সমাজবিজ্ঞানের বিষয় হিসেবে ইতিহাস

✳️ ইতিহাসের ধারণা ( Concept of History )

ইতিহাসের ধারণাকে সুস্পষ্ট করতে হলে ইতিহাসের গতিধারাকে দুটি ভাগে বিভক্ত করতে হবে , যথা — সুদূর প্রাচীনকাল থেকে উনবিংশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত ইতিহাসের ধারা এবং উনবিংশ শতাব্দীর পর থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত ইতিহাসের ধারা । প্রথম ধারাকে ইতিহাসের প্রাচীন ধারণা ( Traditional Concept of History ) এবং দ্বিতীয় ধারাকে ইতিহাসের আধুনিক ধারা ( Modern Concept of History ) রূপে চিহ্নিত করা যায় । ইতিহাস সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত চেতনা হঠাৎ গঠিত হয়নি , দীর্ঘ অনুশীলন ও দীর্ঘ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত চেতনা পরিপুষ্ট হয়েছে ।

⭐ ইতিহাসের প্রাচীন ধারণা ( Traditional Concept of History )

✳️ ‘ গ্রিস দেশে অনুসন্ধানের মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণ ’ – এই অর্থেই সর্বপ্রথম ইতিহাস চেতনার বিকাশ হয়েছে । ইতিহাসের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ অনুসন্ধান করলে এর সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায় । ইতিহাসের জনক গ্রিক পণ্ডিত হেরােডােটাস বহুজনপদ ও নগররাষ্ট্র পরিভ্রমণ করে কখনও পরােক্ষভাবে সংগৃহীত তথ্য আবার কখনও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও উপযুক্ত প্রমাণের সাহায্যে গদ্যের ভঙ্গিতে গল্পের আকারে বহু ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন । এর পূর্বে ছন্দের আকারে বহু আকর্ষণীয় মনােগ্রাহী কাহিনি ও গাথা মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল । কিন্তু এই কাহিনিগুলিতে কোনাে সত্যতা ও ব্যক্তি নিরপেক্ষতা ছিল না । বিজ্ঞান সাপেক্ষতা কিংবা বিশ্লেষণধর্মিতার ছোঁয়া মাত্র ছিল না । হেরােডােটাস – এর পূর্বে লিখিত বিবরণের অস্তিত্ব প্রায় ছিল না বললেই চলে । হেরােডােটাসই সর্বপ্রথম ব্যক্তি নিরপেক্ষতা , সত্যতা ও বিশ্লেষণধর্মিতাকে লিখিত ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য করে তােলেন ।

সমসাময়িক যুগের আর একজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক ‘ পেলােপনেশীয় যুদ্ধের ইতিহাস রচয়িতা থুকিডিডিস । ঐতিহাসিক চিন্তাচেতনায় ঘটনার বাস্তবতা ও সত্যধর্মিতার প্রকাশ লক্ষ করা যায় তার রচিত ইতিহাসে । তাই নিছক আনন্দবর্ধক সুখপাঠ্যের কাহিনির পরিবর্তে ধীরে ধীরে সত্য ঘটনার ইতিহাসের জয়যাত্রা সূচিত হয় । বিবরণধর্মিতা থেকে ধীরে ধীরে ডিডাক্টিক ( Didactic ) পদ্ধতিতে থুকিডিডিস তার ইতিহাস রচনা সমৃদ্ধ করেন ।

ঐতিহাসিক ট্যাসিটাস ও লিভী ইতিহাসে বিবরণধর্মিতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন । অষ্টাদশ শতাব্দীতে রচিত গিবন – এর Decline and Fall of the Roman Empire ‘ পুস্তকে বিবরণধর্মিতা ও হৃদয়গ্রাহীতার প্রাধান্য লক্ষ করা যায় । ধর্মীয় প্রভাব ইতিহাসের গতিকে আচ্ছন্ন রেখেছিল । চারণ কবিদের গাথামূলক রচনা এই সময় প্রাধান্য পেয়েছিল । ঘটনার সত্যাসত্য ও নিরপেক্ষ বিচারবিশ্লেষণী চিন্তার প্রাধান্য ছিল অনেকাংশে কম । অষ্টাদশ শতাব্দীতে ধর্মীয় মােড়কে ইতিহাসের সত্যতা সীমাবদ্ধ ছিল ।

আমাদের দেশে প্রাচীনকালে বেদ , পুরাণ , রামায়ণ , মহাভারত , গীতা ও ভাগবতে কল্পনা , অতিকথন , ধর্মীয় চিন্তাচেতনার প্রাধান্য ছিল । মধ্যযুগে রাজপ্রশস্তিমূলক কাহিনির প্রাধান্য ছিল । বিভিন্ন রােমাঞ্চকর কাহিনি , অলৌকিক ঘটনা ও লােকগাথা ( রাজপুত চারণ ও মারাঠাগাথা ) ইতিহাস হিসেবে সুখপাঠ্য ও আকর্ষণীয় ছিল । প্রাচীন ও মধ্যযুগে রাজা – মহারাজাদের ব্যক্তিগত কাহিনি ও সামরিক কাহিনি ইতিহাস হিসেবে বিবেচিত হত । রাজার বিভিন্ন স্তুতি , গুণগান , যুদ্ধজয়ের কৃতিত্ব প্রাধান্য পেত , সাধারণ প্রজার কীর্তিকাহিনি কোনাে রচনায় স্থান পেত না । কিন্তু রাজার সাফল্য ও যুদ্ধজয়ের পিছনে থাকত অসংখ্য মানুষের ত্যাগ ও আত্মবলিদান । কিন্তু এসবের প্রাধান্য বিন্দুমাত্র ছিল না । সমাজ , অর্থনীতি ইতিহাসের উপজীব্য বিষয় ছিল না । কিন্তু আমরা জানি অর্থনৈতিক জীবনধারাই রাজনৈতিক জীবনধারাকে পরিচালিত করে । আবার সমাজকে বাদ দিয়ে ধর্মের ব্যাপকতা ও বিস্তৃতি অকল্পনীয় । ভৌগােলিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশও ইতিহাসের গতি নির্ধারণ করে । মানুষের শিল্পকর্ম , সৃষ্টিশৈলী ও সাহিত্যকর্মের বিকাশও ইতিহাসের উপজীব্য বিষয় । কিন্তু সমগ্র প্রাচীন ও মধ্যযুগ জুড়ে এই বিষয়গুলি ইতিহাসে প্রাধান্য পায়নি । ইতিহাস ছিল ধর্মীয় মােড়কে রাজারাজড়াদের উত্থানের কাহিনি ।

ইতিহাসের এই প্রাচীন ধারণা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – এর ইতিহাস প্রবন্ধে সুন্দরভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে । তিনি তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন , “ ভারতবর্ষের যে ইতিহাস আমরা পড়ি এবং মুখস্থ করে পরীক্ষা দিই , তা ভারতবর্ষের নিশীথকালের একটা দুঃস্বপ্ন কাহিনীমাত্র । কোথা হতে কারা এল , কাটাকাটি মারামারি পড়ে গেল , বাপ – ছেলে , ভাইয়ে – ভাইয়ে সিংহাসন নিয়ে টানাটানি করতে লাগল । একদল যদি বা যায় , কোথা থেকে আর একদল উঠে পড়ে । পাঠান , মােগল , পাের্তুগিজ , ফরাসি , ইংরেজ সকলে মিলে এই স্বপ্নকে উত্তরােত্তর জটিল করে তুলেছে । ভারতবাসী কোথায় এই ইতিহাস তার উত্তর দেয় না । যেন ভারতবাসী নাই , কেবল যারা কাটাকাটি , খুনােখুনি করেছে তারাই আছে । সেই ইতিহাস পড়লে মনে হয় ভারতবর্ষ তখন ছিল না । তখন প্রকৃত ভারতবর্ষের মধ্যে যে জীবনস্রোত বয়েছিল , যে চেষ্টার তরঙ্গ উঠেছিল , যে সামাজিক পরিবর্তন ঘটেছিল , তার বিবরণ ইতিহাসে পাওয়া যায় না । ”

তাই দেখা যায় সুদূর প্রাচীনকালে গ্রিস দেশে হেরােডােটাসও থুকিডিডিস – এর রচনায় নিরপেক্ষ দৃষ্টিভশি , কার্যকারণ ও ঘটনার বাস্তবতার বিশ্লেষণ প্রতিফলিত হলেও ইতিহাসের এই প্রাচীন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বর্তমানের প্রেক্ষাপটে সংকীর্ণ , কারণ মানুষের প্রাধান্য এবং তার কার্যকলাপ ইতিহাসে প্রাধান্য পায়নি । সমাজ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বিবর্তনও ইতিহাসে প্রতিভাত হওয়া উচিত । মানুষের শিল্পচেতনা , সৃষ্টিকর্ম , ধর্মীয় ও দর্শন চেতনা সবকিছুই ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের অধীন হওয়া উচিত । কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত এই চিন্তাধারায় ইতিহাসের ধারণা সমৃদ্ধ হয়নি । তাই ইতিহাসের প্রাচীন ধারা শিক্ষাবিজ্ঞান বিশ্লেষণী ধারার আঙ্গিকে অনেকটাই সীমাবদ্ধ ও সীমিত । তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে , বিবর্তনের যাত্রাপথে প্রাচীন ধ্যানধারণার গতির মধ্যেই ইতিহাস চেতনার আধুনিক ধ্যানধারণার মূলসূত্র নিহিত থাকে । বিবর্তনের ধারায় তাই উনবিংশ শতাব্দী থেকে আধুনিক ইতিহাস ধারণার যাত্রা শুরু ।

Related posts:

বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের জীবন কথা
পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী : 2024
চন্দ্রযান-3 : চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণকারী প্রথম দেশ ভারত
GENERAL STUDIES : TEST-2
GENERAL STUDIES : 1
কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স: 8ই সেপ্টেম্বর
'জ্ঞানচক্ষু' গল্পের নামকরণের সার্থকতা বিচার করো।
তপনের জীবনে তার ছোটো মাসির অবদান আলোচনা করো।
সমান্তরাল আলোকরশ্মিগুচ্ছ বলতে কী বোঝ ?
আলোকরশ্মিগুচ্ছ বলতে কী বোঝায় ? এটি কয়প্রকার ও কী কী ?
একটি সাদা কাগজকে কীভাবে তুমি অস্বচ্ছ অথবা ঈষৎ স্বচ্ছ মাধ্যমে পরিণত করবে ?
ঈষৎ স্বচ্ছ মাধ্যম কাকে বলে ? উদাহরণ দাও ।
অস্বচ্ছ মাধ্যম কাকে বলে ? উদাহরণ দাও ।
স্বচ্ছ মাধ্যম কাকে বলে ? উদাহরণ দাও ।
অপ্রভ বস্তুও কি আলোর উৎস হিসেবে কাজ করতে পারে?
বিন্দু আলোক - উৎস কীভাবে পাওয়া যেতে পারে ?
বিন্দু আলোক - উৎস ও বিস্তৃত আলোক - উৎস কী ?
অপ্রভ বস্তু কাকে বলে ? উদাহরণ দাও ।
স্বপ্নভ বস্তু কাকে বলে ? উদাহরণ দাও ।
দিনেরবেলা আমরা ঘরের ভিতর সবকিছু দেখতে পাই , কিন্তু রাত্রিবেলা আলোর অনুপস্থিতিতে কোনো জিনিসই দেখতে পা...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page