ভূতের গল্প : রাত তখন এগারোটা

কোন এক দেশে এক ব্রাহ্মণ বাস করত । তার একটি বৌ ছিল । তারা ব্রাহ্মণের মায়ের সঙ্গে একই বাড়িতে বাস করত । তাদের বাড়ির অদূরে একটি দীঘি ছিল । দীঘিটির গা – ঘেঁষে একটি সুউচ্চ ও ঝাঁকড়া গাছ ছিল । তার ডালে বাস করত শাঁকচুন্নি ।ব্রাহ্মণের বৌ একদিন অনেক রাতে ঘঁড়া নিয়ে দীঘিতে জল আনতে গেল । ঘুটঘুটে অন্ধকার । ফেরার সময় দেখতে না পেয়ে সে শাঁকচুন্নির গা ছুঁয়ে ফেলল । ব্যস , আর যাবে কোথায় ! শাঁকচুন্নি রেগেমেগে একেবারে কাঁই হয়ে গেল । অতর্কিতে বৌটির গলা টিপে ধরল । এক ঝটকায় তাকে একেবারে গাছের ওপরে তুলে নিয়ে গেল । গাছের একটি বড়সড় কোটরে লুকিয়ে রাখল ।এবার শাঁকচুন্নী ব্রাহ্মণের বৌয়ের কাপড়চোপড় পরে , শাঁখা – চুড়ি হাতে দিয়ে , রীতিমত বৌটি সেজে ব্রাহ্মণের বাড়ি ঢুকল জলের ঘড়া কাঁখে নিয়ে , ব্রাহ্মণ বা তার মা কেউ – ই এরকম অদলবদলের কথা কিছুমাত্র ধরতে পারল না ।রাত্রিটা নির্বিঘ্নেই কাটল । সকাল হল । বৌয়ের চালচলন শাশুড়ির কাছে কেমন যেন একটু অস্বাভাবিক মনে হল । তার বৌটি ছিল পেকাঠির মত রােগা । খুবই দুর্বল । সব কাজকর্মে কেমন ঢিলেঢালা ভাব । আজ সে বৌ – ই কিনা হঠাৎ কেমন চটপটে হয়ে গেছে । মুহূর্তে এক একটি কাজ চোখের পলকে সেরে ফেলছে । ব্যাপার কি ?আসল ব্যাপার সম্বন্ধে বুড়ির মনে কিছুমাত্রও সন্দেহ হয়নি । বরং হঠাৎ বৌয়ের কর্মতৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় বুড়ি বরং খুশিই হয়েছে ।দিন যত যায় বুড়ি বৌয়ের ব্যবহারে ততই অবাক হতে লাগল । রান্না ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই রান্না – বান্না শেষ । আবার এমনও দেখা গেছে পাশের ঘর থেকে কোন জিনিস আনতে বলা হলে , সেখানে হেঁটে যেতে যতখানি সময় লাগার কথা তার চেয়ে অনেক , অনেক কম সময়ে বৌ জিনিসটা এনে হাতে তুলে দেয় । ব্যাপার – স্যাপার দেখে বুড়ি চোখ দুটো কপালে ওঠার উপক্রম । বুড়ি বৌকে এ ব্যাপারে কিছুই বলল না । ধৈর্য ধরে রইল । ছেলে কাজ সেরে বাড়ি ফিরলে আড়ালে গিয়ে নিচু গলায় সব বলল , এবার থেকে ছেলে এবং মা উভয়েই বৌয়ের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখতে লাগল ।বুড়ি একদিন দেখল , বাড়িতে আগুন নেই । তখনকার মানুষ দেশলাইয়ের কথা ভাবতেই পারত না । তাই কারাে আগুন নিভে গেলে অন্য বাড়ি থেকে চেয়েচিন্তে এনে কাজ চালাতে হত । বাড়িতে আগুন নেই । বৌ – ও মুহূর্তের জন্যও বাড়ি থেকে বেরােয় নি । অথচ আশ্চর্য ব্যাপার । হঠাৎ দেখা গেল রান্নাঘরের উনুনটি দাউ দাউ করে জ্বলছে । ব্যস্ত পায়ে শাশুড়ি ছুটে গিয়ে রান্না ঘরের দিকে গেল । দরজার কাছে পৌঁছতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল । নিজের চোখ দুটোর ওপরও যেন আস্থা হারিয়ে ফেলেছে । দেখছে , কাঠের পরিবর্তে তার বৌমা নিজের ইয়া লম্বা ঠ্যাংটি উনুনে গুঁজে দিয়েছে । কপালে হাত দিয়ে বুড়ি দরজায় বসে পড়ল । পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে গুটিগুটি নিজের ঘরে চলে গেল , আতঙ্কে তার হাত – পা পেটের মধ্যে সিঁধিয়ে যাবার উপক্রম হল ।ছেলে বাড়ি ফিরল । বুড়ি হন্তদন্ত হয়ে তার ঘরে গিয়ে সব কথা খুলে বলল । দীর্ঘ আলােচনার পর তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছল , এ আসল বৌ হতেই পারে না । নির্ঘাৎ পেতনী – টেতনী কিছু হবে ।এখন উপায় ? উপায় অবশ্যই করতে হবে । ওঝা ডাকা হল । ওঝা ভেবে চিন্তে বলল — ‘সবার আগে দেখা দরকার , উনি আসলে মানুষ , নাকি পেত্নী । এক টুকরাে হলুদ আগুন ধরিয়ে ওনার নাকের কাছে ধরতে হবে । একেবারে অব্যর্থ দাওয়াই । ছেলে বা মেয়ে যা-ই ভূত হােক না কেন কোন ভুতের পক্ষেই হলুদ পােড়া সহ্য করা সম্ভব নয়।কার্যতঃ হলও তা – ই । হলুদের টুকরাে পুড়িয়ে বৌয়ের নাকের কাছে ধরতেই সে বিকট আর্তনাদ করে সেখান থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করল । আতঙ্কে তার সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপতে লাগল । এবার আর কারাে মনে কিছুমাত্র দ্বিধা রইল না , এ ব্রাহ্মণের বৌ নয় , সাক্ষাৎ ভূত । মা ও ছেলের তাে চক্ষু স্থির । পেতনী বৌ ছুটে পালাতে চাইলে ওঝা এক লাফে তার চুলের মুঠি ধরে বলল , ‘বল তুই কে ? এখানে কি করতে এসেছিস ? বল , কে তুই ?’ বৌ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল । টু – শব্দটিও করল না । ওঝা পা থেকে চটি খুলে পেতনী বৌয়ের আগা – পাছতলা এলােপাথারি পেটাতে লাগল । পেতনী হতচ্ছাড়ি এমনপিটুনি জীবনে কোনদিন খায় নি ।শেষ পর্যন্ত অতিষ্ঠ হয়ে নাকি সুরে সে বলতে লাগল — ওস্তাদের বেটা ছাঁড়ান দেঁ , সঁবই কঁইছি । গাঁ থেঁকে ছাঁল চাঁমড়া ছাঁড়িয়ে নিঁলি দেঁখছি । ওঁরে বাঁপ রেঁ বাঁপ ! কী সঁর্বনেশে কাঁণ্ড বাঁধালাে রে বাঁবা ! বিঁশ্বাস কঁর আঁমি আঁদৌ খাঁরাপ টাঁরাপ কিছু নই । নিঁর্ভেজাল শাঁকচুন্নি । দীঁঘির ধাঁরে ওঁই যেঁ বেঁলগাছটা রঁয়েছে ওঁখানে আঁমার আঁস্তানা । আঁমি বাঁমুনের বৌঁকে ওঁই গাঁছের কোঁটরে সিঁধিয়ে রেঁখেছি । ওঁই হঁতচ্ছাড়ি রেঁতের বেঁলায় আঁমায় ছুঁয়ে দিঁয়েছিল কেন ? তাঁই তোঁ আঁমি সুঁযােগ পেঁয়ে গেঁলাম । কেঁন সিঁধিয়ে রাঁখবাে নাঁ , বঁলতে পাঁর ? বঁলেই তোঁ দিঁলাম । যাঁও , যেঁ কেঁউ গিঁয়ে তাঁকে নাঁমিয়ে আঁন গেঁ । আঁ ! আঁর মাঁরিস নেঁ রেঁ বাপ ! পঁরাণটা আঁমার বেঁরিয়ে গেঁল রেঁ !শাঁকচুন্নীকে ওঝা তবু ছাড়ল না । ব্রাহ্মণ একছুটে দীঘির ধারের ওই বেলগাছটার কাছে গেল । গাছে উঠে কোটরের ভেতর থেকে আধমরা বৌকে বের করে বাড়ি নিয়ে এল ।ওঝা এত সহজে শাঁকচুন্নীকে ছাড়বার পাত্র নয় । আর এক দফা চটিপেটা করে মনের ঝাল মিটিয়ে নিল । তারপর নিজের গা ছুঁয়ে তাকে দিয়ে শপথ করিয়ে নেওয়া হল , আর কোনদিন ব্রাহ্মণের বৌয়ের বা তাদের পরিবারের কারাে সামান্যতম ক্ষতিও করবে না । কাজ শেষ করে ওঝা মন্ত্র খুলে তাকে মুক্তি দিল ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page