মেঘনাদ সাহা

” শ্যাওড়াতলি নামে এক অজ গ্রাম । সেই গ্রামে ছেলেটির জন্ম । গ্রামের বাজারে ছিল । ছেলেটির বাবার একটি মুদির দোকান । সেই দোকানের সামান্য আয়েই কোনাে রকমে তাদের দিন চলত ।

 

 বাড়িতে অক্ষর পরিচয় শেষ হলে ছেলেটিকে ভর্তি করে দেওয়া হল গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে । বাবার সঙ্গে মুদি দোকানে তাকে কাজ করতে হত । আর কাজের এক ফাকে তাকে বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযােগ করে নিতে হত । 

 

খুব মেধাবী ছিল ছেলেটি । তাই অল্প সময়ে পড়াশােনা করে ক্লাশের পড়া তৈরি করে । ফেলত । এভাবেই দোকানের কাজ বজায় রেখে পড়াশােনা করে একদিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ সমাধা করে ভর্তি হল সাত মাইল দূরের শিমুলিয়া গ্রামের মিডল স্কুলে । প্রতিদিন এতটা পথ যাতায়াত খুব সহজ নয় । তাই স্কুলের কাছে এক চিকিৎসকের বাড়িতে তাকে থাকতে হত । কিন্তু সেখানেও কাজ । দরকারে সেই বাড়ির নানা কাজকর্ম এমন কি বাসন পর্যন্ত মাজতে হতাে তাকে । দিনভর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর বাধ্য হয়েই বেশিরভাগ দিন রাত জেগে পড়াশােনা করতে হতাে তাকে । ছেলেটি এই সব দুঃখকষ্টের দিনগুলাের কথা বড়াে হয়েও ভুলতে পারেনি কোনােদিন । মিডল স্কুলের পরীক্ষায় সেই ছেলেটি ঢাকা বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করল এবং বৃত্তি লাভ করে সেই ছেলেটি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হল । 

 

 

সেই সময় ( ১৯০৫ খ্রিঃ ) দেশব্যাপী বঙ্গভঙ্গ বিরােধী আন্দোলনের প্রবল জোয়ার । চারদিকে বিক্ষোভ , মিছিল , প্রতিবাদ সভা । রাজনৈতিক অবস্থার মধ্যে সেই ছেলেটি জড়িয়ে পড়ল । সেই সময় ওখানকার গভর্নর ছিলেন ফুলার সাহেব । তিনি তাদের স্কুলে পরিদর্শনে এলে অন্যান্য ছাত্রদের সঙ্গে ছেলেটিও বিক্ষোভ দেখাল । ফলে , স্কুল থেকে বিতাড়িত হল ছেলেটি এবং তার স্কলারশিপও বন্ধ হল । 

 

 

এরপর সেই ছেলেটি কিশােরীলাল জুবিলী স্কুল নামে এক বেসরকারি স্কুলে ভর্তি হতে বাধ্য হল । এত অসুবিধার ভেতরেও তবু সেই ছেলেটি এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অঙ্ক , ইংরেজি , সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করল ।

 

কে সেই ছেলেটি ? একদিকে যে মেধাবী , অন্যদিকে রাজনীতিতে জড়িয়ে দেশের জন্য দায়বদ্ধ ? সেই ছেলেটির নাম মেঘনাদ সাহা । যিনি পরবর্তীকালে একদিন অসাধারণ মেধা ও অধ্যবসায়ের বলে সূর্যের মধ্যে ক্যালসিয়াম , স্ট্রনসিয়াম , বেরিয়াম , হাইড্রোজেন , হিলিয়াম প্রভৃতি মৌলের আয়নমাত্রা অঙ্ক কষে বার করেছিলেন । যিনি পরবর্তী কালে । একদিন বিজ্ঞানের প্রয়ােজনে রাজনীতিতে যােগ দিয়ে লােকসভার সদস্য ( ১৯৫১ খ্রিঃ ) নির্বাচিত হয়ে সংসদে শিক্ষা – যােজনা , পরমাণু শক্তি প্রভৃতি সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গির কথা তুলে ধরেছিলেন ।

 

 

 মেঘনাদ সাহার জন্ম ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের ৬ অক্টোবর বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকার সন্নিকটে শ্যাওড়াতলি গ্রামে । পিতার নাম জগন্নাথ সাহা । মাতার নাম ভুবনেশ্বরী দেবী । তিনি পিতা – মাতার পঞ্চম সন্তান ।

 

 

 মেঘনাদ সাহা এন্ট্রান্সে প্রথম হয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার পর ১৯০৯ খ্রিঃ ভর্তি হলেন ঢাকা কলেজে । ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে তিনি তৃতীয় স্থান অধিকার করলেন আই . এস . সি . পরীক্ষায় । সেই বছরেই আই . এস . সি . পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু ।

 

 

 মেঘনাদ সাহা অঙ্কে অনার্স নিয়ে ১৯১৩ খ্রিঃ বি . এস . সি . উত্তীর্ণ হলেন । সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রথম এবং মেঘনাদ সাহা অধিকার করলেন দ্বিতীয় স্থান । এরপর ভর্তি হলেন প্রেসিজেন্সি কলেজে এম . এস . সি.-তে। ১৯১৫ খ্রিঃ এম . এস . সি . পরীক্ষায় ফলিত গণিতে মেঘনাদ হলেন প্রথম এবং মিশ্র গণিতে সত্যেন্দ্রনাথ হলেন প্রথম ।

 

 স্বাধীনতা আন্দোলনের সেই উত্তাল যুগে মেঘনাদ সাহা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় অনুশীলন সমিতির কাজকর্মে জড়িয়ে পড়েছিলেন । তিনি যে মেসে থাকতেন সেই মেসে বাঘা যতীন প্রায়ই যাতায়াত করতেন । একদিকে ইংরেজের দমন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগঠন ও সংগ্রাম , আর অপর দিকে এম . এস . সি . পাশ করার পর ফলিত গণিত ও পদার্থবিদ্যার গবেষণায় আত্মনিয়ােগ করার প্রবল ইচ্ছা তাকে পেয়ে বসল । তখন বিজ্ঞান কলেজের কাজ শুরু হয়েছে । স্যার আশুতােষ মুখােপাধ্যায় মেঘনাদ ও সত্যেন্দ্রনাথকে ডেকে বিজ্ঞান কলেজে অধ্যাপনার দায়িত্ব দিলেন । মেঘনাদ সাহার ওপর পড়ল কোয়ান্টামবাদ নিয়ে পড়ানাের দায়িত্ব ।

 

 

মেঘনাদ সাহার ছিল জ্যোতি – বিদ্যায় পাণ্ডিত্য । নক্ষত্রদের ঔজ্জ্বল্য ও সেই সম্পর্কে তাপের তারতম্য নিয়ে প্রবন্ধ লিখে পেলেন উচ্চ শংসা । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ডক্টরেট পেলেন । ১৯২১ খ্রিঃ নাগাদ তার উল্লেখযােগ্য অবদান — সূর্যের বায়ু মণ্ডলে বিকিরণ ঘটিত সাম্যাবস্থা ও নির্বাচনমূলক চাপ , হাইড্রোজেনের গৌণ বর্ণালী এবং সৌর ক্রোমােস্ফিয়ারে আয়নন । এ সবের জন্য তিনি বিশ্বজোড়া খ্যাতি লাভ করেছিলেন । তিনি হয়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার খয়রা অধ্যাপক । হয়েছিলেন বিজ্ঞান কলেজে পদার্থবিদ্যা বিভাগের ( ১৯৩৮ খ্রিঃ ) পালিত অধ্যাপক । 

 

 

মেঘনাদ সাহা লিখেছেন অজস্র বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ । তার রচিত গ্রন্থ— “ দি প্রিন্সিপল অফ রিলেটিভিটি ’ , ‘ ট্রিটিজ অন হিট ’ , ‘ ট্রিটিজ অন মডার্ন ফিজিক্স ’ প্রভৃতি অমূল্য গ্রন্থ । 

 

 

রাষ্ট্রপতি ভবনে পরিকল্পনা কমিশনের সভায় যােগদান করতে যাওয়ার পথে । ১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এই মহান বিজ্ঞানীর আকস্মিক তিরােধান ঘটে । 

 

 

❤ Dr. M. N. Saha won an honoured name .’  — আইনস্টাইন। “

Related posts:

পদার্থ কাকে বলে ? পদার্থ ও বস্তু কি এক ?
প্রশ্ন : মূল্যায়ন কাকে বলে ? মূল্যায়ন কয় প্রকার ও কী কী ? যে - কোনো একপ্রকার মূল্যায়নের বিবরণ দি...
একক পাঠ পরিকল্পনা কাকে বলে ? পাঠ পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা লিখুন । এর সুবিধা লিখুন ।
শিক্ষা পরিকল্পনা কাকে বলে ? শিক্ষা পরিকল্পনার শ্রেণিবিভাগ করুন । যেকোনো একপ্রকার পরিকল্পনার বিবরণ দি...
ধারণা মানচিত্র কাকে বলে ? এর বৈশিষ্ট্য লিখুন । বাস্তবায়নের উপায় লিখুন । এর গুরুত্ব লিখুন ।
পাঠ একক বিশ্লেষণ কাকে বলে ? পাঠ একক বিশ্লেষণের স্তর বা ধাপগুলি লিখুন
অন্তর্ভুক্তিকরণে ( সমন্বিত শিখনে ) প্রদর্শিত শিল্পকলার কীভাবে প্রয়োগ করবেন
প্রদর্শিত শিল্পকলার লক্ষ্য , বৈশিষ্ট্য , গুরুত্ব ও বাস্তবায়নের কৌশল
প্রাথমিক স্তরে পাঠদানের ক্ষেত্রে নাটকের ব্যবহার
মূল্যবোধ শিক্ষায় বিদ্যালয় ও শিক্ষকের ভূমিকা
মূল্যবোধ || মূল্যবোধের বৈশিষ্ট্য || প্রাথমিক স্তরে মূল্যবোধের শিক্ষার গুরুত্ব
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের শিক্ষায় তথ্য ও সংযোগসাধন প্রযুক্তির ভূমিকা
সমন্বয়িত শিক্ষণে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের সমস্যা ও সাফল্য
পাঠক্রম পরিব্যাপ্ত শিক্ষণবিজ্ঞানে তথ্য ও সংযোগসাধন প্রযুক্তির ব্যবহার
পাঠক্রম পরিব্যাপ্ত শিক্ষণবিজ্ঞানে তথ্য ও সংযোগসাধন প্রযুক্তির ব্যবহার
উদাহরণসহ প্রকল্প পদ্ধতির বিবরণ
পূর্বসূত্রজনিত শিখন ( Contextualization ) কাকে বলে ?
জ্ঞান , পাঠক্রম , পাঠ্যবই , শিক্ষার্থী ও শিক্ষণবিজ্ঞানের মধ্যের সম্পর্ক
অনুসন্ধান পদ্ধতি
জ্ঞান নির্মাণ কীভাবে হয় উদাহরণসহ আলোচনা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page