“পড়াশুনায় খুবই ইচ্ছা ছেলেটির । তাই স্কুলে ভর্তি হয়েছে । ক্লাস ঘরের বাইরে বইপত্র নিয়ে চট পেতে বসে থাকে একা । আলাদা হয়ে । আর সবাই ঘরের মধ্যে । বাইরে বসে তাকে মাস্টারমশায়দের পড়ানাে শুনতে হয় । শুনে শুনে শিখতে হয় । কোনাে প্রশ্ন করে জানার সুযােগ নেই । তাছাড়া , মাস্টারমশায়রা তাকে কোনাে পড়াও ধরেন না ।
জল – তেষ্টা পেলে সে এক ফ্যাসাদ । নিজের ইচ্ছায় জল খাওয়ার উপায় নেই । তেষ্টায় বুক ফেটে গেলেও না । বারবার বলতে বলতে যদি অন্য কোনাে সহপাঠীর খেয়াল হয় , তবেই জল খাওয়া । মুখ উঁচু করে থাকে সে । আর অন্য কেউ ওপর থে কে জল ঢেলে দেয় মুখে । এরকম মুস্কিল তার অনেক । মাথার চুল বড়াে হলে সেলুনে । গিয়ে কাটার উপায় নেই । সেলুনে কেউ চুল কেটে দেবে না । তাই তার দিদি তার চুল কেটে দিত । কি দুঃখ ! কি লজ্জা ! কি কষ্ট ছেলেটির !
কেন ? না , সেই ছেলেটি জাতিতে মারাঠী ‘ মাহার ’ সম্প্রদায়ের । জাতিতে মাহার তাে অস্পৃশ্য শুদ্র ! তার কিছু ছোঁয়া চলবে না । তাকে ছোঁবে না কেউ । সেই জন্যে তাে ক্লাস ঘরের বাইরে তাকে আলাদা বসতে হয় । অপরের অনুকম্পায় তৃয়ার জল পায় ! আর , নাপিত চুল কেটে না দেওয়ায় দিদির কাছে চুল কাটতে হয় ।
এই ছেলেটি কিন্তু বোধাইয়ের এনফিনস্টোন হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে গেল । শত অসুবিধার ভেতরেও । তারপর এনফিনস্টোন কলেজ থেকে একদিন বি . এ . পাশ করল । মা ছেলেবেলায় মারা গেছে । এখন গত হলাে বাবা । এই অবস্থায় উচ্চশিক্ষার জন্য বরােদা মহারাজের সহায়তায় ভর্তি হলাে আমেরিকার কলম্বিয়া । বিশ্ববিদ্যালয়ে । সেখান থেকে অর্থনীতিতে এম . এ . পাশ করে । লাভ করে পি . এইচ . ডি . ডিগ্রী ।
ফিরে এসে বরােদার মহারাজের অধীনে সামরিক সচিব পদে নিযুক্ত হয় । কাজে যােগ দিল । কিন্তু থাকবে কোথায় ? একটা পার্শী হােটেলে ‘ অদলজী সরাবজী ’ নামে থ কিতে শুরু করল । কয়েকদিন পরে ধরা পড়ে যেতে তাকে যাচ্ছেতাই অপমান করে তাড়িয়ে দিল । সে যে অস্পৃশ্য !
অফিসে তাকে পানীয় জল দেওয়া হত না । ঘেঁয়া বাঁচাতে নিরক্ষর পিওন পর্যন্ত ঘৃণাভরে ফাইলপত্র তার টেবিলে ছুঁড়ে দিত । অপমানিত এই উচ্চশিক্ষিত যুবক গাছের নীচে আশ্রয় নিয়ে হু হু করে কেঁদে ফেলল । হায় হিন্দু ধর্ম , আর তার বর্ণ বিভাজন ! ব্রাম্মণ্যবাদ সৃষ্ট সামাজিক শােষণ ও অত্যাচার । এই বঞ্চনার হাত থেকে কি মুক্তি নেই ?
এই যুবকটির নাম ভীমরাও রামজী আম্বেদকর । তার ছেলেবেলার নাম ছিল ভীম । আর বড়াে হলে তাকে সবাই ‘ বাবাসাহেব বলে ডাকে । ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে ১৪ এপ্রিল মধ্যপ্রদেশের ‘ মউ ’ শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন । তার পিতার নাম রামজী শকপাল । মাতার নাম ভীমাবাঈ ।
বাবাসাহেব আম্বেদকর লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক গবেষণামূলক প্রবন্ধের ওপর ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে এম . এস . সি . ও পরে ডি . এস . সি . ডিগ্রী লাভ করেন । লন্ডন থে কে বার – এ্যাট – ল ডিগ্রী লাভ করে সেখানে ওকালতি করেন । ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফিরে বােম্বাই হাইকোর্টে ব্যারিস্টারী শুরু করেন । এমন শিক্ষিত মানুষটি কিন্তু তখনও জাতপাতসর্বস্ব , বর্ণহিন্দুদের ঘৃণা থেকে রক্ষা পেলেন না । হাইকোর্টের বর্ণহিন্দু আইন ব্যবসায়ীরা বাবাসাহেবের সঙ্গে এক টেবিলে চা পান করত না ।
আম্বেদকর অনুন্নত জাতির মুক্তি ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তাই ব্যাপক প্রচেষ্ঠা চালিয়েছেন । পুষ্করিণীর জলগ্রহণের অধিকার ও মন্দিরে প্রবেশ অধিকার অর্জনের আন্দোলনে সচেষ্ট হয়েছেন । শূদ্রজাতির চরম সর্বনাশা গ্রন্থ ও ব্রাম্মণ্যবাদের বলিষ্ঠতম হাতিয়ার ‘ মনুসংহিতা ’ দাহ করেছেন । শেষ জীবনে মৃত্যুর মাত্র দেড়মাস আগে হিন্দুধর্ম পরিত্যাগ করে তিনি সাম্য ও মানবতাবােধের প্রতীক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন ।
বাবাসাহেব আম্বেদকর বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মেধাসম্পন্ন ছয়জন পণ্ডিত ব্যক্তির অন্যতম । তিনি ছিলেন ভারতের সংবিধানের জনক । ভারতের জাতীয় পতাকা তৈরির দায়িত্বও তার ওপর ছিল । স্বাধীন ভারতে প্রথম কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী ছিলেন তিনি । ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর তিনি মহা পরিনির্বাণ লাভ করেন । ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার মরণােত্তর ‘ ভারতরত্ন ’ উপাধি দিয়ে এই মহানায়ককে সম্মানিত করেছেন ।
❤ ‘ যে বাপ – মা নিজের সন্তানকে সমাজে মাথা উঁচু করে মানুষের মর্যাদায় বাঁচার চেষ্টা করে না তারা তাে জানােয়ার তুল্য ।
—বাবাসাহেব ডঃ আম্বেদকর
❤ ‘ তােমাদের প্রাপ্য অধিকার আবেদন নিবেদন করে লাভ করতে পারবে না । নিজের চেষ্টায় ও শক্তিতে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অধিকার ছিনিয়ে নিতে হবে । ভীরু মেষকেই বলি দেওয়া হয় । সিংহকে নয় । তােমাদের সিংহের শক্তি অর্জন করতে হবে ।
—বাবাসাহেব ডঃ আম্বেদকর
”