“বাঙালি ছেলে পড়াশােনা করে বাংলার বাইরে ওড়িশায় । ওড়িশার কটকের মিশনারী স্কুলে । ছেলেটি দারুণ মেধাবী । তেমনি তেজস্বী । অন্যায়ের প্রতিবাদে সােচ্চার । তার জন্যে কাকেও কিছু গ্রাহ্যই করে না । ছেলেটি পরে বড়াে স্কুলে ভর্তি হলাে । র্যাভেন শ কলেজিয়েট স্কুল । স্কুলটি ভালাে । ছাত্রটি আরাে ভালাে । প্রবেশিকা পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলে দেখা গেল , সে ছেলেটি পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে ।
সেই ছেলেটি একদিন গৃহত্যাগ করলাে । তার মনে শ্রী রামকৃষ্ণদেবের বৈরাগ্য মন্ত্রের প্রেরণা । প্রেরণা স্বামী বিবেকানন্দের বীরবাণীর । গৃহত্যাগ করে চলে গেলাে মুক্তির সন্ধানে হিমালয়ে । করল গভীর সাধনা । কিছুকাল পরে গৃহে ফিরেও এলাে । ভর্তি হলাে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে । তীব্র দেশাত্মবোেধ তার অন্তরের চালক শক্তি হিসাবে কাজ করছিল । তাই অধ্যাপক ওটেনের ভারতীয়দের প্রতি অবমাননাকর কথায় তীব্র প্রতিবাদ করল । তার অন্তরাত্মা বিদ্রোহী হয়ে উঠল । পরিণামে , প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তাকে বহিষ্কৃত হতে হলাে । এমন তেজোদীপ্ত ছেলে কি পড়তে পারবে না ? তা হতে পারে না ! স্যার আশুতােষ চেষ্টা নিলেন । স্যার আশুতেষের চেষ্টায় স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হতে পারল । দর্শন শাস্ত্রে অনার্স নিয়ে বি . এ . পড়তে লাগলাে । তারপর বি . এ . পাশ করে পরে এম . এ . পড়তে থাকে ।
এম . এ . পরীক্ষার পূর্বেই সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষার জন্য ছেলেটি ইংল্যান্ডে চলে । গেল এবং পরের বছরই বসলাে আই . সি . এস . পরীক্ষায় । যথা সময়ে ফল প্রকাশিত হলে দেখা গেল সেই মেধাবী ছেলেটি চতুর্থস্থান অধিকার করেছে । তারপর দেশে ফিরে এলাে সে । দেশে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তার চারপাশে উচ্চ বেতনের নানা সরকারি চাকরির প্রলােভন । কিন্তু এ ছেলে সে ছেলে নয় । দেশ – জননীর পরাধীনতার শৃঙ্খল মােচনের জন্য যেন এই অগ্নি – শিশুর জন্ম । গােলামির সমস্ত প্রলােভন ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করল । দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরূপে ঝাপিয়ে পড়ল ভারতের মুক্তির সংগ্রামে ।
কে এই ছেলেটি ? এই ছেলেটির নাম সুভাষচন্দ্র বসু । ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ , জানুয়ারি ওড়িশার কটক শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন । তার পিতার নাম জানকীনাথ বসু । মাতার নাম প্রভাবতী দেবী । জানকীনাথ একজন প্রখ্যাত সরকারি উকিল ছিলেন । তার পৈতৃক নিবাস ছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার কোদালিয়া গ্রামে ।
সুভাষচন্দ্রের কর্মজীবন নানা বৈচিত্রে ভরা এবং রূপকথার কাহিনীর মতাে রােমাঞ্চকরও বটে । দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের নির্দেশে জাতীয় শিক্ষালয়ে অধ্যক্ষপদ গ্রহণ করেছিলেন । ছিলেন কংগ্রেস কমিটির প্রচার – সচিব । ইংল্যান্ডের যুবরাজের ভারত আগমন উপলক্ষে পূর্ণ হরতাল হয়েছিল । সুভাষচন্দ্র ছিলেন আহ্বায়ক । তাই তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানাে হলাে । মুক্তির পর তিনি হলেন বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সম্পাদক । তারপর হলেন ‘ ফরওয়ার্ড পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক । তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন । কলকাতা পৌর নিগমের প্রধান অধিকর্তা । তার ছিল সরকার বিরােধী স্বাধীন মনােভাব । তারজন্য বারবার সংঘাত এবং বারবার কারাবরণ । অধিকাংশ সময়ই ইংরেজ শাসকের কারাগারে তাঁকে কাটাতে হয়েছিল ।
কারাগারে থাকার ফলে তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে , চিকিৎসার জন্য যেতে হয়েছিল ইউরােপে । স্বাস্থ্য উদ্ধারের পর দেশে ফিরে আবার কারাবাস । মুক্তির পর হরিপুরা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন । এই সময়ে কংগ্রেস দলে চরম ও নরম পন্থীদের মধ্যে সংঘাত তীব্র হয়ে ওঠে । সুভাষচন্দ্র ছিলেন চরমপন্থীর অগ্রনায়ক । যেহেতু তিনি সমগ্র কংগ্রেসের সভাপতি , তাই নরমপন্থীরা ক্ষুব্ধ হলাে । সুভাষচন্দ্র বিরক্ত হয়ে ত্যাগ করলেন সভাপতি – পদ ও কংগ্রেস দল ।
ঠিক এ সময়ে পৃথিবীতে জ্বলে উঠেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দাবানল । সুভাষচন্দ্র ভারতের স্বাধীনতার জন্য এই সুযােগ কাজে লাগাতে চাইলেন । কিন্তু বিদেশি সরকার ১৯৪০ সালে তাকে গ্রেপ্তার করে । তার ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে কারাগারে না পাঠিয়ে স্বগৃহে নজরবন্দী করে রাখে । সেদিন ছিল ১৯৪১ সালের ২৬ জানুয়ারি । সুভাষচন্দ্রের নিরুদ্দেশের খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল । সুভাষচন্দ্র নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন জিয়াউদ্দিনের ছদ্মবেশে ইংরেজ পুলিশের চোখে ধুলাে দিয়ে । স্বদেশের মুক্তির জন্য তিনি চললেন কাবুল – বার্লিন – সিঙ্গাপুরে । অসুস্থ দেহ , কিন্তু মনে প্রচণ্ড উদ্দামতা । তিনি ছুটলেন পৃথি বীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে । সিঙ্গাপুর বিপ্লবী রাসবিহারী বসু গঠন করেছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজ । সুভাষচন্দ্র হলেন তার সর্বাধিনায়ক ।
নেতাজী সুভাষচন্দ্র উদাত্ত কণ্ঠে বললেন , “ তুমি আমাকে রক্ত দাও , আমি তােমাকে স্বাধীনতা দেব । সিঙ্গাপুরে জেগে উঠল অকাতরে প্রাণ দেবার প্রবল উন্মাদনা । অভূতপূর্ব এক প্রাণের জোয়ার । গঠিত হলাে আজাদ হিন্দ সরকার । এই সরকার ১৯৪৪ সালে যুদ্ধ ঘােষণা করলাে ইংল্যান্ড ও আমেরিকার বিরুদ্ধে ।
১৯৪৫ সালের ১৮ মার্চ আজাদ হিন্দ ফৌজ স্বাধীন জাতীয় পতাকা উত্তোলন করল ভারতের মাটিতে । সুভাষচন্দ্র ডাক দিলেন ‘ দিল্লী চলাে ’ । শুরু হলাে দিল্লী অভিযান । কিন্তু এর মধ্যে ঘটে গেল অনেক কিছু । ইংরেজ বাহিনী ব্রয়দেশ আবার দখল করে ফেলল । জাপান তার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করল । দেশবাসী অনেকখানি বিভ্রান্ত । আজাদ হিন্দু সরকারের পতন হলাে । এই পরাজয়ের বেদনায় সুভাষচন্দ্র নতুন পথের সন্ধান করতে লাগলেন । বিমানে জাপান যাত্রা করলেন ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট । সংবাদ ঃ তিনি নাকি জাপান যাওয়ার পথে তাইহােকুতে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন । ভারতবাসী অনেকেই তা বিশ্বাস করে না । এই নেতাজীকে কেউ বন্দী করে রাখতে পারে না । কেউ অকালে হত্যা করতে পারে না । বিমান – দুর্ঘটনা তাদের কাছে একটা অপপ্রচার ছাড়া কিছুই নয় । অনেকেই আশা করেন তিনি ফিরবেন । আজ এই স্বাধীন ভারতে তার আগমনের জন্য সাগ্রহ প্রতীক্ষা ।
❤ “” Give me blood , I give you freedom . “”
— নেতাজী
❤ ‘ স্বদেশের চিত্তে নূতন প্রাণ সঞ্চার করবার পুণ্যব্রত তুমি গ্রহণ করেছ ।’
— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ”