“✳️ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ✳️
🔵 অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন খ্যাতিমান ভারতীয় চিত্রশিল্পী, নন্দনতাত্ত্বিক এবং লেখক ছিলেন।পিতামহ ও পিতা ছিলেন একাডেমিক নিয়মের প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্মের শিল্পী। এ সুবাদে শৈশবেই চিত্রকলার আবহে বেড়ে ওঠেন তিনি।
🔵 জন্ম ও বংশ পরিচয়: ১৮৭১ সালে ৭ই আগস্ট ভারতীয় চিত্রশিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন (জন্মাষ্টমীর দিন)। ইংরেজ অধীনস্ত কলিকাতার ৫নং দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনের বিখ্যাত জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারে । পিতা- শ্রী গুনেন্দ্রনাথ ঠাকুর । পিতামহ – শ্রী গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী এবং প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র । তাঁর ভ্রাতা শ্রী গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরও ছিলেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী, নাট্যকার এবং সুরকার ।
🔵 অবনীন্দ্রনাথ সাধারন মানুষের কাছে ‘অবন ঠাকুর’ নামেই অধিক পরিচিত । মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয় ভ্রাতা গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্র ও গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র। সে দিক থেকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার পিতৃব্য ছিলেন।
✳️ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা ও কর্মজীবন :
🔵 ১৮৮১ থেকে ৮৯ পর্যন্ত সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন করেন। ১৮৯০ এ গড়া রবীন্দ্রনাথের খামখেয়ালি সভার সদস্য হয়ে তিনি কবিতা পড়েছেন, নাটক করেছেন। ১৮৯৬ সালে কোলকাতা আর্ট স্কুলের সহকারী অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম এই মর্যাদা লাভ করেন। ১৯১১ সালে রাজা পঞ্চম জর্জ ও রানী মেরি ভারত ভ্রমণে এলে আর্ট গ্যলারি পরিদর্শনের সময় তাদেরকে ওরিয়েন্টাল আর্ট সম্পর্কে বোঝাবার দ্বায়িত্ব পান। ১৯১৩ সালে লন্ডনে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়, এবং তিনি ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে সি আই ই উপাধি লাভ করেন।
✳️ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রসাধনা :
অবনীন্দ্রনাথের কুটুম কাটাম। অবনীন্দ্রনাথের চিত্রকলার পাঠ শুরু হয় তৎকালীন আর্ট স্কুলের শিক্ষক ইতালীয় শিল্পী গিলার্ডির কাছে। তার কাছে অবন শিখেন ড্রয়িং, প্যাস্টেল ও জলরং। পরবর্তীতে ইংরেজ শিল্পী সি এল পামারের কাছে লাইফ স্টাডি, তেলরং ইত্যাদি শিক্ষা অর্জন করেন। ভারতীয় রীতিতে তার আঁকা প্রথম চিত্রাবলি ‘কৃষ্ণলীলা-সংক্রান্ত’। এই রীতি অনুসারী চিত্রশিল্পের তিনি নব জন্মদাতা। ১৮৯৫ সালের দিকে অবনীন্দ্রনাথ প্রথম নিরীক্ষা শুরু করেন। ১৮৯৭ সালে আঁকলেন শুক্লাভিসার- রাধার ছবি মাঝে রেখে উৎকীর্ণ কবি গোবিন্দ দাসের পঙক্তিমালা। যা ছিল পাশ্চাত্য নিয়মের সাথে ভারতীয় রীতির নবতর সংস্লেষণ, যোজন বিয়োজন। ১৯০০ সালে কোলকাতা আর্ট স্কুলে কৃষ্ণলীলা সিরিজ প্রদর্শিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে ই বি হ্যাভেলের উদ্যোগে লর্ড কার্জনের দিল্লি দরবারে আরো দুটি প্রদর্শনী এবং লন্ডনের ‘স্টুডিও’ পত্রিকায় চিত্রালোচনা প্রকাশিত হলে অবনীন্দ্রনাথের ছবি শিল্পরসিকদের মাঝে আগ্রহের জন্ম দেয়। তার শাজাহানের অন্তিমকাল মোঘল মিনিয়েচারের এক লোকায়ত নিরীক্ষা,যেখানে শাজাহানের অন্তিম সারবত্তা করুণ রসের। ক্রমান্বয়ে আকঁলেন বুদ্ধ ও সুজাতা (১৯০১), কালীদাসের ঋতুসঙ্ঘার বিষয়ক চিত্রকলা (১৯০১), চতুর্ভূজা ভারতমাতা (১৯০৫), কচদেবযানি (১৯০৬), শেষযাত্রা (১৯১৪)। জাপানি প্রভাবে অবনীন্দ্রনাথ অঙ্কন করেন তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ওমর খৈয়াম (১৯৩০)চিত্রাবলি। চিত্রসাধনের শেষ পর্যায়ে অবনীন্দ্রনাথের শিল্পচিন্তা নতুন মাত্রা লাভ করে। গড়ে তোলেন কুটুম কাটাম – আকার নিষ্ঠ এক বিমূর্ত রূপসৃষ্টি।
✳️ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যসাধনা :
প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা আনুমানিক ছাব্বিশ। গল্প কবিতা চিঠিপত্র শিল্প আলোচনা যাত্রাপালা পুথি স্মৃতিকথা সব মিলিয়ে প্রকাশিত রচনা সংখ্যা প্রায় তিনশ সত্তরটি। পিত্রব্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অণুপ্রেরণায় লেখালেখির সূত্রপাত।
✳️ অবনীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মের সংক্ষিপ্ত তালিকা :
১. রাজকাহিনী
২. শকুন্তলা
৩. ক্ষীরের পুতুল
৪. ভূত পত্রীর দেশ
৫. নালক
৬. নাহুশ
৭. বুড়ো আঙলা (১৯৪১)
৮. আপন কথা ঘরোয়া
৯. পথে – বিপথে
১০. জোড়াসাঁকোর ধারে(১৯৪৪)
১১. বাংলার ব্রত (চিত্রশিল্প সংক্রান্ত)
১২. ভারতশিল্পে মুর্তি (চিত্রশিল্প সংক্রান্ত) (১৯৪৭)
১৩. ভারতশিল্প (চিত্রশিল্প সংক্রান্ত)
১৪. ভারতশিল্পের সাদঙ্গ (চিত্রশিল্প সংক্রান্ত)
১৫. খাজাঞ্জির খাতা (১৯২১)
১৬. প্রিয়দর্শিকা(১৯২১)
১৭. চিত্রাক্ষর(১৯২৯)
১৮. সহজ চিত্র শিক্ষা (১৯৪৬)
১৯. ভারত শিল্পের ষড়ঙ্গ (১৯৪৭)
২০. আলোর ফুলকি (১৯৪৭)
২১. মাসি (১৯৫৪)
২২. একে তিন তিনে এক (১৯৫৪)
২৩. শিল্পায়ন (১৯৫৫)
২৪. মারুতির পুঁথি (১৯৫৬)
২৫. রং বেরং (১৯৫৮ )
🔵 ‘উইলিয়াম রঁদেনস্টেইন(William Rothenstein)’ ছিলেন একাধারে চিত্রশিল্পী, লেখক এবং লন্ডনের ‘রয়্যাল কলেজ অব আর্ট-এর চূড়ান্ত সভাপতি । বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন এই মানুষটির সাথে অবনীন্দ্রনাথের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল আজীবন। রঁদেনস্টেইন ১৯১০ সালের শরৎকালে ভারতে আসেন এবং দীর্ঘ একবছর তিনি ভারতীয় ঐতিহ্য,
শিল্প ও ধর্ম বিষয়ে চর্চা করেন ।
🔵 কলিকাতায় তিনি অবনীন্দ্রনাথ এবং তাঁর ছাত্রদের সাথে শিল্পচর্চার দ্বারা ভারতীয় চিত্রশিল্পের রীতি অনুসরনের মাধ্যমে নিজস্ব শিল্পরীতির উৎকর্ষতা বৃ্দ্ধিতে সচেষ্ট হন । অবনঠাকুরের ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন- নন্দলাল বসু, কালিপদ ঘোষাল,
সুরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি, অমিত কুমার হালদার, সারদা উকিল, ক্ষিতিন্দ্রনাথ মজুমদার, সমরেন্দ্রনাথ গুপ্ত, মুকুল দে,
মনিষী দে, কে.ভেঙ্কাটাপ্পা, যামিনী রায় এবং রনদা উকিল।
✳️ অবনীন্দ্রনাথের শিল্প প্রদর্শনীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ :
১. ১৯০০ সাল কলিকাতা গভঃ কলেজ – চিত্রপ্রদর্শনী
২. ১৯০৮ সাল ইন্ডিয়ান স্কুল অব্ ওরিয়েন্টাল আর্ট, কলিকাতা
৩. ১৯১১ সাল ক্রিস্টাল প্যালেস, লন্ডন
৪. ১৯১৪ সাল ২২তম প্রদর্শনী -Societe des Peintres Orientalistes Francais GrandPalais, Paris – বেলজিয়াম, দ্য নেদারল্যান্ডস এবং ইম্পেরিয়াল ইন্সটিটিউট ইংল্যান্ড এ ভ্রাম্যমাণ
৫. ১৯২৪ সাল ‘ইন্ডিয়ান স্কুল অব্ ওরিয়েন্টাল আর্ট’ এবং ‘দ্য আমেরিকান ফেডারেশান অব্ আর্ট’ এর যৌথ উদ্যোগে ভ্রাম্যমাণ প্রদর্শনী
৬. ১৯২৮ সাল এথেন গ্যালারি, জেনেভা, সুইজারল্যান্ড
✳️ অবনীন্দ্রনাথের কিছু উল্লেখযোগ্য চিত্রঃ
১. অভিসারিকা (Avisarika) – ১৮৯২
২. শাহাজাহান-এর মৃত্যু (From the passing of Shahjahan) – ১৯০০
৩. বুদ্ধ ও সুজাতা (Buddha and Sujata) -১৯০১
৪. কৃষ্নলীলা সম্পর্কিত (Krishna Lila Series) – ১৯০১ থেকে ১৯০৩
৫. Banished Yaksha – ১৯০৪
৬. কালিদাসের ঋতুসংহারের গ্রীষ্মঋতু(Summer from Ritu Sanghar of Kalidasa)-১৯০৫
৭. চন্দ্রালোকিত গান-বাজনার আসর(Moonlight Music Party)- ১৯০৬
৮. আলোর উৎসব (The feast of lamps) – ১৯০৭
৯. কচ ও দেবযানী (Kacha and Devajani) -১৯০৮
১০. তাজের স্বপ্নে বিভোর শাহজাহান (Shah Jahan dreaming of Taj)- ১৯০৯
১১. ওমর খৈয়ম সম্পর্কিত (Illustration of Omar Khayyam) – ১৯০৯
১২. ইসলামের আহবান(The call of the Flute) – ১৯১০
১৩. অশোকের রানী( তাঁর গৌরব কুইন মেরি জন্য আঁকা) – Asoka’s Queen (Painted for her Majesty Queen Mary) -১৯১০
১৪. বীনাবাদনরত মুর্তি (Veena player) -১৯১১
১৫. ঔরঙ্গজেব দারার মস্তক পরীক্ষারত(Aurangzeb examining the head of Dara) – ১৯১১
১৬. মন্দিরে নর্তক (Temple dancer) -১৯১২
১৭. পুষ্প – রাধা (Pushpa-Radha) – ১৯১২
১৮. যমুনা নদীর তীরে শ্রীরাধা (Sri Radha by the River Jamuna) – ১৯১৩
১৯. রাধিকা একদৃষ্টিতে শ্রী কৃষ্ণের প্রতিকৃতিতে তাকিয়ে আছেন (Radhika gazing at the portrait of Sri Krishna) – ১৯১৩
২০. শেষযাত্রা (The last journey) – ১৯১৪
২১. পশু-পক্ষী সম্পর্কিত সিরিজ (Birds and Animals series) – ১৯১৫
২২. পুরীর সমুদ্রসৈকতে চৈতন্যদেব ও তাঁর অনুগামীরা ( Chaitanya with his followers on the sea beach of Puri) – ১৯১৫
২৩. মুসৌরি পাহাড়ে চন্দ্রোদয় (Moonrise at Mussouri Hills) -১৯১৬
২৪. কবির বাউল নৃত্য ফাল্গুর্নীতে (Poet’s Baul dance in Falgurni)– ১৯১৬
২৫. বাবা গনেশ (Baba Ganesh)ইত্যাদি।
✳️ অবনীন্দ্রনাথের শিল্পচর্চার আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল ‘কুটুম-কাটাম’-এর উদ্ভাবন । অবনীন্দ্রনাথের এক ছাত্রের কথায়, ‘ছেলেবেলায় দেখেছি অবনদাদু পোকা খাওয়া গাছের ডাল, তালের আঁটি হাতে নিয়ে তন্ময় হয়ে দেখছেন । কত রূপরেখাই না ভেসে উঠছে তাঁর মনে। তাঁর ঐসব তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ডালপালা, তালআঁটি,
বাঁশের কঞ্চিই কুটুম-কাটামে স্থায়ী করে নিয়েছিল । কতই না কথা হয় তাঁদের সঙ্গে নিরিবিলিতে । এক একটি বস্তু এক এক রূপে প্রান পায় তাঁর হাতে । একটি বাঁকানো ডালে রঙিন কাপড়ের টুকরো জড়িয়ে দিয়ে, মাথার ওপরে তালের আঁটি বসিয়ে দিলেন। রঙিন সুতো কোমরে বেঁধে নড়াচড়ার ব্যবস্থা হচ্ছে । নাকে নথ, হাতে শাঁখা, মাথায় আবার ঘোমটা। অবনদাদুর কথায়, ওটা ‘কুটুম-কাটাম’-এর সাঁওতাল মেয়ে ।’ আর এক ছাত্রকে ‘কুটুম-কাটাম’-এর অর্থ বোঝাতে গিয়ে অবন ঠাকুর বলেছিলেন, ‘কুটুম’ হচ্ছে জ্ঞাতি আর ‘কাটাম’ হচ্ছে কাঠামো। ওরা খুব অভিমানী । ওদের গায়ে রঙ চাপানো যাবে না বা বার্ণিশও করা যাবে না ।
যেমন রঙ তেমনই থাকবে। তবেই ঐতিহ্য বজায় থাকবে আর প্রকৃতিও খুশি হবে ।
আজও অবন ঠাকুরের পরামর্শ মনে রেখেছেন সেই ছাত্র ।
একটি ছড়াও তিনি লিখেছেন এই শিল্পকে নিয়েঃ
কুটুম-কাটাম জিনিসটা কি
দেখতে যদি চাও
৭-ই পৌষ বিকেল বেলায়
মেলার মাঠে যাও ।
হরেক রকম জিনিস পাবে
পছন্দ হয় কিনে নেবে
এর কুটুম-কাটাম নাম
পছন্দতেই দাম।
সৃষ্টিকর্তা অবন ঠাকুর
তাঁকে স্মরণ করে
বহু বছর করছি এসব
তাঁরই পথ ধরে।
অবনীন্দ্রনাথ তাঁর ছাত্রদের এবং তাঁর সান্নিধ্যে থাকা সমস্ত মানুষজনকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করতেন।
ছাত্রদের শিল্পকলায় উৎসাহ দেওয়ার সাথে সাথে প্রয়োজনমত আর্থিক সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ।
✳️ দেহান্তর :
বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন চিত্রশিল্পী, ভাস্কর ও সাহিত্যিক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৫১ সালের ৫ই ডিসেম্বর ৮০ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন।কিন্তু, আমাদের দেশের মানুষ সঠিক শ্রদ্ধা ও স্বীকৃতি প্রদান করতে ব্যর্থ হয়েছেন এই অসামান্য প্রতিভাবান মানুষটির জন্য । বাংলার মানুষ তাঁর বহুমুখী শিল্পকলার গুরুত্ব অনুভব করেছেন ধীরে ধীরে, কিন্তু সেই অর্থে কোন স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হয়েছে এই মহান মানুষটির মহিমান্বিত সাফল্যে।
অবনীন্দ্রনাথের মত সহজাত সৃজনী ক্ষমতাশীল ব্যক্তির জন্ম যে কোন দেশের পক্ষেই অত্যন্ত গর্বের বিষয় ।”