তারু-মনার আঙ্গিনায় আষাঢ়ে গল্পের আসর- সবাই এসেছিল, ওরাও এসেছিল ।আমার আষাঢ়ে গল্প কেউ বিশ্বাস করেনি- জানি আপনারাও করবেন না। এরা সবাই আমাদের ভূত বন্ধু। প্রায়ই আসে আড্ডা দিতে। গল্প আর জোকস শুনতে খুব ভালবাসে ওরা।
বিশেষ করে শহিদের জোকসগুলো ওদের খুব পছন্দ। তারুর ক্যামেরায় ছবি ওঠানোটা খুব একটা পছন্দ করে না। কারণ এক এক জনের চেহারা তো বিটকেল, হাসলে পরে আরো ভয়াবহ। আমার ওরকম চেহারা হলে আমিও ফটো তুলতে রাজি হতাম না।
তবে তারুর ক্যামেরায় একটা গোস্ট মোড আছে, ওটা দিলেই বাছাধনদের আর লুকাবার উপায় নেই। কাবেরীর গান শুনে একটা মামদো ভূত তো পাগল! বলে কিনা ওকে ধরবে,ভাগ্যিস ওর চুল খোলা ছিলনা।
অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে ভূতটাকে বিদায় করেছি। তবে বলেছে এখন থেকে কাবেরীর কোনো গানের অনুষ্ঠান থাকলে যেন ওকে খবর দেয়া হয়। একদম সামনে বসে আছে হিড়িম্বা ভূত। হিড়িম্বা বেশী কথা বলেনা।
শুধু মনার বানানো আমের চাটনি খুব পছন্দ। তবে দাঁত নেই বলে খেতে পারেনা- চুষে চুষে আবার গামলায় রেখে দেয়। এতগুলো মানুষকে এঁটো খাবার খাওয়ানোর জন্য অনেক বকাঝকা করেছি। কে শোনে কার কথা। বলে,”কিঁস্সুঁ হঁবেঁ নাঁ।” ধমকে উঠলাম, “বলে দেবো কিন্তু সবাইকে।” কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে কিনা, “বঁলেঁইঁ দ্যাঁকোঁ দ্যাঁকোঁ, কেঁউঁ বিঁশ্বাঁসঁ কঁরঁবেঁনাঁ।”
ভূতদের কতগুলো ব্যাপার খুব অদ্ভুত! যেমন ওদের কোনো জাতীয়তা বোধ নেই। কেন? বাঙালী মরে ভূত হলে সে তো হবে বাঙালী ভূত, বিহারী মরলে বিহারী ভূত, আমেরিকান মরলে আমেরিকান ভূত হবার কথা। কিন্তু না- ওসব হচ্ছে না। কারণ, ভূত হবার পর ওদের নাকি কোনো দেশ,সীমানা,বর্ডার, ইমিগ্রেশন এসব কিছুই থাকছে না।
যখন যেখানে খুশি যেতে পারছে, থাকতে পারছে যতদিন খুশি। তার মানে সারা পৃথিবীটাই ওদের দেশ। অনেকটা জন লেননের ‘ইমাজিন’ গানটার মত। জিজ্ঞেস করেছিলাম ভাষার ব্যাপারে।ভূত বলল, “আমরাতো কথা বলি টেলিপ্যাথির মাধ্যমে, ভাষা সেখানে কোনো বিষয় না।” অতএব ভূতদের ভাষা ভিত্তিক বিভাজনও নেই। আর ধর্ম? সেটাতো ইহলোকের ব্যাপার।
ভূতটা বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,” লালন শা’র গানটা মনে নেই? মরলে পাবে বেহেস্ত খানা,তা শুনেও যে মন মানেনা। বাকির লোভে নগদ পাওনা কে ছাড়ে এ ভূবনে। পরলোকে আমাদের কোনো কনফিউশান নেই।” কিন্তু মানুষ থেকে উৎপত্তি অথচ বিভাজন, বিভেদ নেই এটাতো হতে পারেনা।
ভূত বলল, “আছে। ভূত দু’রকম-ভাল এবং মন্দ।” জিজ্ঞেস করলাম, “সেটা কি রকম?” ভূতের উত্তর, “যারা ইহজীবনের লোভ, লালসা, ক্রোধ, মোহ এসব পুরোপুরি ত্যাগ করতে পারেনা তারাই মন্দ ভূত।
যখন তখন মানুষের ওপর ভর করে তাদের দিয়ে মন্দ কাজ করায়।” বললাম, “তাহলে চারদিকে যে সব অপকর্ম ঘটছে এগুলো কি ভূতদের কারসাজী?” ভূত বলল, “অবশ্যই।একবার মানুষের কাঁধে সওয়ার হতে পারলে ছাড়ানো মুশকিল।
শক্তিশালী ওঝা না হলে এবং সঠিক ভাবে ঝাড়তে না পারলে সেই মানুষকে সুস্থ করা কঠিন কাজ।” আমি বললাম ,”তার মানে সরিষা পোড়া, মরিচ পোড়া, ঝাড়ু দিয়ে পেটানো এসব?” ভূতটা প্রচন্ড তাচ্ছিল্যের সাথে বলল, ”আঁরে না না,ওসব তো পুরানো প্রথা। তোমাদের গ্রাম্য কবিরাজের দেয়া পোষ্টাই আমার মালিশ। গ্রামের যুবতী মেয়েদের ওসব দেয়া হত। এখন দরকার আধুনিক পদ্ধতি। যেমন,পুলিশের রিমান্ড, র্যাবের ডান্ডা, টিয়ার গ্যাসের ঝাঁজ, সাউন্ড বোমার কান ফাটানো আওয়াজ…।
ভূত আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, থামিয়ে দিয়ে বললাম, ”আচ্ছা এই হেফাজতের শফি হজুরের ব্যাপারটা কি জানো? বুড়ো বয়সে ওনার এটা কি ধরনের ভীমরতি?” খানিক্ষণ চুপ করে থেকে ভূত বলল, “ওনার কেসটা জটিল।
কাহিনী একটু লম্বা, সময় নিয়ে বলতে হবে।” আমি বললাম, ”আরে বলই না। তোমার আবার তাড়া কিসের?” ভূত বলল,”তাড়া তো আমার নয় তোমার। হুজুরের গল্প শুনে কোথাও ওগরাতে গেলে তোমাকেই তাড়া করবে হেফাজত।” ভূতের কথা শুনে আঁতে ঘা লাগলো। সদর্পে বললাম, ”আরে রাখো তোমার হেফাজত।
দেখলাম তো,মাঝরাতে নিতম্বে পুলিশের সুন্দি বেতের বাড়ি খেয়ে ঝোলা পাঞ্জাবীর নীচে ভারত নাট্যমের ছন্দে কোমর দুলিয়ে পালিয়ে যেতে। ঠ্যালায় পড়লে ওসব জেহাদী জোস বেশীক্ষণ থাকেনা।” ভূতটা খ্যাক খ্যাক করে হাসতে হাসতে বলল,”ঠিক ধরেছো। ওটাই হচ্ছে মডার্ন চিকিৎসা পদ্ধতি।” ভূতটা বেশ যুত করে আমার জানালার কার্নিশে বসে বলল, “বেশ তাহলে গোড়া থেকেই বলি … মামদো ভূত এর পর যে দীর্ঘ ঘটনার বিবরণ দিয়েছিল সেটা সংক্ষেপে এরকম-
শফি হুজুর মাদ্রাসার ছাত্র জীবনে বরাবর হোষ্টেলে কাটিয়েছেন। পাশ-টাশ করার পর বাড়ী ফিরলে মা বাবা বিয়ের কথা তুললেন। কিন্তু ছেলে তো বিয়ের ব্যাপারে উদাসীন। অনেক ধরা-ধরি ও তদ্বিরের পর শফি হুজুর স্বীকার করলেন যে মেয়েদের তার ভাল লাগেনা। মেয়েরা নাকি পাপের ভান্ড।
সব পাপ কর্মের উৎপত্তি স্থল, ইত্যাদি ইত্যাদি । যা হোক বিয়ে তবুও ঠিক হল কিন্তু বিয়ের রাতেও শফি হুজুর বাসর ঘরে ঢুকলেন না। চলে গেলেন মক্তবের ছাত্রাবাসে। সেখানে তরুণ ছাত্রদের সাথে থাকাই তার পছন্দ। এভাবে দিন যায়। এক সময় অবহেলা সইতে না পেরে সেই বউ ফলিডল খেয়ে আত্মহত্যা করল।
মরার আগে শাশুড়ির কাছে কি সব কথা জানিয়ে গিয়েছিল সেটা আর প্রকাশিত হয়নি। সামাজিক লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে ব্যাপারটা ধামাচাপা দেয়া হয়েছিল। এদিকে হল কি বউটা মরে গিয়ে পেত্নি হয়ে গেল।
অপঘাতে মৃত্যু তো। পেত্নি হলেও তার ইহজীবনের আক্রোশ থেকে গিয়েছিল শফি হুজুরের ওপর। বাড়ির পাশেই ছিল একটা ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছ। কে না জানে ভূতরা তেঁতুল গাছে থাকতে ভালবাসে।
তো সেই পেত্নি বউ সেই তেঁতুল গাছে থাকতে লাগলো। আগেই বলেছি ভূতদের সব জায়গায় অবাধ যাতায়াত। বোরখাও লাগেনা, টুপিও লাগেনা। পেত্নী বউ এবার শফি হুজুরের সব জারিজুরি ধরে ফেললো।
একদিন অমাবশ্যার রাতে ধড়াম করে হুজুরের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল। সোজা ঢুকে গেল শফি হজুরের দিলের ভেতরে। আহারে হতভাগিনী! ইহজনমে যার হৃদয়ে স্থান পায়নি, মরে গিয়ে সেখানেই জবর দখল নিল। বলতে বলতে মামদোর চোখ দুটো ভিজে এসেছিল। যা হোক,লং স্টোরি শর্ট-সেই থেকে মেয়ে মানুষ দেখলে হুজুরের দিলের মধ্যে লালা ঝরে।