সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ

” গোঁড়া তেলেগু ব্রাম্মণ পরিবারের ছেলে । নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে অভাব নিত্যসঙ্গী । স্বচ্ছলতা বলতে কী বােঝায় তা সে জানে না । গরীব ঘরের বাবা – মায়েরা তাদের ছেলেমেয়েদের প্রতি পড়াশােনায় সাধারণত উদাসীন হয়ে থাকে । কিন্তু এই ছেলেটির ক্ষেত্রে তা হয়নি । বাবা – মায়েরা চেয়েছিলেন , দুবেলা দুমুঠো খেয়ে যেমন করে হােক ছেলেটিকে পড়াশােনা করিয়ে মানুষ করতে হবে । আর ছেলেটিরও আগ্রহ ছিল পড়াশােনার প্রতি ।

 

 

 গোড়া ব্রাক্ষ্মণ পরিবারের মা – বাবা ঐতিহ্যগতভাবে ধর্মবিশ্বাসী । তাই ছেলেটি ছােটো থেকেই হিন্দুধর্মের বিভিন্ন রীতিনীতিকে নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলত । ভর্তি হয়েছিল । খ্রিস্টান মিশনারী বিদ্যালয়ে । যখন তার বয়স আট বছর তখন সে ভর্তি হলাে তিরুপতি শহরের লুথেরান মিশন হাইস্কুলে । পাঁচ বছর পড়ার পর সে এলাে ভেলাের কলেজে এবং তারপর মাদ্রাজ খ্রিস্টান কলেজে । পড়াশােনা চলাকালীন ছেলেটি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে সবকিছুকে বিচার – বিবেচনা করতে শিখেছিল । তাই বুঝেছিল , জীবনের সবকিছু চাওয়া – পাওয়ার সঙ্গে ধার্মিক অনুশাসন । একাত্ম হয়ে আছে । 

 

 

ছেলেটি মাদ্রাজ খ্রিস্টান কলেজের ছাত্র হিসেবে বেশ কৃতিত্বের সঙ্গে বি.এ. পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হল । মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত ছাত্রের মধ্যে সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করল । তার খাতা দেখে বিদধ অধ্যাপকরা অবাক । ছেলেটি এমন সুন্দরভাবে দার্শনিক অভিজ্ঞতাগুলি বিশ্লেষণ করতে পারে , তা তারা ভাবতেও পারেননি । এমন অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য সেই ছেলেটির হাতে তারা ‘ ডক্টর স্যামুয়েল সথিয়ানাথন’ স্বর্ণপদক তুলে দিলেন । 

 

 

ছেলেটি কলেজের মিশনারী আবহাওয়ার মধ্যে মানুষ হয়েছিল বলেই বাইবেল সম্পর্কেও তার স্বভাবতই আগ্রহ ছিল । তাছাড়া খ্রিস্টান মিশনারী অধ্যাপকরা অকারণে ভারতীয় হিন্দুশাস্ত্রকে অবমাননা করলে , ছেলেটি খুব কষ্ট পেত । শান্ত মৃদুভাষী ছেলেটি প্রতিবাদী না হয়ে বরং সত্যি সত্যি বুঝতে চেষ্টা করত কেন খ্রিস্টান মিশনারীরা হিন্দু ধর্মকে ‘ অসাড় ’ ও ‘ মানুষের সঙ্গে যােগশূন্য ’ বলে ঘােষণা করছে ! একি সত্যি , না তাদের ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ ? এই কৌতূহলবশে ছেলেটি দুটি ধর্মের দর্শনের প্রতি এক অনুভবী পাঠক হয়ে উঠল । একদিকে বাইবেল আর অন্যদিকে হিন্দুশাস্ত্র পাঠ করতে থাকল ।

 

ছেলেটির বয়স তখন মাত্র কুড়ি বছর । ছেলেটি মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ. পরীক্ষার্থী । সে সময় এই পরীক্ষার অন্যান্য উত্তরপত্রের সঙ্গে একটি মৌলিক প্রবন্ধ রচনার বিধান ছিল । ছেলেটি সেই সুযােগ নিয়ে ‘ বেদান্তে নীতিধর্মের থান ’ নামে মৌলিক গবেষণাপত্র জমা দিল ।

 

 

 মাদ্রাজ খ্রিস্টান কলেজের অধ্যক্ষ এই প্রবন্ধের প্রধান পরীক্ষক ছিলেন । তিনি রাগান্বিত না হয়ে মুগ্ধ হলেন । হিন্দু ধর্মে নৈতিকতার কোনাে স্থান নেই , তাদের এই ধারণাকে নস্যাৎ করে ছেলেটি যে যুক্তিজালের অবতারণা করেছে , তাতে তারা বিস্মিত হয়ে পারেননি । তারা ছেলেটিকে অকুণ্ঠচিত্তে সাধুবাদ জানান । সেই বছরেই সেই মৌলিক প্রবন্ধটি মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা বিভাগ থেকে প্রকাশিত হয় ।

 

 

 একুশ বছরে ( ১৯০৯ খ্রিঃ ) ছেলেটি এম . এ . পাশ করল । সে বছরই মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার সুযােগ পেয়ে অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী সেই ছেলেটি অধ্যাপনা শুরু করল ।

 

 

মৃ নি কে সেই ছেলেটি ? এক দিকে মেধা ও অন্য দিকে হিন্দু দর্শনের ওপর অধিকার ? ছেলেটির নাম সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ । জন্ম ১৮৮৮ খ্রিঃ ৫ ই সেপ্টেম্বর তামিলনাড়ুর তিরুনি নামে এক ছােট্ট শহরে নিম্ন মধ্যবিত্ত গোঁড়া তেলেগু ব্রাম্মণ পরিবারে । শহরটি তদানীন্তন মাদ্রাজ বা বর্তমানের চেন্নাইয়ের কাছে । 

 

 

রাধাকৃষ্ণুণ মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা করেছিলেন সাত বছর । অধ্যাপনা করার সময় তিনি মাঝে মধ্যেই উপনিষদ , গীতা , ব্ৰত্মসূত্র প্রভৃতি প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্র থেকে অসংখ্য উদ্ধৃতি তুলে ধরতেন । অধিকাংশ ছাত্র তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করত । তাতে তিনি বুঝতে পারতেন , তরুণতর প্রজন্ম প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্র সম্পর্কে অনাগ্রহী নয় । 

 

 

১৯২১ খ্রিঃ বাংলার বাঘ আশুতােষ মুখােপাধ্যায়ের আমন্ত্রণে রাধাকৃষ্ণুণ এলেন কলকাতায় । এখানে এসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পঞ্চম জর্জের নামাঙ্কিত দর্শন বিভাগের অধ্যাপক পদে বৃত হন । তার অসাধারণ বিশ্লেষণী ক্ষমতায় তিনি হিন্দুধর্মের নানা বিষয়কে ছাত্রদের সামনে উপস্থাপিত করেছেন । ছাত্ররা মন্ত্রমুগ্ধের মতাে সেই সব ভাষণ শুনে বিস্মিত হয়েছে ।

 

 

১৯২৯ খ্রিঃ ম্যানচেস্টার কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসার ইস্টলিউ কারপেন্টার সাহেব পদত্যাগ করলে , সেই পদে যােগদান করার আহ্বান পেয়ে তিনি অধ্যক্ষ হন । ১৯৩৬ খ্রিঃ থেকে ১৯৩৯ খ্রিঃ পর্যন্ত রাধাকৃয়ণ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন । 

 

 

দীর্ঘ দুশাে বছরের পরাধীনতার অবসানে ভারত ঈপ্সিত স্বাধীনতা অর্জন করলে , দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু । তার সঙ্গে রাধাকৃষ্ণণের ছিল মধুর সম্পর্ক । জওহরলালের ব্যক্তিগত উৎসাহে রাধাকৃষ্ণণ হলেন সােভিয়েত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত । তিনি এভাবে জড়িয়ে পড়লেন রাজনীতির সঙ্গে ।

 

 

 

 রাধাকৃষ্ণণ ১৯৫২ খ্রিঃ ভারতের উপ – রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হলেন । ১৯৫৭ খ্রিঃ তিনি আবার উপ – রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন । উপ – রাষ্ট্রপতি হিসাবে তিনি নানা দেশ পরিভ্রমণ করেছেন এবং অনেক ভাষণও দিয়েছেন । দেশের মর্যাদা রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে তার মানবদরদী মনের পরিচয় তুলে ধরেছেন ।

 

 

 ১৯৬২ খ্রিঃ তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত হন । ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ হলেন ভারতীয় গণতন্ত্রের মহান ধারক ও বাহক । ভারতের সম্মানীয় প্রথম নাগরিক । রাষ্ট্রপতি হিসাবে রাধাকৃষ্ণণের শাসনকালে কিছুদিনের ব্যবধানে ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু ঘটে । প্রথমে জওহরলাল নেহেরু এবং তারপর লালবাহাদুর শাস্ত্রী । এই দুই নেতার মৃত্যু ভারতের রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি করেছিল । সেই পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতির অনেক সিদ্ধান্তের ওপরেই ভারতের ভবিষ্যৎ অনেকাংশে নির্ভর করছিল । তিনি সেই সংকটকালে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে কি আভ্যন্তরীণ কি বৈদেশিক সর্বক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির যথাযথ কাজ সম্পাদন করেছেন ।

 

 তিনি ১৯৫৪ খ্রিঃ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ‘ ভারতরত্ন ’ পেয়েছেন । তার জন্মদিনটি ৫ ই সেপ্টেম্বর ভারতবাসী ‘ জাতীয় শিক্ষক দিবস ‘ হিসাবে পালন করে । 

 

 

এই দার্শনিক রাধাকৃষ্ণণ , এই রাজনীতিক রাধাকৃয়ণ , এই মনীষী রাধাকৃয়ণের মহাপ্রয়ান ঘটে ১৯৭৫ খ্রিঃ ১৬ ই এপ্রিল ।

 

 

❤ ‘ ক্ষুদ্রাদিক্ষুদ্র বস্তু থেকে বৃহত্তম বস্তু , সবই হল বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা মগ্ন চৈতন্যের অংশ মাত্র ।’

                            — সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ 

 

 

❤ ‘ আমরা যদি সত্যি সত্যি স্বদেশ ভক্ত হতে চাই , তাহলে আমাদের আনুগত্যকে গােষ্ঠীগত , বংশগত বা জাতিগত করে রাখলে চলবে । আমাদের আনুগত্য হবে মানবিক । 

    

                              — সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ”

Related posts:

পদার্থ কাকে বলে ? পদার্থ ও বস্তু কি এক ?
প্রশ্ন : মূল্যায়ন কাকে বলে ? মূল্যায়ন কয় প্রকার ও কী কী ? যে - কোনো একপ্রকার মূল্যায়নের বিবরণ দি...
একক পাঠ পরিকল্পনা কাকে বলে ? পাঠ পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা লিখুন । এর সুবিধা লিখুন ।
শিক্ষা পরিকল্পনা কাকে বলে ? শিক্ষা পরিকল্পনার শ্রেণিবিভাগ করুন । যেকোনো একপ্রকার পরিকল্পনার বিবরণ দি...
ধারণা মানচিত্র কাকে বলে ? এর বৈশিষ্ট্য লিখুন । বাস্তবায়নের উপায় লিখুন । এর গুরুত্ব লিখুন ।
পাঠ একক বিশ্লেষণ কাকে বলে ? পাঠ একক বিশ্লেষণের স্তর বা ধাপগুলি লিখুন
অন্তর্ভুক্তিকরণে ( সমন্বিত শিখনে ) প্রদর্শিত শিল্পকলার কীভাবে প্রয়োগ করবেন
প্রদর্শিত শিল্পকলার লক্ষ্য , বৈশিষ্ট্য , গুরুত্ব ও বাস্তবায়নের কৌশল
প্রাথমিক স্তরে পাঠদানের ক্ষেত্রে নাটকের ব্যবহার
মূল্যবোধ শিক্ষায় বিদ্যালয় ও শিক্ষকের ভূমিকা
মূল্যবোধ || মূল্যবোধের বৈশিষ্ট্য || প্রাথমিক স্তরে মূল্যবোধের শিক্ষার গুরুত্ব
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের শিক্ষায় তথ্য ও সংযোগসাধন প্রযুক্তির ভূমিকা
সমন্বয়িত শিক্ষণে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের সমস্যা ও সাফল্য
পাঠক্রম পরিব্যাপ্ত শিক্ষণবিজ্ঞানে তথ্য ও সংযোগসাধন প্রযুক্তির ব্যবহার
পাঠক্রম পরিব্যাপ্ত শিক্ষণবিজ্ঞানে তথ্য ও সংযোগসাধন প্রযুক্তির ব্যবহার
উদাহরণসহ প্রকল্প পদ্ধতির বিবরণ
পূর্বসূত্রজনিত শিখন ( Contextualization ) কাকে বলে ?
জ্ঞান , পাঠক্রম , পাঠ্যবই , শিক্ষার্থী ও শিক্ষণবিজ্ঞানের মধ্যের সম্পর্ক
অনুসন্ধান পদ্ধতি
জ্ঞান নির্মাণ কীভাবে হয় উদাহরণসহ আলোচনা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page