“■ বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি :
● জ্বালানি : যেসব পদার্থ বাতাস বা অক্সিজেনে পােড়ালে প্রচুর পরিমাণে তাপ উৎপন্ন হয় , তাদের জ্বালানি বলে । অর্থাৎ দহনের ফলে তাপ উৎপন্নকারী পদার্থ হল জ্বালানি ।
● অবস্থা অনুসারে জ্বালানি তিন ধরনের :
( i ) কঠিন : কাঠ, চারকোল, শুকনাে পাতা, কয়লা , খুঁটে ( cow dung cake )।
( ii ) তরল : কেরােসিন, পেট্রোলিয়াম, ডিজেলজাতীয় জ্বালানি তেল ও ইথানল।
( iii ) গ্যাসীয় : জৈবগ্যাস, মিথেন, বিউটেন, হাইড্রোজেন ইত্যাদি ।
● জীবাশ্ম জ্বালানি : কয়েক লক্ষ বছর আগে উদ্ভিদ ও প্রাণী মাটির নীচে চাপা পড়ে বিভিন্ন রাসায়নিক পরিবর্তনের ফলে যে শক্তির উৎসে পরিণত হয় , তাকে জীবাশ্ম জ্বালানি বলে । এগুলি ব্যবহারের কারণে শেষ হয়ে গেলে আর উৎপাদন করা সম্ভব নয় । উদাহরণ : কয়লা , পেট্রোলিয়াম এবং প্রাকৃতিক গ্যাস ।
● পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস ও কয়লাকে একত্রে বলে জীবাশ্ম জ্বালানি । মাটির নীচে বৃহৎ বনভূমি চাপা পড়ে এই জ্বালানি সৃষ্টি হয়েছে চাপে ও তাপে । যেহেতু উদ্ভিদ থেকে এই জ্বালানি সৃষ্টি হয়েছে , তাই বলা যায় এর শক্তি হল সৌরশক্তি ।
■ কয়লা :
● কয়লা হচ্ছে মূলত মুক্ত কার্বন এবং কার্বন , হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন – এর সমন্বয়ে গঠিত যৌগ । উপস্থিত কার্বনের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে কয়লাকে চারভাগে ভাগ করা যায় , যথা :
( a ) পিট কয়লা ( এর মধ্যে কার্বনের পরিমাণ 60 % )
( b ) লিগনাইট ( এর মধ্যে কার্বনের পরিমাণ 67-70 % )
( c ) বিটুমিনাস ( এর ভেতর কার্বনের পরিমাণ 78-87 % )
( d ) অ্যানথ্রাসাইট ( এর মধ্যে কার্বনের পরিমাণ 94-98 % )
● অ্যানথ্রাসাইট হল সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের কয়লা এবং পিট কয়লা হল সর্বনিম্ন মানের কয়লা ।
● বিটুমিনাস কয়লার অন্তর্ভূম পাতনে কোল গ্যাস ( coal gas ) পাওয়া যায় । কোল গ্যাস আলাে উৎপাদনে ও জ্বালানিরূপে ব্যবহৃত হয় । অন্তধূম পাতনের সময় যে কালাে পদার্থ অবশিষ্ট থাকে সেটি হল কোক । ধাতু নিষ্কাশনে বিজারকরূপে এবং জ্বালানি হিসাবে কোক ব্যবহৃত হয় ।
■ পেট্রোলিয়াম :
● বিভিন্ন হাইড্রোকার্বনঘটিত জটিল যৌগের মিশ্রণ হচ্ছে পেট্রোলিয়াম । খনি থেকে প্রাপ্ত কালাে বাদামি বর্ণের অপরিশােধিত তেল ( crude oil ) থেকে পেট্রোলিয়াম পাওয়া যায় ।
● অপরিশােধিত তেল বা ক্রড অয়েল থেকে যেসব পদার্থ পাওয়া যায় সেগুলি হল – কেরােসিন , ডিজেল , জ্বালানি তেল , প্যারাফিন মােম , অ্যাসফল্ড , লুব্রিকেটিং অয়েল ।
● গ্যাসােলিন দ্বারা হেলিকপ্টার এবং বিমান চালানাে হয় ।
● ভারি যানবাহন যেমন— বাস , ট্রাক , রেল ইত্যাদি চালাতে ডিজেল ব্যবহার করা হয় ।
● অপেক্ষাকৃত হালকা যান যেমন মােটরসাইকেল, স্কুটার ইত্যাদি পেট্রোলে চলে ।
● অপরিশােধিত তেল থেকে প্রাপ্ত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের প্রধান উপাদান হল বিউটেন । বিউটেন ছাড়া উক্ত গ্যাসে ইথেন ও প্রােপেনও থাকে ।
● এই পেট্রোলিয়াম গ্যাসকে অধিক চাপে তরলে পরিণত করে সিলিণ্ডারে ভরে রাখা হয় এবং একে বলে তরলায়িত পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা LPG ( Liquified Petrolium Gas ) । এর উপর থেকে চাপ হালকা করে দেওয়া হলে রান্নার সময় গ্যাস হিসাবে বাইরে বেড়িয়ে আসে এবং জ্বলে ওঠে আগুনের সংস্পর্শে । LPG খুব দাহ্য তাই সাবধানে ব্যবহার করা উচিত । এই গ্যাসের সঙ্গে একপ্রকার গন্ধযুক্ত গ্যাস ( সালফারের জৈব যৌগ ) মিশিয়ে দেওয়া হয় যাতে কোনাে কারণে গ্যাস লিক্ করলে বােঝা যায় ।
■ প্রাকৃতিক গ্যাস :
● পেট্রোলিয়াম গ্যাসের সঙ্গে মিশ্রিত অবস্থায় প্রাকৃতিক গ্যাস থাকে ।
● প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল উপাদান হল মিথেন ( CH₄ ) ।
● প্রাকৃতিক গ্যাসকে বলা হয় CNG ( Compressed Natural Gas ) ।
● CNG- এর দহনে বায়ুদূষণ খুবই কম হয় । তাই ভারতের বেশ কিছু শহরে ( যেমন দিল্লি ) সমস্ত বাস এবং অন্যান্য বেশ কিছু যানবাহন CNG- তে চালানাে হচ্ছে । ভারতে প্রায় 100 কোটি ঘনমিটার প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাণ্ডার রয়েছে । ভবিষ্যতে পেট্রোলিয়ামের বিকল্প হতে পারে প্রাকৃতিক গ্যাস ।
● জ্বালানির দহনে O₂ -এর জোগান ঠিক থাকলে নীল শিখা উৎপন্ন হবে । কিন্তু জ্বালানির দহনে যদি হলুদ শিখা উৎপাদন হয় তবে বুঝতে হবে O₂ সরবরাহ কমে গেছে ।
● তাপন মূল্য : এক গ্রাম পরিমাণ কোনাে জ্বালানি অক্সিজেনে সম্পূর্ণ দহনের ফলে যে তাপ উৎপন্ন হয় , তাকে ওই জ্বালানির তাপন মূল্য বলে ।
● তাপন মূল্যের ( Calorific Value ) প্রচলিত একক হল কিলােজুল / গ্রাম ( kJ / g ) ।
□ কয়লার তাপন মূল্য ( kJ / g ) : 25-30
□ কাঠ কয়লার তাপন মূল্য ( kJ / g ) : 33
□ ডিজেলের তাপন মূল্য ( kJ / g ) : 45
□ কেরােসিনের তাপন মূল্য ( kJ / g ) : 48
□ পেট্রোলের তাপন মূল্য ( kJ / g ) : 50
□ প্রাকৃতিক গ্যাসের ( CNG ) তাপন মূল্য ( kJ / g ) : 33-50
□ রান্নার গ্যাসের ( LPG ) তাপন মূল্য ( kJ / g ) : 50
□ হাইড্রজেনের তাপন মূল্য ( kJ / g ) : 150 ( সবচেয়ে বেশি )
● স্থিতিশীল উন্নয়ন : স্থিতিশীল উন্নয়ন হল সেই উন্নয়ন যা বর্তমান প্রজন্মের প্রয়ােজন মেটায় , ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রয়ােজন মেটানাের সামর্থ্যের সঙ্গে আপস না করে । এর ফলে পৃথিবীর প্রাকৃতিক উৎসের সীমার মধ্যে বর্তমান এবং ভবিষ্যতের পরিবেশগত , অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নতি ঘটবে । এর জন্যে জীবাশ্ম জ্বালানির সংরক্ষণ এবং এর ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নবীকরণযােগ্য ও অপ্রচলিত বিকল্প শক্তির উৎসের ব্যবহার প্রয়ােজন ।
■ শক্তির বিভিন্ন উৎস :
■ অপুনর্ভব বা অপুন-নবীকরণযােগ্য উৎস (Non-Renewable) :
● জীবাশ্ম জ্বালানি ( কয়লা , পেট্রোলিয়াম , প্রাকৃতিক গ্যাস ) এবং নিউক্লিয়ার জ্বালানি ( ইউরেনিয়াম ) ।
● প্রচলিত উৎস : জীবাশ্ম জ্বালানি ,
● অপ্রচলিত উৎস : নিউক্লিয়ার জ্বালানি ।
■ নবীকরণযােগ্য বা অপ্রচলিত বা বিকল্প উৎস (Renewable) :
সৌরশক্তি , জলশক্তি , বায়ুশক্তি , জোয়ারভাটা শক্তি , ভূতাপশক্তি , বায়ােমাস শক্তি এবং হাইড্রোজেন ।
■ বিকল্প বা অপ্রচলিত শক্তির উৎস :
এই উৎসগুলি জীবাশ্ম জ্বালানির দহনে বা পরমাণুর ভাঙনের ওপর নির্ভর করে না । এই শক্তিগুলি পরিবেশ দূষণ ঘটায় না । এই উৎসগুলি হল—
■ সৌরশক্তি :
সূর্য থেকে আসা সৌরশক্তির উৎস হল নিউক্লিয় সংযােজন বিক্রিয়া । সৌরশক্তির মধ্যে তাপ ও আলােক শক্তি রয়েছে । সােলার কুকার , সােলার ওয়াটার হিটার , সৌরকোশ ইত্যাদিতে সৌরশক্তিকে কাজে লাগানাে হচ্ছে ।
● সৌরকোশ : সৌরকোশে সৌরশক্তিকে তড়িৎশক্তিতে রূপান্তরিত করা হয় । সৌরকোশে সিলিকন – বােরন – এর একটি স্তর এবং সিলিকন – আর্সেনিক – এর একটি স্তর পাশাপাশি থাকে । এতে 0.5 V বিভব পার্থক্য সৃষ্টি হয় ।
● সৌরকোশ প্যানেল : অনেকগুলি সৌরকোশকে যুক্ত করে একটি সৌরকোশ প্যানেল তৈরি করা হয় ।
■ সৌরকোশের ব্যবহার :
- কৃত্রিম উপগ্রহে এবং দূরের বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে তড়িৎ সরবরাহ করতে , রেডিয়াে , টিভি ইত্যাদি চালাতে ।
- ঘড়ি , ক্যালকুলেটর , ট্রাফিক সিগন্যাল , খেলনা ইত্যাদি চালাতে ব্যবহৃত হয় ।
■ বায়ুশক্তি :
সূর্যের তাপে পৃথিবীপৃষ্ঠের বিভিন্ন অঞ্চল অসমানভাবে উত্তপ্ত হলে বায়ুপ্রবাহ হয় । বায়ুপ্রবাহের গতিশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বায়ুকলের সাহায্যে টারবাইন ঘুরিয়ে তড়িৎ উৎপন্ন হয় ।
● বর্তমানে ভারতে বায়ুশক্তি থেকে প্রায় 1025 MW তড়িৎ ক্ষমতা উৎপন্ন হচ্ছে ।
■ জোয়ারভাটা শক্তি :
চাঁদের মহাকর্ষ বলের প্রভাবে পৃথিবীর সমুদ্রে যে জোয়ারভাটা সৃষ্টি হয় তার ফলে উৎপন্ন জলের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে টারবাইন ঘুরিয়ে তড়িৎশক্তি উৎপন্ন করা হয় ।
■ ভূতাপশক্তি : পৃথিবীর অভ্যন্তরে অবস্থিত শিলা খুব উত্তপ্ত থাকায় , মাটির নীচে থাকা জল উত্তপ্ত হয়ে স্টিমে পরিণত হয়ে উচ্চচাপে বেরিয়ে এসে টারবাইন ঘুরিয়ে তড়িৎশক্তি উৎপন্ন করে ।
■ বায়ােমাস শক্তি— বায়ােফুয়েল , বায়ােগ্যাস :
● বায়ােমাস : উদ্ভিদের মৃত অংশ এবং প্রাণীর বর্জ্য পদার্থকে বলে বায়ােমাস । এটি হল জৈব পদার্থ যা জ্বালানি রূপে ব্যবহৃত হয়ে শক্তি উৎপন্ন করে । উদাহরণ : কাঠ , কৃষি বর্জ্য এবং গােবর ।
● বায়ােফুয়েল : কাঠ , কৃষি বর্জ্য এবং গােবর জ্বালানি রূপে ব্যবহৃত হওয়ায় এদের বায়ােফুয়েল বলে ।
● বায়ােগ্যাসের উপাদান : মিথেন ( 75 % ) , কার্বন ডাইঅক্সাইড , হাইড্রোজেন এবং হাইড্রোজেন সালফাইড ।
● বায়ােগ্যাসের ব্যবহার :
- জ্বালানি রূপে রান্নার কাজে ,
- আলাে জ্বালানাের জন্যে ,
3 , জলসেচন কার্যে পাম্পের ইঞ্জিন চালাতে এবং - বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে ।
● মেথানোজেনিক ব্যাকটেরিয়া : মেথানােজেন হল অ্যারকি ( এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া ) যা স্বল্প অক্সিজেন পরিবেশে বিপাকীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মিথেন উৎপন্ন করে । এগুলি জলাভূমিতে থাকে এবং মার্স গ্যাস ( মিথেন ) উৎপন্ন করে ।
● বায়ােগ্যাস প্ল্যান্ট : জলের উপস্থিতিতে কিন্তু অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে অ্যানেরােবিক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা প্রাণী এবং উদ্ভিদের বর্জ্য পদার্থের বিয়ােজন পদ্ধতির দ্বারা বায়ােগ্যাস উৎপন্ন করা হয় বায়ােগ্যাস প্ল্যান্ট – এ । বায়ােগ্যাস প্ল্যান্টে গােবর , মানুষের বর্জ্য , কৃষিকার্যের বর্জ্য , উদ্ভিদের বর্জ্য , পােলট্রিতে উৎপন্ন বর্জ্য এবং ফেলে দেওয়া কাগজের টুকরা ব্যবহার করে বায়ােগ্যাস উৎপন্ন করা হয় ।
■ কয়লাখনির মিথেন ( Coal Bed Methane , CBM ) :
এটি হল কয়লাখনি থেকে উৎপন্ন এক প্রকারের প্রাকৃতিক গ্যাস যা কয়লার উপরে একটি পাতলা স্তর রূপে সঞ্জিত থাকে । এর মধ্যে খুব অল্প পরিমাণে প্রােপেন বা বিউটেন এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড থাকে । একে শক্তির উৎসরূপে ব্যবহার করা যায় ।
■ মিথেন হাইড্রেট :
নির্দিষ্ট মানের উষ্ণতা এবং চাপে জলের অণুগুলি খাঁচার মতাে গঠন তৈরি করে এবং তার মধ্যে মিথেন অণুগুলি থাকে । এইভাবে মিথেন হাইড্রেট উৎপন্ন হয় । পৃথিবীতে মেরু অঞ্চল এবং সমুদ্রের নীচে মিথেন হাইড্রেট পাওয়া যায় । মিথেন হাইড্রেট নিজ আয়তনের 160-170 গুণ আয়তনের মিথেন গ্যাস উৎপন্ন করতে পারে যা শক্তির উৎসরূপে ব্যবহার করা যেতে পারে ।
● মিথেন হাইড্রেটকে fire ice বলে ।