ইতিহাসের আধুনিক ধারণা

✳️ ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইতিহাস ধারণায় এল এক বিরাট পরিবর্তন । ইতিহাস আর শুধু রাজা – মহারাজাদের উত্থান পতন কিংবা যুদ্ধের কাহিনির মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না । ইতিহাসের স্রোতধারায় সাধারণ মানুষের সামাজিক , অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক , ধর্মীয় ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের অনুপ্রবেশ ঘটল । সমাজতত্ত্ব , মনস্তত্ত্ব ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতি ইতিহাসের বিষয়বস্তু রূপে গুরুত্ব পেল । মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনধারা ইতিহাসের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করল । Freeman তাই যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে , “ History is past politics . ” । মানুষের শিল্প , বিজ্ঞান , দর্শন চেতনা , ভাষা , সাহিত্য , ধর্ম , সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মপ্রবাহ ইতিহাসের উপাদান হিসেবে স্বীকৃতি পেল । ইতিহাসে দেশ , কাল ও পাত্র গুরুত্ব পেল । সময় চেতনা , নিরবচ্ছিন্নতা ( Continuity ) ও কার্যকারণ সম্পর্কের বােধ ইতিহাসে প্রাধান্য পেল ।

ঊনবিংশ শতাব্দী ছিল সামগ্রিকভাবে জ্ঞান – বিজ্ঞানের শতাব্দী । এই শতাব্দীতে মানুষ যুক্তি , বিচারবােধ ও মানবতাবােধকে কাজে লাগিয়ে ধর্মীয় জড়তা ও কুসংস্কার মুক্ত মননশীলতা গঠনে সমর্থ হয় । তাই বিজ্ঞানচেতনা ইতিহাসের ধ্যানধারণায় প্রতিফলিত হয় ।

এই শতাব্দীতে জাতীয় রাষ্ট্র ( National State ) গঠনের উদ্যোগ লক্ষ করা যায় । তাই জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও আন্তর্জাতিকতা বােধ ধীরে ধীরে ইতিহাস চেতনাকে সমৃদ্ধ করে । ইতিহাসে অতীতের সত্য রূপ ও বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটান জার্মান শিক্ষক Leopold on Ranke । ইংল্যান্ডেও এই শতাব্দীতে ‘ Law ‘ বা বিধি মেনে বিজ্ঞানভিত্তিক ইতিহাসের ধারণা গড়ে ওঠে । H T Buckle এই দৃষ্টিভঙ্গিতে রচনা করেন ‘ History of Civilisation in England ‘ । ইতিহাসে তথ্যের সুসংগঠন ও সামান্যীকরণ ( Generalisation ) গুরুত্ব পায় ।

Karl Lamprecht- এর ইতিহাসের ধারণায় সমষ্টিবদ্ধ সামগ্রিক সমাজজীবনের বিভিন্ন ঘটনাবলির কারণ অনুসন্ধান অধিকমাত্রায় প্রাধান্য পায় । তাই বলা হয় কার্যকারণ সম্পর্কের ভিত্তিতে উৎপত্তিঘটিত চেতনা ( Genetic Concept ) বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাসের ধারণা সৃষ্টি করে ।

শুধু ঘটনার কারণ অনুসন্ধানই নয় , হেগেল , সিলার , ক্রোসে , আনাতােল প্রমুখ ঘটনাটি কীভাবে ঘটল তা জানতে গিয়ে ইতিহাসে রহস্যবাদ কিংবা দুর্বোধ্যতার আশ্রয় নিয়েছেন । ভাববাদী দার্শনিক হেগেল – এর মতে ‘ পরমশক্তির ইচ্ছাই একমাত্র সত্য । তাই তাঁর মতে , ইতিহাস হল কালের সন্নিধানে পরম ইচ্ছার ক্রম উন্মেষণের কাহিনি । তাই ন ৷ তাই সভ্যতার বিবর্তনের ধারায় হেগেল – এর চিন্তাচেতনায় জার্মান জাতি হয়ে উঠেছে পরম শক্তির ইচ্ছার ধারক ও বাহক ।

হেগেল – এর ভাববাদী চেতনার প্রতিদ্বন্দ্বীরুপে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রবর্তক কার্ল মার্কস অদৃশ্য চেতন সত্তার স্থলে বস্তুসত্তাকেই সৃষ্টির মূল উপাদান রূপে গ্রহণ করেছেন । তাই মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিহাসের ধারণায় চেতনসত্তা ও বস্তুসত্তা প্রাধান্য পেয়েছে । তার মতে , দ্বন্দ্বমূলক বিকাশ পদ্ধতিতে বিমূর্তচেতন ( Abstract Idea ) থেকে মূর্তচেতনের ( Concrete Idea ) অভিব্যক্তি নয় , Concrete বা মূর্তচেতন থেকে বিমূর্ত ধারণার বিকাশ ঘটে । দ্বন্দ্বমূলক বিবর্তন ভাবজগৎ থেকে উদ্ভূত হয় না , জড় জগৎ থেকে উদ্ভূত হয় । মার্কস – এর মতে বস্তুজগৎ ও বাস্তব উৎপাদন সম্পর্কই সমাজের চালিকা শক্তি । তাঁর কথায় , আজ পর্যন্ত সমস্ত মানুষের ইতিহাস হল শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস ( History of Class Struggle ) ।

শােষক শ্রেণি ও শােষিত শ্রেণির পারস্পরিক সম্পর্কই হল থিসিস ও অ্যান্টি থিসিস । থিসিস ও অ্যান্টি থিসিসের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় সিনথেসিস । অর্থাৎ , পরস্পর দুই বিরােধী শক্তির ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্যে সমন্বয়ের বা সংশ্লেষণের মাধ্যমে সমাজ বিবর্তন সাধিত হয় । এইভাবে হেগেল ও মার্কসীয় চিন্তায় ঊনবিংশ শতাব্দীতে দ্বান্দ্বিকতা ইতিহাস চেতনায় এক নতুন মাত্রা পায় । ঊনবিংশ শতাব্দীর ইতিহাস সমাজবদ্ধ মানব প্রগতির ইতিহাস । সাংস্কৃতিক অগ্রগতি ইতিহাসের বিষয়বস্তু । যুথবদ্ধ । সমাজজীবনে তার বিপুল কর্মকাণ্ড ইতিহাসের উপজীব্য বিষয়বস্তু । ইতিহাসের মধ্য দিয়ে তাই সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি , পােশাক – পরিচ্ছদ , জমিজমা , চাষবাস , নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস , শাসনব্যবস্থা , আশা – আকাঙ্ক্ষা , চেষ্টা – কৃতিত্ব , হতাশা , ব্যর্থতা সবকিছুই সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে ।

আধুনিক ইতিহাস চেতনায় বিজ্ঞানচেতনা প্রতিফলিত । মানবসভ্যতার সূচনা , বিকাশ ও উন্নয়ন বা অগ্রগতি ইতিহাসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় । আধুনিক ইতিহাসের ধারণা বহু ব্যাপক । ইতিহাস তাই মানুষ ও তার সৃষ্ট সমাজের অগ্রগতির ধারক ও বাহক । সমাজ , রাজনীতি , অর্থনীতি , মনস্তত্ত্ব , ধর্মীয়জীবন , সাংস্কৃতিক পরিবেশ , ভৌগােলিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ , বিজ্ঞানচেতনা , জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চেতনা — সবকিছুই আধুনিক ইতিহাসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় । ইতিহাস হল মানুষের নিরবচ্ছিন্ন কর্মপ্রয়াস ।

E H Carr তাই মন্তব্য করেছেন History is a continuous process on unending dialogue between the present and the past . ” অর্থাৎ সময়ের নিরন্তর ধারায় মানুষের বিপুল কর্মপ্রবাহ ইতিহাসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ।

Rickman – এর কথায় , “ The whole historical world spreads before us as a field of human activity . ” starte ইতিহাসে সংঘবদ্ধ মানুষ ও তার কর্মকাণ্ড প্রতিফলিত হয় ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন,”” What men have done and said above all what they have thought — that is history . “”

ড . রমেশচন্দ্র মজুমদার তাই বলেছেন , “ ইতিহাস হল মানবসমাজের অতীতের কার্যাবলির বিবরণী ।

Related posts:

বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের জীবন কথা
পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী : 2024
চন্দ্রযান-3 : চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণকারী প্রথম দেশ ভারত
GENERAL STUDIES : TEST-2
GENERAL STUDIES : 1
কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স: 8ই সেপ্টেম্বর
'জ্ঞানচক্ষু' গল্পের নামকরণের সার্থকতা বিচার করো।
তপনের জীবনে তার ছোটো মাসির অবদান আলোচনা করো।
সমান্তরাল আলোকরশ্মিগুচ্ছ বলতে কী বোঝ ?
আলোকরশ্মিগুচ্ছ বলতে কী বোঝায় ? এটি কয়প্রকার ও কী কী ?
একটি সাদা কাগজকে কীভাবে তুমি অস্বচ্ছ অথবা ঈষৎ স্বচ্ছ মাধ্যমে পরিণত করবে ?
ঈষৎ স্বচ্ছ মাধ্যম কাকে বলে ? উদাহরণ দাও ।
অস্বচ্ছ মাধ্যম কাকে বলে ? উদাহরণ দাও ।
স্বচ্ছ মাধ্যম কাকে বলে ? উদাহরণ দাও ।
অপ্রভ বস্তুও কি আলোর উৎস হিসেবে কাজ করতে পারে?
বিন্দু আলোক - উৎস কীভাবে পাওয়া যেতে পারে ?
বিন্দু আলোক - উৎস ও বিস্তৃত আলোক - উৎস কী ?
অপ্রভ বস্তু কাকে বলে ? উদাহরণ দাও ।
স্বপ্নভ বস্তু কাকে বলে ? উদাহরণ দাও ।
দিনেরবেলা আমরা ঘরের ভিতর সবকিছু দেখতে পাই , কিন্তু রাত্রিবেলা আলোর অনুপস্থিতিতে কোনো জিনিসই দেখতে পা...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page