শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্য ( Characteristics of Child Centric Education )

“💠 শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্য ( Characteristics of Child Centric Education ) :

🔷 শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য হল—

( 1 ) শিক্ষার্থীর স্বাধীনতা : শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিক্ষার্থী গতানুগতিক শিক্ষার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে তার নিজের ইচ্ছা ও আগ্রহ অনুসারে শিক্ষা গ্রহণ করার স্বাধীনতা পায় । এখানে থাকে না কোনাে বাহ্যিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ এবং বিধিনিষেধের চাপিয়ে দেওয়া বোঝা । শিক্ষার্থী তাই বৈচিত্র্যপূর্ণ পরিবেশে নিজের ইচ্ছা অনুসারে শিকা গ্রহণ করে ।

( 2 ) এই শিক্ষা সক্রিয়তাভিত্তিক : আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতিতে প্রত্যক্ষ কর্মের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীকে হাতেকলমে শেখানাে হয় । সেইজন্য আধুনিক শিক্ষার মূল নীতি হল কাজের মাধ্যমে দিয়ে শিক্ষা । শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিক্ষার এই নীতি অনুকৃত হয় l

( 3 ) ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা ঃ এখানে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিকেন্দ্রিকতায় গুরুত্ব দেওয়া হয় l শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের নিয়মানুযায়ী শিক্ষাপ্রক্রিয়া সংগঠিত হয় । শিক্ষা হল সামাজিক পরিবেশে শিশুর ব্যক্তিসত্তার পূর্ণ বিকাশ ।

( 4 ) অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা : এই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থার পাঠক্রম পৃথিগত , বিমূর্ত এবং পুস্তককেন্দ্রিক নয় । শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত আত্মপ্রকাশের কার্যাবলি এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন অভিজ্ঞতাসমূহকে কেন্দ্র করে শিক্ষার বিষয় নির্দিষ্ট হয় ।

( 5 ) শিক্ষার্থীর সৃজনী স্পৃহাকে চরিতার্থ করে : শিক্ষার্থীর মৌলিকতা , সৃজনশীলতা জন্মগত সূত্রে প্রাপ্ত এবং সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত । শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিশুর এই মৌলিকতা ও সৃজনশীলতা প্রকাশকরণের জন্য বৈচিত্র্যপূর্ণ বিভিন্ন শিক্ষামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় ।

( 6 ) বৃত্তিগত অনুরাগ জাগ্রত করে : শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় ক্ষমতা ও ইচ্ছা অনুযায়ী শিক্ষার্থী শিক্ষালাভের সুযােগ পায় । যার ফলে শিক্ষার্থী পরবর্তী সময়ে সমাজ অগ্রগতিতে নানারূপ ভূমিকা পালন করে । নিজের ক্ষমতা ও আগ্রহ উপলদ্ধি করে ভবিষ্যৎ বৃত্তি সম্পর্কে সচেতন হয় । অর্থাৎ সঠিকভাবে বৃত্তি – আগ্রহ বিকাশ লাভ করে ।

( 7 ) ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে ঃ শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশের পাশাপাশি তার শারীরিক , প্রোক্ষোভিক , সামাজিক ও নৈতিক দিকগুলির সুষম বিকাশের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয় । এর ফলে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিসত্তার পূর্ণ বিকাশ ঘটে ।

( ৪ ) মানবিক সম্পর্কের উন্নয়ন ঃ শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিক্ষক – শিক্ষার্থীর মানবিক সম্পর্কের যথেষ্ট উন্নতি ঘটে । শিক্ষক এখানে কঠোর শৃঙ্খলার নিয়ন্ত্রক নন । তিনি কঠিন টাস্কমাস্টর নন । তিনি শিক্ষার্থীর পিতাসম , বন্ধু , দার্শনিক এবং পথপ্রদর্শক । শিক্ষার্থী এখানে নিজের চেষ্টায় শেখে । শিক্ষক তাকে সাহায্য করেন যেমন যেমন সে সাহায্য প্রত্যাশা করে । কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে , শিক্ষকের দায়িত্ব এখানে কম । শিক্ষক শিক্ষা পরিবেশ তৈরি করেন , সংগঠিত করেন , এবং শিক্ষার্থীর সামনে উপস্থাপন
করেন । তিনি শিক্ষার্থীর আগ্রহ ও সক্রিয়তাকে উদ্দীপিত করেন । তিনি শিক্ষার্থীর একজন সহানুভূতিশীল শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে নিজেকে প্রতিপন্ন করেন ।

( ৪ ) মনােবিদ্যার আদর্শ প্রয়ােগ : শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে মনােবিদার পরীক্ষামূলক তত্ত্ব এবং নীতিগুলি প্রয়ােগ করা হয় । শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার পদ্ধতিতে যুক্তির থেকে মনস্তত্বের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয় । শিশু শ্রেণিকক্ষে নিষ্ক্রিয় শ্রোতা নয় । সে শিখন প্রক্রিয়ায় একজন অংশগ্রহণকারী । আধুনিক শিশুশিক্ষা পদ্ধতি শিশুর আগ্রহ সৃষ্টি করে । তার মধ্যে প্রেষণার উন্মেষ ঘটায় এবং তার সক্রিয়তাকে উদ্দীপিত করে । শিশু নিজেকে কাজের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে চায় । খেলা তার কাছে আনন্দমূলক , স্বতঃস্ফূর্ত আত্মপ্রক্রিয়া । সুতরাং খেলা হবে শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা পদ্ধতি ।

( 10 ) স্বতঃস্ফূর্ত শৃঙ্খলা : শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শৃঙ্খলা বাহ্যিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় না । বৈচিত্র্যপূর্ণ , সৃজনশীল এবং সমবায়ভিত্তিক কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে শিক্ষার্থী শৃঙ্খলার মূল্য অবহিত হবে । উপযুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি গঠন , আইন এবং নিয়ম – নীতির উপর আস্থা গড়ে ওঠবে । জৈবিক আবেগগুলির ঊর্ধ্বায়নের মাধ্যমে এর বিকাশ ঘটে । এরূপ মুক্ত এবং অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলাকে বলে আত্মনিয়ন্ত্রণ ।

( 11 ) জীবনকেন্দ্রিক শিক্ষণ পদ্ধতি গড়ে তুলতে সাহায্য করে ঃ শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার মূল ধারণা গ্রহণ করে বর্তমানে সারা বিশ্বে শিক্ষার্থীর সার্বিক বিকাশের লক্ষ্যে গড়ে উঠেছে নানারূপ শিক্ষণ পদ্ধতি । যেমন — অণুশিক্ষণ , বৌদ্ধিক পদ্ধতি , উৎপাদনশীল চিন্তন পদ্ধতি , মিথস্ক্রিয়ামূলক বিশ্লেষণ পদ্ধতি ইত্যাদি । এই শিক্ষণ পদ্ধতির দ্বারা শিক্ষার্থীর জীবনকে সর্বাঙ্গীণভাবে গড়ে তােলা হয় ।

( 12 ) শিক্ষার্থীকে সুনাগরিক তৈরি করে : এই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থী নিজের ইচ্ছা ও আগ্রহ অনুযায়ী নিজেকে গড়ে তােলে । ফলে সে সুবিধা – অসুবিধা , ন্যায় অন্যায় আচরণগুলি এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে নিজেকে আদর্শ নাগরিক রূপে তৈরি করতে পারে ।

( 13 ) বিদ্যালয়ের ভূমিকা : সবশেষে শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় বিদ্যালয়ের নতুন ভূমিকা উল্লেখ করতে হয় । আধুনিক বিদ্যালয় জ্ঞানের দোকান বা পণ্ডিত তৈরির কারখানা নয় । এটা শিক্ষার্থীর কাছে চার দেওয়ালে আবদ্ধ জেলখানাও নয় । বিদ্যালয় গৃহের মতে এক স্বাভাবিক স্থান — যেখানে , শিক্ষার্থীরা বাস করে এবং কাজ করে । এটা হল শিশুর সামাজিক আবাস , জীবন নাটকের মঞ্চ যা শিক্ষার্থীকে আগামী দিনের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে ক্রমশ সক্ষম করে তােলে ।

“