“ছেলেটি কলকাতার ছেলে । তার বাবা যজমানি করেন। আয় বলতে পুজো আচ্চা থেকে যৎসামান্য। তার একটা বইয়ের দোকান অবশ্য কলেজ স্ট্রিটে। তার থেকে আর কতটুকুই বা আয়!
ছেলেটির মা তার ছোট অবস্থাতে মারা যান ক্যান্সারে। অভাব অনটন ও অযত্নের ছড়াছড়ি তার চারপাশে। তার এক বন্ধুর মায়ের স্নেহ এবং জেঠামশাই এর আদরে এক রকম মানুষ হতে থাকে ছেলেটি।
বেলেঘাটার স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয় কমলা বিদ্যামন্দির এই ছেলেটির বিদ্যাশিক্ষার শুরু। ওই ছোট বয়সেই সে ছড়া কবিতা লিখত। চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময় স্কুলের হাতের লেখা পত্রিকায় তার ছড়া ও গল্প প্রকাশিত হয়েছিল। লেখাগুলো ছিল বেশ মানের। সেই লেখা পড়ে শিক্ষক মশাইরা তাকে সুখ্যাতি করিয়েছিল। 9- 10 বছর বয়সে ভালো ছড়া লিখতে পারতো বলে তার বাড়ির সকলেই বুঝে গিয়েছিলেন এ ছেড়ে খুব শীঘ্রই একজন বড় কবি হয়ে উঠবে।
এরপর সেই ছেলেটি ভর্তি হল বেলেঘাটা দেশবন্ধু হাই স্কুলে। যখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র, স্কুলের দেয়াল পত্রিকা ‘সপ্তমীকা’ পত্রিকার সম্পাদক। তার ওপর লেখা প্রকাশ করার দায়িত্বভার। ছেলেটি 1945 খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে ওই স্কুল থেকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হল। ঠিক তার পরের বছর ধরা পরল তার শরীরের ক্ষয় রোগ।
মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকে। অক্ষম দেহ নিয়েও অক্লান্তভাবে তবু তার কবিতা লেখার বিরাম নেই। অল্প বয়সেই কৃষাণ -মজুর -শ্রমিকদের যন্ত্রণার শরিক। তাঁরই উদ্যোগে বাংলাদেশের নানাপ্রান্তে কিশোর বাহিনী নামে কিশোর সংগঠন তৈরি হয়েছে। সেই সময়কার ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকার ‘কিশোর সভা’ বিভাগের সম্পাদনার দায়িত্বভার তার উপর ন্যস্ত।
কে এই ছেলেটি ? মার্কসবাদী চিন্তাধারায় ভাবিত । শ্রমিক – কৃষক – মজদুরের যন্ত্রণার শরিক । শরীরে ক্ষয় রােগ নিয়েও এই বিশ্বাসের ভূমি থেকে এক মুহূর্ত নিশ্ৰুপ থাকেনি ।
ছেলেটির নাম সুকান্ত । কিশাের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য । তাঁর জন্ম ১৯২৬ খ্রিঃ ১৬ আগস্ট ( বাংলা ১৩৩৩ সালের ৩০ শে শ্রাবণ ) কলকাতার কালীঘাটে ৪১ মহিম হালদার স্ট্রিটে মাতামহ সতীশচন্দ্র ভট্টাচার্যের বাড়িতে । পিতার নাম নিবারণচন্দ্র ভট্টাচার্য । মাতার নাম সুনীতি দেবী । তিনি ছিলেন পিতামাতার দ্বিতীয় সন্তান । তার পৈতৃক নিবাস ছিল বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার কোটালিপাড়া । পূর্বপুরুষরা ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় আসেন এবং বেলেঘাটা অঞ্চলে বসবাস করেন । সুকান্ত সাধারণ মানুষের দুঃখক্লিষ্ট জীবনকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছেন । তার ফলে সমাজবাদ ও সাম্যবাদের একনিষ্ঠ সৈনিক হয়ে উঠতে পেরেছেন । তার তেরাে বছর বয়সে শুরু হয়ে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি । তিনি দেখেছেন বিয়াল্লিশের আগস্ট আন্দোলন , ছেচল্লিশের নৌ বিদ্রোহ এবং হিন্দু – মুসলমান রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা ।
এই কিশাের কবি এসব নিয়ে কবিতা লিখেছেন । ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার চরম অর্থনৈতিক সংকট তার লেখার ছাপ ফেলেছে । ধনী ও দরিদ্রের পার্থক্য তাকে অত্যন্ত পীড়া দিয়েছে । তার সুস্পষ্ট প্রশ্ন –
‘ বলতে পার বড়মানুষ মােটর কেন চড়বে ? গরীব কেন সেই ‘ মােটরের তলায় চাপা পড়বে ? ’
….. গরীব মানুষের জন্য তার এইজাতীয় বেদনাবােধ ক’জন কবির মনে প্রকট হয়ে ওঠে ? ক’জন সােচ্চার হতে পারেন দরিদ্র সাধারণ মানুষের জন্য ? অথচ সুকান্তই তার কৈশােরে এই সব ‘ হিং – টিং – ছট ’ প্রশ্নের কামড়ে অহরহ অতিষ্ট হয়ে বেড়িয়েছেন ।
সুকান্তর কাব্যগ্রন্থ — ছাড়পত্র , ঘুম নেই , পূর্বভাস , মিঠে – কড়া , অভিযান , হরতাল , গীতিগুচ্ছ প্রভৃতি । কবি সুকান্ত রাজনীতির এক মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন বলেই সেই আদর্শের প্রতি ছিল তার নিষ্ঠা । সেজন্য কিছু মানুষ তার কবিতাকে বিদ্বেষবশত রাজনীতির স্লোগান বলে প্রচার করতে চান । তার উত্তরে অগ্রজ কবি সুভাষ মুখােপাধ্যায় । বলেছেন— “ কবিতার জাত যাবার ভয়ে স্লোগানগুলােকে রেখে ঢেকে সে ব্যবহার করেনি । হাজার হাজার কণ্ঠে ধ্বনিত – প্রতিধ্বনিত যে ভাষা হাজার হাজার মানুষের নানা আবেগের তরঙ্গ তুলেছে , তাকে কবিতায় সাদরে গ্রহণ করতে পেরেছিলেন বলেই সুকান্ত সার্থক কবি ।
এই কবি চোখে দেখে যেতে পারেননি স্বাধীনতার নবােদিত সূর্যকে । তখনও স্বাধীনতার কয়েক মাস বাকি । তিনি যাদবপুর যক্ষ্মা হাসপাতালে একটি কক্ষে শয্যাশায়ী । মাত্র ২১ বছর বয়সে কবিকৃতির বিপুল সম্ভাবনার সূচনা পর্বে ১২ মে ১৯৪৭ খ্রিঃ তার জীবন দীপ নির্বাপিত হয় ।
❤ ‘ পূণিমার চাঁদ যেন ঝলসানাে রুটি ।’
— সুকান্ত ভট্টাচার্য
❤ এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযােগ্য করে যাব আমি নব জাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার ।
— সুকান্ত ভট্টাচার্য”