“গ্রীষ্মকালের দুপুরবেলা । শােবার ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করা । খড়খড়ির ফাক দিয়ে আলাে এসে পড়েছে বিপরীত দিকের দেওয়ালে । সেখানে ফুটে উঠেছে রাস্তার উলটো ছবি । রিক্সা , সাইকেল ও পথচারীর চলমান ছবি দেওয়ালের গায় । ছেলেটির বয়স ছয় । সে ঘরের মধ্যে শুয়ে শুয়ে দুপুরবেলা এসব নিয়মিত দেখে উল্লাসিত হয়ে ওঠে । এ যেন বিনে পয়সায় বায়স্কোপ দেখা ।
তাদের সদর দরজায় একটা ছােট্ট ফুটো ছিল । বন্ধ দরজার সেই ফুটোর সামনে ঘষা কাচের একটি টুকরাে ধরত ছেলেটি । কাচের ওপর খুদে খুদে আকারের উল্টো ছবি ভেসে উঠত । ছেলেটি তা দেখে মজা পেত । ফুটো দিয়ে বেরিয়ে আসা এই উল্টো ছবি তাে ফটোগ্রাফির গােড়ার কথা । ঘটনাচক্রে এই ছেলেটির এটি একটি আশ্চর্য পাওনা । ছেলেটি সাড়ে আট বছর বয়সে ভর্তি হয়ে গেল স্কুলে । সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন তাকে তার লেবুমামা । লেবুমামা তার মা – র মাসতুতাে ভাই । স্কুলের নাম বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাইস্কুল । ক্লাসের মাস্টার কয়েকটি প্রশ্ন ও কয়েকটি অঙ্ক দিলেন করতে । কিছু পরে ছেলেটি সেগুলি করে নিয়ে গেল তার কাছে । মাস্টারমশায় তখন ইংরেজির ক্লাস নিচ্ছিলেন । খাতাটি দেখে মাথা নাড়লেন । অর্থাৎ ঠিক আছে । ক্লাসে ভর্তি হতে পারবে সে । মাস্টারের কাছ থেকে যখন ছেলেটি খাতা ফেরত নিচ্ছে , সে সময় ক্লাসের একটা ছেলে তার নাম জানতে চাইল । সে উত্তর দিতেই আবার প্রশ্ন , ‘ না , না , ডাকনাম । ছেলেটি তার ডাকনাম সরল মনে জানাল । ভর্তি হয়ে গেল ছেলেটি ক্লাস সিক্সে । ভর্তির দিন থেকে স্কুলের সব ছেলেই তাকে ডাকনামে ডাকত মানিক ।
ছেলেটি একদিন সবাক ছবি দেখতে গেল এই লেবুমামার সঙ্গে গ্লোব সিনেমা হলে । তখন সবে সবাক ছবি এসেছে কলকাতায় । যে ছবিটি গ্লোরে দেখান হচ্ছে তার নাম ‘ টার্জান দি এ ম্যান ’ । কিন্তু টিকিন না পেতেই রিগ্যাল সিনেমা হলের টিকিট কাটল । সেটি বাংলা ছবি , তাও আবার সবাক নয় । তাই সই । বইটির নাম ‘ কাল পরিণয় । বইটি ছােটোদের উপযােগী ছিল না আদৌ । ছেলেটির তা ভাল লাগছিল না । মামা তা বুঝতে পেরে মাঝ পথে জিজ্ঞেস করলেন , কিরে বাড়ি যাবি ? ছেলেটি সে কথায় কান দিল না । একবার ঢুকেছে যখন , শেষ না করে বেরুবে কেন ? বাংলা সিনেমার ওপর একটা বিরূপ ধারণা মনে রাখল অনেক দিন ছেলেটি ।
এই ছেলেটির বয়স যখন দশ বছর , শান্তিনিকেতনে পৌষমেলায় বেড়াতে গিয়েছে । মায়ের সঙ্গে । সঙ্গে একটা নতুন অটোগ্রাফের খাতা । ছেলেটির খুবই ইচ্ছা হলাে । রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে কবিতা লিখিয়ে নেবে তার প্রথম পাতায় । ভারি মজা । যথারীতি মাকে নিয়ে ছেলেটি গেল উত্তরায়ণে রবীন্দ্রনাথের কাছে । জানালাে তার ইচ্ছার কথা । রবীন্দ্রনাথ অরাজি নন । পরের দিন নিয়ে যেতে বলে , খাতা রেখে যেতে বললেন । পরের দিন যেতেই ছেলেটি পেয়ে গেল তার অটোগ্রাফের খাতা । প্রথম পাতাটি সমৃদ্ধ হয়ে গেছে রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতায় । সে কবিতাটি আমরা জানি । কিন্তু সেটি যে সেই ছেলেটির খাতায় লিখে দিয়েছিলেন , তা আমরা অনেকে জানিনা । কবিতাটি হলাে —
‘বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু ।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু ।’
কে এই ছেলেটি ? ছেলেটির নাম সত্যজিৎ রায় । পিতার নাম সুকুমার রায় । মাতার নাম সুপ্রভা রায় । জন্ম ২ মে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ১০০ নম্বর গড়পার রােডে । তিনি পিতা – মাতার একমাত্র সন্তান । তার ডাক নাম মানিক । সত্যজিৎ আড়াই বছর বয়সে তার বাবাকে হারান । ছয়ের কাছাকাছি বয়সে গড়পার বাড়ি ছেড়ে তার মায়ের সঙ্গে ভবানীপুরে বকুলবাগানে মামার বাড়িতে চলে আসেন । আট বছর বয়স অবধি মায়ের কাছে বাড়িতে পড়ে তারপর ভর্তি হন বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে ক্লাস সিক্সে । ওখান থেকেই ১৯৩৬ সালে ম্যাট্রিক পাশ । প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে বি . এ . পাশ করে শান্তিনিকেতনে আড়াই বছর ছবি আঁকার শিক্ষা নেন ।
১৯৪৩ সালে সত্যজিৎ সিগনেট প্লেসে বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণের কাজে নেমে পড়েন । এরপর তিনি এক বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করে এক সময় চিত্রনাট্য রচনায় উৎ সুক হয়ে পড়েন । তার চিত্রনাট্যের উল্লেখযােগ্য ফসল — ‘ ঘরে বাইরে ’ , ‘ পথের পাঁচালী । তার অসাধারণ কাজ পথের পাঁচালীর চিত্রায়ণ । এই ছবি মুক্তি পায় ১৯৫৫ সালে এবং সঙ্গে সঙে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশে ও বিদেশে । এরপর তিনি তার বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একের পর এক বাংলা চলচ্চিত্রের কাজে নেমে পড়েন । অপুর সংসার , পরশপাথর , অপরাজিত , মহানগর , জলসাঘর , কাঞ্চনজঙ্ঘা , চারুলতা , দেবী প্রভৃতি মুক্তি পেতে থাকে ।
১৯৪৯ সালে সত্যজিৎ বিজয়া দাশকে বিবাহ করেন । পিতামহ উপেন্দ্রকিশাের ও পিতা সুকুমার রায়ের সন্দেশ ’ পত্রিকার সম্পাদনার কাজে নেমে পড়ে তিনি আরও আকর্ষণীয় করার লক্ষ্যে এগিয়ে যান । তার লেখা গল্প উপন্যাস শিশু – কিশােরদের কাছে । এক অমূল্য ভাণ্ডার : বাদশাহী আংটি , গ্যাংটকে গণ্ডগােল , সােনার কেল্লা , বাক্স রহস্য , কৈলাসে কেলেঙ্কারি , রয়েল বেঙ্গল রহস্য , জয়বাবা ফেলুনাথ , গােরস্থানে সাবধান , ছিন্নমস্তার অভিশাপ , প্রফেসর শঙ্কুর কাণ্ডকারখানা , মহাসংকটে শঙ্কু , এক ডজন গপপাে , ফটিকচাঁদ প্রভৃতি । তাঁর প্রবন্ধের বই — বিষয় চলচ্চিত্র । চলচ্চিত্রের জন্য ‘ দাদাসাহেব ফালকে ’ পুরস্কারেও সম্মানিত । সম্মানিত ‘ অস্কার পুরস্কারেও । ভারত সরকার তাকে ১৯৯২ সালে ভারতরত্ন ’ সম্মান প্রদান করেছেন ।
১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের জীবনাবসান ঘটে ।
❤ ‘ বাক্সের ভিতর জুলে কেরােসিনের বাতি , তার ধোঁয়া বেরিয়ে যায় চিমনি দিয়ে , আর তার আলাে ঘুরন্ত ফিল্মের চলন্ত ছবি ফেলে দেওয়ালের উপর । কে জানে , আমার ফিল্মের নেশা হয়ত এই ম্যাজিক ল্যানটার্নেই শুরু ।
— সত্যজিৎ রায়
❤ ‘ সাহিত্যের গল্পও যেমন বাক্যের পর বাক্য সাজিয়ে রাখতে হয় , তেমনি সিনেমার গল্পকে খন্ড খন্ড দৃশ্যে ও খন্ড খন্ড শট – এ ভাগ করে সাজিয়ে বলতে হয় ।
— সত্যজিৎ রায়”