প্রশ্ন : শিখন অক্ষমতা কাকে বলে ? শিখন অক্ষমতার শ্রেণিবিভাগ করুন । এদের বৈশিষ্ট্যগুলি লিখুন । এদের কীভাবে চিহ্নিত করবেন ? এদের শিখনে শিক্ষক ও পিতামাতার ভূমিকা লিখুন ।
উত্তর : শিখন অক্ষমতা সম্পর্কে বিভিন্ন শিক্ষাবিদ ও মনোবিদগণ বিভিন্ন ধারণা পোষণ করেন । কোনো কোনো শিক্ষাবিদ ও মনোবিদদের মতে , শিখন অক্ষমতা বলতে বোঝায় । শিখনের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ধরনের সংবেদনমূলক , প্রত্যক্ষমূলক এবং জ্ঞানমূলক বৈশিষ্ট্যের অভাব । আবার অনেকে বলেন , শিক্ষার্থীর সামর্থ্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত শিক্ষাগত মাত্রার সঙ্গে শিখন পারদর্শিতার পার্থক্যই হল শিখন অক্ষমতা । শিখনের অক্ষমতাকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়—
(1) বাচনিক ও ভাষাগত বিকাশে অক্ষমতা ,
(2) শিক্ষাগত দক্ষতার অক্ষমতা এবং
(3) অন্যান্য শিখন অক্ষমতা ।
1. বাচনিক ও ভাষাগত বিকাশে অক্ষমতা : উচ্চারণ ও যোগাযোগের জন্য ভাষা ব্যবহারের সমস্যা এইসব শিশুদের মধ্যে দেখা যায় । এই সমস্যাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়—
(ক) উচ্চারণে অক্ষমতাঃ এই সমস্যাক্রান্ত শিশুরা উচ্চারণ এবং শব্দ নিয়ন্ত্রণের দিক থেকে সমবয়সি শিশুদের থেকে পিছিয়ে থাকে । Speech Therapy- র সাহায্যে এদের চিকিৎসায় সুফল পাওয়া যায় ।
(খ) ভাষা ব্যবহারে অক্ষমতা : শিখনে সমস্যাযুক্ত শিশুরা অনেকেই উপযুক্ত ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করতে অক্ষম । সমবয়সি সাধারণ শিশুদের অপেক্ষা ভাষা ব্যবহারের দক্ষতা এদের অনেক কম । এদের শব্দভাণ্ডারও অনেক কম ।
(গ) ভাষা অনুধাবনে অক্ষমতা : ভাষা ব্যবহারের মতো ভাষা বোঝা বা শব্দের অর্থ বোঝার ক্ষমতাও এদের কম ।
2. শিক্ষাগত দক্ষতার অক্ষমতা : শিক্ষাগত দক্ষতার ঘাটতির দিক থেকে এদের তিন ভাগে ভাগ করা যায়—
(ক) পঠনগত অক্ষমতা : পঠনগত অক্ষমতাকে Dyslexia বলে । এদের বৈশিষ্ট্য হল—
(i) পঠন অক্ষমতা (Dyslexia) সাধারণত ছেলেদের মধ্যে অধিক দেখা যায় । প্রতি চারজন পঠন অক্ষম শিক্ষার্থীদের মধ্যে তিনজনই ছেলে ।
(ii) অনেক সময়ই এরা স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন হয় ।
(iii) পঠনের সময় এদের সংবোধনে বিশেষ অসুবিধা দেখা যায় ।।
(iv) এদের মধ্যে উচ্চারণে অস্পষ্টতা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয় ।
(v) এদের ডান – বাম বোধ কম । শব্দের উৎস ডান দিকে না বাম দিকে এ সম্পর্কে তারা নিশ্চিত হতে পারে না । এই ধরনের অধিকাংশ শিশুই বাঁ – হাতি হয়ে থাকে ।
(vi) এরা খুব চঞ্চল প্রকৃতির হয় । এদের মধ্যে মনোযোগের অভাব দেখা যায় ।
(vii) এই ধরনের পঠন অক্ষমতা অধিক বয়স পর্যন্ত থাকতে পারে ।
(খ) লিখন অক্ষমতা : লিখন ক্ষমতা হাত , অঙ্গুলি সঞ্চালন এবং মস্তিষ্কের বিভিন্ন ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত । শব্দভাণ্ডার , ব্যাকরণ , স্মৃতি , হস্তচালনা প্রভৃতি ভাষামূলক , জ্ঞানমূলক ও দেহ – সঞ্চালনমূলক আচরণ লিখন ক্ষমতায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । এরমধ্যে একটি বা একাধিক আচরণের ত্রুটি বা অসম্পূর্ণতা লিখন অক্ষমতা সৃষ্টি করতে পারে ।
(গ) গাণিতিক অক্ষমতা : গাণিতিক অক্ষমতাও শিখন অক্ষমতার একটি শ্রেণি । সংখ্যা ও চিহ্নের পুনরুদ্রেক , বিন্যাস , স্মৃতি , আঙ্কিক বিমূর্ত বিষয় , যেমন — গাণিতিক প্রক্রিয়া ( যোগ , বিয়োগ , গুণ , ভাগ ) , ভগ্নাংশ , ছোটো – বড়ো সংখ্যা ইত্যাদির সঠিক ক্রিয়াকেই গণিত বলে । এই ক্রিয়াগুলির যে – কোনো একটি বা একাধিক প্রক্রিয়ার ত্রুটি বা অসম্পূর্ণতার কারণেই গাণিতিক অক্ষমতা সৃষ্টি হয় যাকে সাধারণত Dyscalculia বলে । উল্লেখ করা প্রয়োজন , শিখন অক্ষমতাযুক্ত একটি শিক্ষার্থীর মধ্যে যে – কোনো একটি বিষয়ে (পঠন , লিখন বা গণিত) বা একাধিক বিষয়ে অক্ষমতা দেখা যেতে পারে ।
3. অন্যান্য শিখন অক্ষমতা : অনেক সময় শিখন অক্ষমতা মস্তিষ্ক বা স্নায়ুতন্ত্রের ত্রুটির ফলে ঘটে না । বিকাশগত বা সঞ্চালনগত কারণই এরজন্য দায়ী । এই শ্রেণির শিখন অক্ষমতাকে পৃথকভাবে দেখা হয় ।
শিখন অক্ষমতাযুক্ত শিক্ষার্থীদের বৈশিষ্ট্য : শিখন প্রতিবন্ধিতার ধরন বহুমুখী । যেমন— কোনো কোনো শিখন প্রতিবন্ধীরও পঠনের অক্ষমতা থাকে , আবার কারও লিখনে অক্ষমতা দেখা যায় , কারও আবার ভাষার প্রকাশের ক্ষেত্রে সমস্যা থাকে , কারও হয়তো গাণিতিক হিসাবের ক্ষেত্রে অক্ষমতা দেখা যায় । এইভাবে দেখা যায় , শিখন প্রতিবন্ধী শিশুদের মধ্যে বিচিত্র ধরনের অক্ষমতা থাকে । তাই শিখন প্রতিবন্ধীদের বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করা একটি জটিল কাজ । 1966 খ্রিস্টাব্দে Clement সর্বপ্রথম শিখন প্রতিবন্ধীদের বৈশিষ্ট্য নিরূপণের চেষ্টা করেন । তিনি শিখন প্রতিবন্ধীদের দশটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেন । যেমন—
(i) অতি সক্রিয় আচরণ (Hyperactivity) ।
(ii) বোধগম্যতার সঙ্গে সম্পর্কিত স্বতশ্চলন ক্রিয়ায় সমস্যা (Perceptual motor impairment) ।
(iii) প্রাক্ষোভিক পরিবর্তনশীলতা (Emotional liability) ।
(iv) সাধারণ সমন্বয়ের অভাব (General co – ordination deficits) ।
(v) বিক্ষিপ্ত মনোযোগ (Disorders of Attention) ।
(vi) আবেগপ্রবণতা (Impulsivity) ।
(vii) স্মৃতি ও চিন্তনের বিক্ষিপ্ততা (Disorders in Memory and Thinking) ।
(viii) সুনির্দিষ্ট শিখন অক্ষমতা (Specific Learning Disability) ।
(ix) কথা বলা এবং শিখনের ক্ষেত্রে সমস্যা (Disorders in Speech and Learning) ।
(x) দ্ব্যর্থক স্নায়বিক আচরণ (Equivocal Neurological Signs) ।
শিখন অক্ষমতাযুক্ত শিক্ষার্থীদের চিহ্নিতকরণ : পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে , শিখন অক্ষমতা নানাভাবে প্রকাশ পেতে পারে । কারও পঠনে অক্ষমতা , কারও লিখনে অক্ষমতা , কারও বা গণিতে অক্ষমতা থাকে । অর্থাৎ 3R- এর মধ্যে (Reading , Writing এবং Arithmetic) যে – কোনো একটি বা একাধিক ক্ষেত্রে অক্ষমতাকে শিখন অক্ষমতা বলা যায় । শিখন অক্ষমতাযুক্ত শিশুদের বিশেষ শিক্ষা এবং নির্দেশনার জন্য প্রথমেই চিহ্নিত করা প্রয়োজন । সাধারণত যে তিনটি শিক্ষাগত বৈশিষ্ট্যের প্রেক্ষিতে এদের চিহ্নিত করা হয় , সেগুলি হল—
(ক) এদের সামর্থ্য বা ক্ষমতা এবং শিখন পারদর্শিতার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য দেখা যায় ।
(খ) এই শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শিখন পারদর্শিতা নিম্ন মানের হয় ।
(গ) এদের শিখন পারদর্শিতার উপর লেখচিত্র অঙ্কন করলে দেখা যাবে যে লেখচিত্রটি অনিয়মিত ।
উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি ছাড়াও শিখন অক্ষমতাযুক্ত শিক্ষার্থীদের আচরণের উপর একাধিক সমীক্ষা করে নিম্নলিখিত আচরণগুলিকে নির্দিষ্ট করা গেছে—
(1) বুদ্ধি বা সাধারণ ক্ষমতার দিক থেকে এরা স্বাভাবিক বা স্বাভাবিকের থেকে কিছু বেশি – কম হতে পারে ।
(2) এদের মধ্যে অস্থিরচিত্ততা বিশেষভাবে দেখা যায় ।
(3) কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে এরা মনঃসংযোগ করতে পারে না । এদের মনোযোগ খুব দ্রুত বিষয়ান্তরে চলে যায় ।
(4) এদের চিন্তা করার ক্ষমতা কম এবং এক বিষয় থেকে অন্য বিষয়ে চিন্তা করতে এরা অক্ষম ।
(5) এদের প্রত্যক্ষণের ক্ষমতা দুর্বল ।
(6) কোনো বিষয় যদি কিছুটা অন্যভাবে উপস্থিত করা যায় তাহলে এরা তা গ্রহণ করতে পারে না ।
(7) ডান – বাম , উঁচু – নীচু এই ধারণা অনেক সময় এদের থাকে না ।
(8) এদের কোনো কিছু বোঝার ক্ষমতা এবং স্মৃতিশক্তি দুর্বল ।
(9) কোনো বিষয় বা ঘটনাকে এরা সংব্যাখ্যান করতে পারে না । চাক্ষুষ প্রতিচ্ছবি এরা স্মরণে রাখতে পারে না ।
(10) এদের মধ্যে ভাষাগত দক্ষতার অভাব দেখা যায় ।
(11) অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এরা চেষ্টা এবং ভুল পদ্ধতির মাধ্যমে শেখে ।
(12) এদের মধ্যে বিমূর্ত চিন্তনের অক্ষমতা বিশেষভাবে প্রকট হয় ।
(13) পঠনের সময় কোনো কোনো শব্দ এরা বাদ দেয় আবার কোনো কোনো শব্দ যুক্ত করে ।
(14) দুটি শব্দের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষমতা এদের মধ্যে প্রায়শই থাকে না ।
(15) বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক চিহ্ন , যেমন — < > = প্রভৃতির সম্পর্ক এরা বুঝতে পারে না ।
(16) এদের আগ্রহের ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ এবং মনোযোগের পরিসর অল্প ।
(17) এরা সহজেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে ।
(18) এরা সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং পেশিগত ভারসাম্য রক্ষা করার ক্ষেত্রে দুর্বল ।
শিখন অক্ষমতা এবং শিক্ষক ও পিতামাতার ভূমিকা : শিখন অক্ষমতাযুক্ত শিক্ষার্থীদের নির্দেশনায় শিক্ষক ও পিতামাতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা উল্লেখ করা হল—
পিতামাতার ভূমিকা
(ক) সন্তান যে প্রকৃতির শিখন অক্ষমতায় আক্রান্ত সে সম্পর্কে বিশদ তথ্য অবগত হতে হবে । এদের পরিচর্যা , যত্ন এবং এই অক্ষমতার জন্য কী কী করণীয় সে সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে হবে ।
(খ) শিশু কোন্ বিষয়ে আগ্রহী তা জেনে নিয়ে দৈনন্দিন কার্যাবলিকে সেইভাবে বিন্যস্ত
(গ) পাঠ্যবিষয় এবং দৈনন্দিন জীবনে আবশ্যকীয় কাজগুলিকে ছোটো ছোটো অংশে ভাগ করে তাদের শেখাতে হবে । সবসময় এদের প্রশংসা করতে হবে । কখনোই এইসব শিশুদের অক্ষমতাকে উপহাস করা চলবে না । পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা যাতে এ বিষয়ে অবগত থাকেন সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে ।
(ঘ) বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে সর্বদা যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে হবে । শিক্ষকদের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে ।কোনোরকম অসুবিধা হলে শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ।
শিক্ষকের ভূমিকা : শিখন অক্ষমতাযুক্ত শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ব্যাপারে বিশেষ শিক্ষায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষকদের ভূমিকাও তাৎপর্যপূর্ণ । এইগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল
(ক) শিক্ষককে শিখন অক্ষমতা সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে ।
(খ) এই ধরনের শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্টকরণে সাহায্য করতে হবে ।
(গ) সমস্যা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর সাধারণ শিক্ষাদানের পাশাপাশি সংশোধনমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে ।
(ঘ) শিখন অক্ষমতাযুক্ত শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জন্য নতুন নতুন যন্ত্র ও কৌশল ব্যবহার করতে হবে । এইসব যন্ত্র ও কৌশল ব্যবহারের পূর্বে এগুলির প্রয়োগ – কৌশল সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে ।
(ঙ) শিক্ষার্থীদের নিয়মিতভাবে মূল্যায়ন করে কোন কোন কর্মসূচিতে তার উন্নতি ঘটেছে এবং কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে সমস্যা রয়ে গেছে সে সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে । এ ব্যাপারে শিক্ষক বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নেবেন ।
(চ) শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে শিক্ষক পরামর্শসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন ।
(ছ) প্রতিটি শিখন অক্ষমতাযুক্ত শিক্ষার্থীর জন্য সংশ্লিষ্ট অক্ষমতা দূরীকরণে মাত্রা স্থির করে আচরণ সংশোধনের কৌশল প্রয়োগ করলে সুফল পাওয়া সম্ভব । এক্ষেত্রে শিক্ষক অভিজ্ঞ ব্যক্তির সঙ্গে পরামর্শ করবেন ।
(জ) সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর পিতামাতার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে পিতামাতাদের কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত করতে হবে । পরামর্শ অনুযায়ী পিতামাতারা তাদের ভূমিকা ঠিকমতো পালন করছেন কিনা সে সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে । পরিশেষে বলা যায় যে , যথেষ্ট ধৈর্যসহকারে , ধীরে ধীরে , মানবিকতার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই শিক্ষার্থীদের পরিচালনা করলে অবশ্যই সুফল পাওয়া যাবে ।