বাংলা সাহিত্য – কালিদাস রায়

“✳️ কালিদাস রায় ✳️

🟣 কালিদাস রায় রবীন্দ্রযুগের বিশিষ্ট রবীন্দ্রানুসারী কবি ও সমালোচক এবং আদর্শ শিক্ষক ছিলেন। পল্লীপ্রকৃতি ও পল্লীজীবনের কথাই তাঁর কবিতায় তিনি তুলে ধরেছেন। সমালোচক হিসেবে তিনি সাহিত্যে ও সংস্কৃতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।

🟣 কালিদাস রায় (২২ জুন ১৮৮৯ — ২৫ অক্টোবর ১৯৭৫) ছিলেন রবীন্দ্রযুগের বিশিষ্ট রবীন্দ্রানুসারী কবি, প্রাবন্ধিক ও পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা। তার রচিত কাব্যগুলির মধ্যে তার প্রথম কাব্য কুন্দ (১৯০৭), কিশলয় (১৯১১), পর্ণপুট (১৯১৪), ক্ষুদকুঁড়া (১৯২২) ও পূর্ণাহুতি (১৯৬৮) বিশেষ প্রশংসা লাভ করে। গ্রামবাংলার রূপকল্প অঙ্কনের প্রতি আগ্রহ, বৈষ্ণবপ্রাণতা ও সামান্য তত্ত্বপ্রিয়তা ছিল তার কবিতাগুলির বৈশিষ্ট্য। তিনি আনন্দ পুরস্কার লাভ করেছেন।

** আনন্দ পুরস্কার ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আনন্দ প্রকাশনা গ্রুপ কর্তৃক প্রদত্ত একটি বার্ষিক সাহিত্য পুরস্কার।

🟣 জন্ম ও শিক্ষাজীবন :
✅ ১৮৮৯ সালের ৯ জুলাই বর্ধমান জেলার কড়ুই গ্রামে কালিদাস রায়ের জন্ম। তিনি ছিলেন চৈতন্যদেবের জীবনীকার লোচনদাসের বংশধর। কালিদাসের শৈশব কেটেছিল মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরে। সেখান থেকে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি শিক্ষকতার বৃত্তি গ্রহণ করেন। কলকাতার ভবানীপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশনে দীর্ঘকাল শিক্ষকতা করেছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালে টালিগঞ্জে ‘সন্ধ্যার কুলায়’ নামক নিজস্ব বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কালিদাস রায়।

🟣 কর্মজীবন :
✅ ১৯১৩ সালে রংপুরের উলিপুর মহারানী স্বর্ণময়ী হাইস্কুলের সহশিক্ষক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু হয়। পরে ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন সাত বছর। তারপরে (১৯২০-৩১) দক্ষিণ চবিবশ পরগনার বড়িশা হাইস্কুলে শিক্ষকতা করার ১১ বছর পর রায়বাহাদুর দীনেশচন্দ্র সেনের সহায়তায় তিনি কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশনের ভবানীপুর শাখায় সহকারী প্রধান শিক্ষকরূপে যোগদান করেন এবং ১৯৫২ সালে অবসর গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

🟣 সাহিত্যকর্ম :
✅ তিনি রবীন্দ্র-ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে তিনি কাব্যচর্চা শুরু করেন। এরপরে কবিতা, ছোটগল্প, রম্য সাহিত্য ইত্যাদি রচনা করেন। ‘বেতালভট্ট’ ছদ্মনামে লিখিত বহু রসরচনা পাঠক সমাজে সমাদৃত ।

⭐ রবীন্দ্র ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে তিনি কাব্যচর্চা শুরু করেন। কবিতা ছোটগল্প রম্য ইত্যাদি রচনা করেন। গ্রাম বাংলার রূপকল্প অংকনের প্রতি তার আগ্রহ। রোমান্টিকতা, প্রেম, পল্লীবাংলার শান্ত মাধুরী, সমাজ, ঐতিহ্যপ্রীতি এবং বৈষ্ণব প্রীতিরস তার কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু। তাঁর ‘ছাএধারা’ কবিতা সুপরিচিত সবার কাছে। কুমারসম্ভব, শকুন্তলা, এবং মেঘদূত ইত্যাদি নাটক অনুবাদ করেন। তাঁর রচিত শিশুতোষ গল্পকাহিনী আছে। “”বেতালভট্ট’ ছদ্মনামে তার রম্যরচনাগুলি পাঠক সমাজে সমাদৃত হয়েছিল। ১৯০৬ সালে কবির প্রথম কবিতা “”মেঘ ও ময়ূর’ প্রকাশিত হয়। ১৯০৭ সালে তাঁর প্রথম কাব্য “”কুন্দ’ প্রকাশিত হয়, যা তিনি রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেছিলেন। পল্লীপ্রকৃতি তাঁর কবিতায় ঘুরে ফিরে এসছে। তিনি তাঁর “”স্মৃতিকথা’য় লিখেছেন,
“”কেবল পল্লীর আবেষ্টনী ও পল্লীর নরনারীর আচরণই যথেষ্ট নয়, পল্লীর চোইন্যব্যথা, পাপ্তাপ, অনাচার, সরলতা সমস্তই আমার চিত্তকে বিচলিত করত। …গ্রামের উৎসব পার্বণের মধ্যে আমি প্রাথমিক উপাদান-উপকরণ পেয়েছি।’

⭐ “”পল্লীবধু’ কবিতায় লিখেছেন,
উঠান ছাড়িয়া না উঠিতে রোদ ঘরের পৈঠা ‘পরে,
কলস ভরিয়া জল লয়ে কেবা স্নান করে ফিরে ঘরে ?

⭐ কিংবা “”আহরণ’ কবিতায় লিখেছেন,
বাংলার দীঘি গভীর শীতল কবির স্বপ্নে ঘড়া
ছলছল কল জল চঞ্চল মাতৃমমতা ভরা।

⭐ রঙ্গব্যঙ্গের কবিতায়ও তিনি যথেষ্ঠ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন,
“”নেশাখোরের অভিধান’ কবিতায় তিনি লিখেছেন,
গাঁজা খেলে গেঁজেল’ যদি, মদ খেলে হয় “”মাতাল,
নস্যি নিলে “”নেসেল’ তবে, চা-খোরেরা “”চাতাল’

⭐ প্রমথনাথ বিশী তাঁর কবিতার সমালোচনা করে লিখেছিলেন,
“”কবিশেখর পাঠ্যপুস্তকের কবি নন, বাংলা কাব্যের একটি চিরন্তনী ধারাশ্রয়ী এ যুগের একজন Major বা প্রধান কবি, রবীন্দ্রপ্রভাব সত্বেও যিনি চিরকাল নিজ স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন।’

⭐ রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ পড়ে “”কাঁচা হাতের লেখা’ বলে সমালোচনা করেছিলেন কিন্তু পরে লিখেছিলেন,
“”তোমার কবিতা বাংলাদেশের মাটির মতোই স্নিগ্ধ ও শ্যামল। বাংলাদেশের প্রতি গভীর ভালোবাসায় তোমার মনটি কানায় কানায় ভরা।’

🟣 কাব্য :
✅ কুন্দ(১৯০৭),
✅ পর্ণপূট (১৯১৪ প্রথম খন্ড,১৯২১ দ্বিতীয় খন্ড),
✅ ব্রজবেণু(১৯১৬),
✅ বল্লরী(১৯১৫),
✅ ক্ষুদকুঁড়া(১৯২২),
✅ লাজাঞ্জলি(১৯২৪),
✅ রসকদম্ব(১৯২৩),
✅ হৈমন্তী(১৯৩৫),
✅ বৈকালী(১৯৪০),
✅ গাথাঞ্জলি(১৯৫৮),
✅ সন্ধ্যামণি(১৯৫৮),
✅ পূর্ণাহুতি(১৯৬৮),
✅ দিন ফুরানোরর গান(১৯৮৪),
✅ তথাগত (১৯৯৪)

🟣 প্রবন্ধ :
✅ পদাবলী সাহিত্য,
✅ প্রাচীন বঙ্গ সাহিত্য পরিচয়,
✅ সাহিত্য প্রসঙ্গ,
✅ প্রাচীন বঙ্গসাহিত্য,
✅ শরৎ সাহিত্য
✅ চনক সংহিতা
✅ চালচিত্র
✅ রঙ্গচিত্র

🟣 শিশু সাহিত্য :
✅ গাথাঞ্জলি(১৯৬১),
✅ গাথাকাহিনী(১৯৬৪),
✅ তৃণদল(১৯৭০),
✅ গাথামঞ্জরী(১৯৭৪),
✅ মণীষী বন্দনা(১৯৭৬),
✅ গাথাবলী(১৯৭৮)

🟣 পুরস্কার :
✅ সাহিত্যকর্মের অবদানের জন্য কালিদাস অনেক সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। তিনি রংপুর সাহিত্য পরিষদ ‘কবিশেখর’ উপাধি (১৯২০), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ (১৯৫৩) ও ‘সরোজিনী স্বর্ণপদক’, বিশ্বভারতীর ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ (১৯৬৩) এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি (১৯৭১) প্রদান করেন।

🟣 মৃত্যু :
✅ তিনি ১৯৭৫ সালের ২৫ অক্টোবর কলকাতায় মারা যান।

Related posts:

পদার্থ কাকে বলে ? পদার্থ ও বস্তু কি এক ?
প্রশ্ন : মূল্যায়ন কাকে বলে ? মূল্যায়ন কয় প্রকার ও কী কী ? যে - কোনো একপ্রকার মূল্যায়নের বিবরণ দি...
একক পাঠ পরিকল্পনা কাকে বলে ? পাঠ পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা লিখুন । এর সুবিধা লিখুন ।
শিক্ষা পরিকল্পনা কাকে বলে ? শিক্ষা পরিকল্পনার শ্রেণিবিভাগ করুন । যেকোনো একপ্রকার পরিকল্পনার বিবরণ দি...
ধারণা মানচিত্র কাকে বলে ? এর বৈশিষ্ট্য লিখুন । বাস্তবায়নের উপায় লিখুন । এর গুরুত্ব লিখুন ।
পাঠ একক বিশ্লেষণ কাকে বলে ? পাঠ একক বিশ্লেষণের স্তর বা ধাপগুলি লিখুন
অন্তর্ভুক্তিকরণে ( সমন্বিত শিখনে ) প্রদর্শিত শিল্পকলার কীভাবে প্রয়োগ করবেন
প্রদর্শিত শিল্পকলার লক্ষ্য , বৈশিষ্ট্য , গুরুত্ব ও বাস্তবায়নের কৌশল
প্রাথমিক স্তরে পাঠদানের ক্ষেত্রে নাটকের ব্যবহার
মূল্যবোধ শিক্ষায় বিদ্যালয় ও শিক্ষকের ভূমিকা
মূল্যবোধ || মূল্যবোধের বৈশিষ্ট্য || প্রাথমিক স্তরে মূল্যবোধের শিক্ষার গুরুত্ব
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের শিক্ষায় তথ্য ও সংযোগসাধন প্রযুক্তির ভূমিকা
সমন্বয়িত শিক্ষণে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের সমস্যা ও সাফল্য
পাঠক্রম পরিব্যাপ্ত শিক্ষণবিজ্ঞানে তথ্য ও সংযোগসাধন প্রযুক্তির ব্যবহার
পাঠক্রম পরিব্যাপ্ত শিক্ষণবিজ্ঞানে তথ্য ও সংযোগসাধন প্রযুক্তির ব্যবহার
উদাহরণসহ প্রকল্প পদ্ধতির বিবরণ
পূর্বসূত্রজনিত শিখন ( Contextualization ) কাকে বলে ?
জ্ঞান , পাঠক্রম , পাঠ্যবই , শিক্ষার্থী ও শিক্ষণবিজ্ঞানের মধ্যের সম্পর্ক
অনুসন্ধান পদ্ধতি
জ্ঞান নির্মাণ কীভাবে হয় উদাহরণসহ আলোচনা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page