প্রশ্ন : শিক্ষণবিজ্ঞান ( Pedagogy ) কাকে বলে ? এর বৈশিষ্ট্য , লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলি লিখুন ।
উত্তর : শিক্ষণবিজ্ঞান হল কার্যকরী শিখনের প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতাসমূহের সমন্বয় । শিক্ষণবিজ্ঞানের আদি বা ঐতিহ্যগত তথ্য অনুযায়ী শিক্ষণবিজ্ঞানকে একটি বিজ্ঞান বা তত্ত্ব অথবা একটি কলা বা শিক্ষকের অনুশীলন বলে ধরা হত যা শিক্ষার্থীর বৌশিক ও সামাজিক বিকাশক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত । শিক্ষণবিজ্ঞান বা ‘Pedagogy’-এর ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক গবেষণায় এটিকে একটি তথ্যগত উপলব্ধি ও বাস্তব দক্ষতার উচ্চমানের জটিল । সংমিশ্রণ বলা হয়েছে ।
শিক্ষণবিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্যসমূহ ( Features of Pedagogy ) শিক্ষণবিজ্ঞানের কতকগুলি উপাদান বা বৈশিষ্ট্য বর্তমান । এগুলি হল—
1. ভক্তিগত নীতি অর্থাৎ শিক্ষণের নীতি ( Maxims of Teaching ) : শিক্ষণের নীতিগুলির সম্পর্কে আমাদের সকলেরই কমবেশি ধারণা আছে । অর্থাৎ পাঠদানকালে শিক্ষক কতকগুলি বিশেষ নীতির ভিত্তিতে আলোচনা করেন । এগুলি হল — জানা থেকে অজানার দিকে , সহজ থেকে কঠিনের দিকে , সরল থেকে জটিলের দিকে , মূর্ত ধারণা থেকে বিমূর্ত ধারণার দিক , মনোবিজ্ঞানগত ধারণা থেকে যৌক্তিক ধারণার দিকে , অভিজ্ঞতাপ্রসূত ধারণা থেকে যৌক্তিক ধারণার দিকে , বিশ্লেষণধর্মী চিন্তা থেকে সংশ্লেষণধর্মী চিন্তার দিকে , সমগ্র থেকে অংশের দিকে , নির্দিষ্ট ধারণা থেকে প্রতিনিধিত্বমূলক ধারণার দিকে অগ্রসর হওয়ার । কথা বলে । শিক্ষণবিজ্ঞানের অন্যতম বিশেষ দিক হল এই ধারণা । এই ধারণাগুলি পরস্পর সম্পর্কিত এবং শিক্ষণবিজ্ঞান-এর উপর নির্ভরশীল ।
এ ছাড়াও শিক্ষণের কতকগুলি নীতি এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত । যেমন — কাজ করার মাধ্যমে শেখা , যথাযথ প্রেষণার জাগরণ ঘটানো , স্ব – শিক্ষার নীতি , ব্যক্তিগত পার্থক্যের নীতি , ভূমিকায়নের নীতি , সম্মেলনের নীতি , প্রস্তুতির নীতি , পুনরাবৃত্তির নীতি , পরিবর্তনের নীতি , প্রতিসংকেত ও উৎসাহদানের নীতি , সচেতনতার নীতি , দলগত বৈচিত্র্যের নীতি এবং সৃজনশীলতার নীতি । এগুলি শিক্ষণবিজ্ঞানকে কার্যকরী ও যথার্থভাবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি । এই নীতিগুলি শিক্ষাবিজ্ঞানের মনোবৈজ্ঞানিক নীতি হিসেবে পরিচিত ।
2. পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি ( Planning and Preparation ) : শিক্ষণবিজ্ঞানের অপর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল যথাযথ পদ্ধতিমাফিক পরিকল্পনা এবং উপযুক্ত প্রস্তুতি নির্মাণ । যথার্থ পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি ছাড়া শিক্ষণবিজ্ঞান প্রয়োগ সম্ভবপর নয় ।
3. কাজের ইচ্ছা ( Desire to work ) : শিক্ষণবিজ্ঞান এমন হবে যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে কাজের ইচ্ছার জন্ম দেবে । শিক্ষার্থীরা যে কাজে অগ্রসর হবে তা যেন তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ও ভালোবাসার সঙ্গে করতে পারে ।
4. সুস্পষ্ট চিন্তন ক্ষমতার বিকাশ ( Developing capacity for clear thinking ) : শিক্ষণবিজ্ঞান শিক্ষার্থীর মধ্যে সুস্পষ্ট চিত্তন ক্ষমতার বিকাশ ঘটাবে । যে – কোনো বিষয় সম্পর্কে তারা আলোচনা করুক । তাদের চিন্তন প্রক্রিয়া হবে সুস্পষ্ট এবং ভাবপ্রকাশ হবে স্বচ্ছল ।
5. শিক্ষার্থীর জ্ঞানের পরিধির বিকাশে ( Expand the range of students interest ) : শিক্ষণবিজ্ঞান শিক্ষার্থীর আগ্রহের পরিধিকে বিস্তৃত করবে । শিক্ষার্থীদের একটি করে পিরিয়ড বিদ্যালয়ে দেওয়া হবে যাতে তারা স্বাধীনভাবে তাদের পছন্দের কার্যকলাপগুলি সম্পন্ন করতে পারে । এগুলি তারা শিক্ষকের তত্ত্বাবধানেই সম্পন্ন করবে ।
6. ভিন্নধর্মী সুযোগ সৃষ্টি ( Provide numerous opportunities ) : শিক্ষার্থীদের বিভিন্নরকম প্রকল্প ও ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করে দিতে হবে । বাস্তব জ্ঞান যাতে শিক্ষার্থীরা প্রয়োগ করতে পারে এবং পুথিগত বিদ্যাকে যাতে সক্রিয়ভাবে ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারে তার জন্য শিক্ষণবিজ্ঞান উপযুক্ত সুযোগ সৃষ্টি করবে ।
এ ছাড়াও এর আরও কতকগুলি বৈশিষ্ট্য বর্তমান—
1. এটি শিক্ষণের বিষয়বস্তু নির্বাচন , বিন্যাস ও বিষয়বস্তুর উপস্থাপনকে বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিতে অধ্যয়নে সহায়তা করে এবং শিক্ষণকে আরও উন্নত রূপদান করা যায় ।
2. শিক্ষণের নীতি ও কৌশলগুলিকে যথাযথভাবে প্রয়োগ দ্বারা শিক্ষণ প্রক্রিয়াকে উন্নত করা যায় ।
3. শিক্ষণ প্রক্রিয়ার উন্নয়নের মাধ্যমে কার্যকরী শিখনকে সম্ভবপর করা যায় । দক্ষতার অনুশীলন করা যায় ।
4. শিক্ষণ প্রক্রিয়াকে কতকগুলি দক্ষতায় বিশ্লেষণ করে দক্ষতার অনুশীলন করা যায় ।
5. শিক্ষণবিজ্ঞান শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দান করে ।
6. এর লক্ষ্যগুলি স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট হয় ।
7. শিক্ষণবিজ্ঞান নির্দিষ্ট নিয়ম , নীতি , কৌশলের প্রয়োগে সুযোগ রাখলেও শিক্ষকের নিজস্ব স্বতন্ত্রতা প্রয়োগের সুযোগ থাকে ।
• শিক্ষণবিজ্ঞানের লক্ষ্য ( Aims of Pedagogy ) শিক্ষণবিজ্ঞানের কতকগুলি লক্ষ্য শিখনের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই । এগুলি হল নিম্নরূপ—
1. শিক্ষণবিজ্ঞান শিক্ষার্থীর প্রেষণা বজায় রাখা , উৎসাহ ও উদ্দীপনাদানে কাজ করবে ।
2. শিক্ষণবিজ্ঞানের অন্যতম লক্ষ্য হল পরিকল্পনামাফিক শিক্ষণ প্রক্রিয়ার সৃষ্টি ।
3. শিক্ষণবিজ্ঞান শিক্ষার্থীর প্রেক্ষাপট , অভিজ্ঞতা , মেধা ও দুর্বলতাগুলি নির্ণয়ে সক্ষম হবে এবং শিক্ষাকে যথাযথভাবে পরিচালনায় সহায়তা করবে ।
4. শিক্ষণবিজ্ঞান শিক্ষার্থীর মধ্যে যথাযথ ও কাম্য আচরণ সৃষ্টি করে ।
5. শিক্ষণবিজ্ঞান শ্রেণিকক্ষে সকল শিক্ষার্থীকে সক্রিয়ভাবে পাঠে অংশগ্রহণের উপযুক্ত পরিসর সৃষ্টি করবে ।
6. শিক্ষককে কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা পদ্ধতিতে আবদ্ধ না রেখে প্রয়োজনে আন্তরবিষয়ভিত্তিক শিক্ষণে সহায়তা করবে ।
7. শিক্ষণবিজ্ঞান শিক্ষণ – শিখনকে নমনীয় অংশগ্রহণমূলক মিথস্ক্রিয়াভিত্তিক ও অত্যাধুনিক করে তুলতে সহায়তা করবে ।