমে প্রতিপালিত হচ্ছিল । হঠাৎ তার বাবা মারা যেতে সে দিশাহারা হয়ে পড়ল । তখন তার বয়স নয় । কি করা যায় ? ঢুকে গেল বাসুদেব কবিয়ালের দলে । বাসুদেব সে অঞ্চলে একজন বিখ্যাত কবিয়াল । নানা জায়গায় বেশ সুনামের সঙ্গে গান করে বেড়াচ্ছে । সেই দলে ঢুকে ছেলেটি কখন নতুন নতুন গান রচনা করে , কখনও বা আসরে ঢােলক বাজিয়ে গান করে । ঢােলকের বােল তােলে ও তা গুড়গুড় তাগ গুড়গুড় গুড় …।
একদিন শীতের রাত । রেল লাইনের পাশে আসর বসেছিল । সেদিন আসরে ঢােলক বাজিয়ে সুন্দর গলায় গান গেয়ে মাত করছিল ছেলেটি । শ্রোতাদের মধ্যে ছিল একজন বাঙালি খ্রিস্টান গার্ড সাহেব । মুগ্ধ হয়ে গেল ছেলেটির গান শুনে । আড়ালে তাকে ডেকে গার্ড সাহেব বােঝাল , “ কিরে ছেলে , যাবি আমার বাড়ি ? বাবুর্চির কাজ করবি ? আরামে থাকবি । খাবিদাবি । মাইনেও পাবি ।
ছেলেটি তারপর কবিয়ালের দল ছেড়ে চলে গেল গার্ড সাহেবের বাড়ি । গার্ড সাহেব মদ্যপ । যখন তখন মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরে । তার মুখ দিয়ে বেরােয় অশ্রাব্য কথা তাই কাজ ছেড়ে দিল ছেলেটি । কাজ ছেড়ে একটা চা – রুটির দোকানে কাজ নিল । মাসিক বেতন এক টাকা । রুটির দোকানে তাকে খুবই পরিশ্রম করতে হত । গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে যেত । তারপর দোকান – লাগােয়া একটা তিনতলা বাড়ির সিঁড়ির তলায় তার বিছানা পেতে ঘুম দিত । এভাবেই চলছিল ।
এই তিনতলা বাড়িতে ভাড়া থাকত এক পুলিশ সাব – ইন্সপেক্টর । ছেলেটির গানের গলা সে ভদ্রলােক শুনেছে । তাই ছেলেটির প্রতি স্নেহে নিজের গৃহভৃত্যের কাজ দিল । মাসিক বেতন পাঁচ টাকা । ক্রমে ছেলেটিকে ভদ্রলােক ও ভদ্রলােকের স্ত্রী দুজনেই খুব ভালবেসে ফেলল । ছেলেটিও স্নেহের আবদারে তার পড়াশােনার বন্দোবস্ত করার অনুরােধ জানাল । তারাও রাজি হয়ে তাদের গ্রামের বাড়িতে একদিন পাঠিয়ে দিল ছেলেটিকে । সেখানে সে স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হলাে ।
এই ছেলেটি খুব মেধাবী । স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হয়ে অষ্টম শ্রেণিতে উঠল । শুধু তাই নয় , স্কুলের বিচিত্রানুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের ‘ দুই বিঘা জমি ’ ও ‘ পুরাতন ভৃত্য ’ আবৃত্তি করে সকলের তাক লাগিয়ে দিল । ছেলেটির কোনাে বন্ধু – বান্ধব ছিল না বরং কিছু বখাটে ছেলে তাকে জ্বালাতন করত । তাই প্রায়ই গ্রামের এক বিলের ধারে একটা বটগাছের নিচে এসে একা একা সে আপন মনে বাঁশি বাজাত ।
একদিন ছেলেটি কাউকে কিছু না জানিয়ে চুপি চুপি চলে এলাে তার নিজের গ্রামে । অনেক চেষ্টায় ভর্তি হলাে আবার গ্রাম থেকে বেশি কিছু দূরের এক ভালাে হাই স্কুলে । পড়াশােনা বেশ চলছিল । এলাে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ । তখন ছেলেটি দশম শ্রেণির ছাত্র । প্রি টেস্ট পরীক্ষা চলছে । ক্লাসের ফার্স্ট বয় সে । তবু সিদ্ধান্ত নিল যুদ্ধে যােগ দেবে । তাই চুপি চুপি পালিয়ে গেল সােজা কলকাতায় । সেখানে সৈন্যদলে ভর্তির পরীক্ষায় টিকে গেল ছেলেটি । সাত হাজার সৈনিক নিয়ে গঠিত হয়েছিল ৪৯ নং বাঙালি পল্টন । ছেলেটি সেই পল্টনে ১৯১৭ সালে যােগদান করে সরাসরি ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ থেকে ট্রেনিং এর জন্য ট্রেনযােগে লাহাের হয়ে নওশেরায় চলে গেল । সেখান থেকে তিন মাস ট্রেনিং নিয়ে গেল করাচি সেনা নিবাসে । তারপর কৃতিত্ব দেখিয়ে সেই ছেলেটি বাঙালি পল্টনের হাবিলদার হয়ে গেল ।
কে এই ছেলেটি ? কে এই দুখু মিয়া ? ছেলেটির নাম কাজী নজরুল ইসলাম । পিতার নাম কাজী ফকির আহম্মদ ও মাতার নাম বেগম জাহেদা খাতুন । ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে ২৪ শে মে বর্ধমান জেলার আসানসােল মহকুমার জামুরিয়া থানার চুরুলিয়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন ।
১৯২০ খ্রিঃ মার্চ মাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর ৪৯ নং বাঙালি পল্টন ভেঙে দেওয়া হলে নজরুল করাচি থেকে কলকাতায় চলে আসেন । কিন্তু তার এক বছর আগে থেকেই কলকাতার সাহিত্য পত্রিকায় তার ডাকযােগে পাঠানাে গল্প – কবিতা প্রকাশিত হচ্ছে । প্রকাশিত গল্পের নাম ‘ বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী এবং কবিতার নাম ‘ মুক্তি ’ । এক বছর পর প্রকাশিত হয় তার বিদ্রোহী ’ কবিতাটি । বংলা সাহিত্য জগতে একটা হৈ চৈ পড়ে যায় এই কবিতা ও এই কবিকে নিয়ে । তিনি তখন থেকে ‘ বিদ্রোহী ’ কবি হিসাবে পরিচিত হলেন ।
কাজী নজরুল ইসলামের অনেক অনেক কাব্যগ্রন্থ । অগ্নি – বীণা , বিষের বাঁশী , ভাঙার গান , প্রলয় শিখা , ছায়ানট , সাম্যবাদী , সর্বহারা , ফণি – মনসা প্রভৃতি । এছাড়া আছে তার অনুবাদ কাব্য , গল্পগ্রন্থ , উপন্যাস , প্রবন্ধ সংগ্রহ , নাটক – নাটিকা এবং নজরুল – গীতি সংগ্রহ ।
কবি বাজিয়েছেন অগ্নিবীণা ও বিষের বাশী । তিনি গান করেছেন ভাঙার গান । বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৪২ সালে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন । তিনি হলেন বােধশক্তিহীন ও মূক । কেবল বােবা চাহনিতে চেয়ে থাকেন । নজরুলকে উন্নততর চিকিৎসার জন্য ১৯৫৩ সালে ইউরােপে পাঠানাে হল । কিন্তু অবস্থার কোনাে উন্নতি হল না । তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হল । ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে নাগরিকত্ব দিয়ে একসময় নিয়ে গেল ঢাকা শহরে । সেখানে ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের জীবনাবসান ঘটে ।
❤ “ হিন্দু না ওরা মুসলিম ? ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন ? কাণ্ডারী ! বলল , ডুবিছে মানুষ , সন্তান মাের মার ! ”
— নজরুল ইসলাম
❤ ‘ ভুল হয়ে গেছে বিলকুল
আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে
ভাগ হয়নিকো নজরুল ।’
— অন্নদাশঙ্কর রায়”