” গ্রামে অনেক পটুয়ার বাস । পটুয়া মানে মৃৎশিল্পী । মাটির মূর্তি তৈরি করে তারা । বাঙালির বারাে মাসে তের পার্বণ । কোনাে না কোনাে পূজো – আচ্চা লেগেই আছে । তাই দরকার মূর্তির । দুর্গা , কালী , লক্ষ্মী , সরস্বতীর মতাে বড়াে বড়াে ব্যাপার তাে আছেই , মনসা , শীতলা , ষষ্ঠী প্রভৃতি ঠাকুরের সংখ্যা কম কি ? প্রতিদিন পটুয়াদের কাজ খড়ে দড়ি জড়িয়ে কাঠামাে তৈরি করে , লাগায় তার ওপর কাদা । ক্রমে ক্রমে নানা প্রলেপ ও রঙ ইত্যাদির কাজ ।
একটা ছেলে ঘুরে বেড়ায় পটুয়াদের পাড়ায় । গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখে এ সব কাজ । খুঁটিনাটি নানা দিক । মূর্তির সঙ্গে তৈরি হয় চালচিত্র । তাতে তারা রঙের তুলি দিয়ে ফুটিয়ে তােলে নানা ছবি । এই বিচিত্র চিত্রগুলিতে ছেলেটি পায় বেশ মজা । প্রতিদিন মনােযােগ সহকারে তা দেখে । বিস্মিত হয় এই সৃষ্টির কলাকৌশলে । ছেলেটির অভিভাবকরা ছেলেটির ভবিষ্যৎ ভেবে শঙ্কিত হয়ে ওঠেন । কি হবে এই ছেলেটির ? এভাবে কি বখাটে হয়ে যাবে ! তার ভবিষ্যৎ জীবন কি অন্ধকার ?
ছেলেটি এভাবেই শিল্পচর্চায় আগ্রহী হয়ে ওঠে । রঙ তুলি নিয়ে বসে যায় আঁকার কাজে । চেষ্টা করে তুলির টানে ছবি ফুটিয়ে তােলার । কালক্রমে আর্টস্কুলে ভর্তি হয় । পারদর্শী হয়ে ওঠে অঙ্কন কৌশলে । শিক্ষক গিলাড়ী সাহেবের কাছে পাঠ নেয় ভিন্নরীতির শিল্পচর্চার । একদিন সে দক্ষ হয়ে ওঠে পাশ্চাত্য রীতির শিল্পকলায় । ছেলেবেলায় ছেলেটির মনে দাগ কাটে মৃৎশিল্পীর কাজের বৈশিষ্ট্য । লােকচিত্রের ধারা প্রভাব ফেলে গভীরভাবে । কালীঘাটের পটুয়াদের পটশিল্পের রীতি তাকে প্রভাবিত করে । তাই পাশ্চাত্য রীতির সঙ্গে এ রীতি যুক্ত হয়ে অঙ্কন বৈশিষ্ট্যে এনে দেয় এক নিজস্ব ধারা । ছেলেটি অচিরে একদিন বিখ্যাত হয়ে ওঠে ।
কে এই ছেলেটি ? ছেলেটির নাম যামিনী রায় । জন্ম ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের ১০ এপ্রিল বাঁকুড়া জেলার বেলিয়াতােড় গ্রামে । তার পিতার নাম রামতারণ রায় । মাতার নাম নগেন্দ্ৰবালা । যশােরের রাজা প্রতাপাদিত্যের সঙ্গে তাদের পারিবারিক সম্পর্ক ছিল । জমিদার পিতা রামতারণের আর্থিক অবস্থা বিশেষ ভাল ছিল না । সামান্য চাষবাসের উপার্জনে তাদের পরিবারের ভরণপােষণ চলত ।
একসময় যামিনী ইউরােপীয় প্রথায় ছবি দেখে কিংবা মডেল সামনে বসিয়ে প্রতিকৃতি আঁকতেন , যা দেখলেই জীবন্ত বলে মনে হত । এমন দক্ষতার জন্য শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ তাকে ভালবাসতেন । তাই তিনি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের একটা প্রতিকৃতি যামিনী রায়কে দিয়ে আঁকিয়েছিলেন ।
t যামিনী রায় আর্ট স্কুলের শিক্ষা শেষ করে স্বাধীন কর্মজীবনে প্রবেশ করলেন । সেই সময় সামাজিক রীতি অনুযায়ী তিনি বিবাহ করেন । তার স্ত্রীর নাম আনন্দময়ী । তিনি তাকে নিয়ে প্রথমে বাঁকুড়ার গ্রামের বাড়িতে এবং পরে কিছু রােজগার – পাতি হতে থাকলে বাড়ি ভাড়া করে কলকাতায় বাস করতে থাকলেন ।
৩৪ বছর বয়সে যামিনী স্বকীয় চিন্তাভাবনা নিয়ে লােকজীবনের ঐতিহ্যবাহী চিত্রশৈলীতে মগ্ন হলেন । ফলে , তার অর্থকরী পথ বন্ধ হয়ে গেল এবং একটি কঠিন বাস্তবের মুখােমুখি তাকে দাঁড়াতে হল । ইউরােপীয় পদ্ধতি নিয়ে আর না এগিয়ে প্রতিভাবান শিল্পী আত্মপ্রকাশের পথে এগিয়ে যেতে চাইলেন । তিনি বুঝেছিলেন , কেবলমাত্র প্রতিকৃতি এঁকে বড়াে শিল্পী হওয়া যাবে না । শিল্পীর এই সঙ্কটময় সময়ে অতিকষ্টে আধপেটা খেয়ে স্বামী – স্ত্রীকে দিন কাটাতে হয়েছে । তবুও তিনি মুহ্যমান হননি । নিরলস চেষ্টায় আত্মপ্রকাশের পথে নিমগ্ন হয়েছেন ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অনেকের মতাে যামিনী বােমার ভয়ে কলকাতা ছেড়ে দেশের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন । সেখানে প্রাণখুলে মিশেছেন গ্রামের সাধারণ কুমাের , কামার , জেলে , তাঁতি , কৃষক , ছুতােরদের সঙ্গে এবং শিল্পীর তুলিতে জীবন্ত ফুটিয়ে তুলেছেন নগণ্য মানুষের অসামান্য রূপ । যুদ্ধের পরে এমন ছবির চাহিদা দারুণভাবে বেড়ে গেল । দেশের ও বিদেশের শিল্পরসিকরা আকৃষ্ট হতে , আবার ফিরে এল সংসারের স্বচ্ছলতা ।
এই শিল্পীর অনবদ্য হাতের কাজ । অসংখ্য তার চিত্র । তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য রাধাকৃয় , ক্রুশবিদ্ধ যীশু , গণেশজননী , যশােদা , সীতার অগ্নিপরীক্ষা , বুদ্ধদেব , সঁওতাল রমণী , বাংলার বধূ , লাল ঘােড়া , চিংড়ি মুখে দুই বিড়াল , বাউল প্রভৃতি । তার আঁকা দশ হাজার ছবির মধ্যে বেশিরভাগই ছড়িয়ে রয়েছে বিদেশে ব্যক্তিগত সংগ্রহে ।
ছাত্রজীবনে ১৯০৬ খ্রিঃ যামিনী রায় ‘ সমাজ ’ নামে একটি ছবি এঁকে তার জীবনের প্রথম পুরস্কার পান । বাঁকুড়ার জেলাশাসক তাকে পুরস্কৃত করেন একটি গিনি দিয়ে । তার নতুন ধারার লােকজীবনের ঐতিহ্যাশ্রয়ী চিত্রশৈলী দেখে এক প্রদর্শনীতে অধ্যাপক শাহিদ সুরাওয়ার্দি ১৯৩৭ খ্রিঃ তাকে অভিনন্দিত করেন । ১৯৩৪ খ্রিঃ তার উত্তরা অভিমুন্য ’ ছবিটি অ্যাকাডেমি অফাইন আর্টস – এর সর্বভারতীয় প্রদর্শনীতে ভাইসরয় এর স্বর্ণপদক লাভ করে । শিল্পী যামিনী রায় তার কাজের জন্য ভারত সরকার কর্তৃক সম্মানিত হয়েছেন । ১৯৫৫ খ্রিঃ পেয়েছেন ‘ পদ্মভূষণ ’ উপাধি ।
সংযম ও মিতব্যয়িতা ছিল তার ব্যক্তিজীবনের পাথেয় । ছকে বাধা তার দৈনন্দিন জীবন । সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর দুপুরে খাওয়া ও সমান্য বিশ্রামের সময়টুকু বাদ দিয়ে দিনে রাতে সারা সময়ই তিনি ছবি আঁকতেন । রাশভারি ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন প্রকৃতির মানুষটির জীবনযাত্রা ছিল সরল ও অনাড়ম্বর । থান ধুতি আর সাধারণ সাদা মােটা কাপড়ের একটা ফতুয়া পাঞ্জাবী ছিল তার পােশাক । আর পায়ে থাকত চটি ।
১৯৭২ খ্রিঃ ১৪ এপ্রিল , বাংলা ও বাঙালির গর্ব লােকজীবনের অসামান্য চিত্রকার যামিনী রায়ের মহাপ্রয়াণ ঘটে ।
❤ ‘ কামনা করি তােমার কীর্তির পথ জয়যুক্ত হােক ।
— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
”