রিঙ্কা চক্রবর্তী একজন মিউজিক টিচার। বেহালা বাজানো শেখায়। ওর স্কুলের নাম “মিউজিক কাফে” এছাড়াও কিছু কিছু নন ব্র্যান্ডেড অক্যুয়াস্টিক গিটার, গিটার স্ট্রিং, ম্যান্ডলিন, মেলোডিকা, হারমোনিকা, এগ শেকার, ট্রাম্পেট, স্যাক্সোফোন, মেটাল ফ্লুট ইত্যাদি চায়না থেকে ইমপোর্ট করে সেগুলো মার্কেটিং করে ওর দাদা অঙ্কন। অঙ্কন গিটারিস্ট। মেনলি নর্থইস্ট ইন্ডিয়াতেই বিক্রি হয় ওদের মিউজিকাল ইন্সট্রুমেন্টস। মিউজিক ছাড়াও রিঙ্কার বিশেষ শখ ভূতের গল্প পড়া এবং চ্যালেঞ্জ করে বিভিন্ন ভৌতিক স্থানে একা রাত্রিযাপন, সঙ্গী শুধু মোবাইল আর নিজের ভায়োলিন। হাওড়ার উদয়নারায়নপুর থেকে শুরু করে ক্যালিম্পঙের ভুতুড়ে বাড়িতে রাত কাটিয়ে এলাকার অনেক কাকু জ্যেঠুদের সাথে চ্যালেঞ্জ জিতেছে রিঙ্কা, অক্ষত শরীরে। কদিন আগে রিঙ্কা দাদার থেকে জানতে পারে নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে একটা পরিত্যক্ত হন্টেড হাউসের কথা, যেখানে রাত কাটানো নাকি কোনো মানুষের ক্ষমতার বাইরে। বাচ্ছাদের মতো বায়না জুড়ে দেয় রিঙ্কা দাদার কাছে, পরের বার ওকে নিয়ে যেতেই হবে ডিমাপুর। অঙ্কন সাফ জানিয়ে দেয় সেটা অসম্ভব!!
প্রায় একমাস পর মুম্বাই পাম এক্সপো তে যোগ দিতে তিন দিনের জন্য বাড়ি থেকে বেরোয় রিঙ্কা। কিন্তু সবার অজান্তে সে এয়ার ইন্ডিয়ার উড়োজাহাজে করে সোজা পাড়ি দেয় নাগাল্যান্ড। লেক শিলই হোটেলে পৌঁছে একটু বিশ্রাম নিয়ে রিঙ্কা চলে যায় হাফ নাগরাজন রোডের চাকেশঙ কলোনির ভুতুড়ে বাড়ি বেথেল হাউসে। খুব সাধারন একটা পুরনো কাঠের বাংলো টাইপ দোতলা বাড়ি। দেখে বোঝা যায় দীর্ঘদিন সেখানে কারোর বসবাস নেই। সামনেটা আগাছায় ভরা, একটা বর্ণহীন শান্ত থমথমে পরিবেশ। দাঁড়িয়ে দেখার সময় আকস্মিক ভাবে উদয় হয় স্থানিয় একজন নাগা মহিলা, পাগোলের মতো হাত জোড় করে রিঙ্কাকে ওই বাড়ির ত্রিসীমানায় যেতে ইশারায় বারণ করে বার বার। সেদিনের মতো হোটেলে ফিরে আসতে বাধ্য হয় রিঙ্কা। কিন্তু জেদি অকুতোভয় এবং অতিআত্মবিশ্বাসী রিঙ্কা মোবাইল আর নিজের প্রিয় বেহালা সঙ্গে নিয়ে পরের দিন রাত দশটায় সবার চোখ এড়িয়ে পৌঁছে যায় অন্ধকার বেথেল হাউসের অন্দরমহলে!
ভেতরটা একেবারেই সময় কাটানোর অযোগ্য, বিশ্রী গন্ধ আর স্যাঁতসেঁতে। খোলা সদর দরজায় মাকড়সার জাল গুলো একটা লাঠি দিয়ে সরিয়ে বাংলোর ডাইনিং হলে প্রবেশ করে রিঙ্কা। মোবাইলের টর্চ জালিয়ে দেখতে পায় ধুলোর আস্তরণে জীর্ণ একটা ডিনার টেবিল আর আধভাঙা তিনটে চেয়ার। একটু দুরে একটা পেল্লাই সোফা কিন্তু পিচকলো অন্ধকারে সেটার রং বোঝা দুষ্কর। টেবিলের পেছনে সোফার পাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। টর্চের আলোয় মৃদু আলোকিত সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠে রিঙ্কা, ওপরটা বেশ সুন্দর। তুলনায় পরিস্কার। যতদূর বোঝা যায় মাঝখানটা গোল আর তিন দিকে তিনটে ঘর মেঝেটা কাঠের। একটু এগিয়ে ডানদিকে একটা ঘরে ঢুকে রিঙ্কা বুঝতে পারে এটা একটা বেডরুম। টর্চের আলোয় বোঝা যাচ্ছে দেওয়াল জুড়ে একটা ওয়ার্ডব তার পাশে একটা দরজা। সামান্য এগিয়ে দরজা খুলে রিঙ্কা দেখে বাইরে একটা ঝোলানো বারান্দা।
ভেতরে ঢুকে এসে খেয়াল করে বাঁদিকের দেওয়ালে একটা ছবি ঝুলছে। টর্চ টা সামনে এগিয়ে হাত দিয়ে ধুলো ঝেড়ে দেখতে পায় ফ্যামিলি ফটো। স্যুট পরা এক ভদ্রলোক আর গাউন পরে এক মহিলা সোফার দুপাশে দাঁড়িয়ে আর সোফায় বসে দুটো বাচ্ছা ছেলে মেয়ে। ছবির নিচে কিছু লেখা আছে বুঝতে পেরে পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে উঁচু হয়ে ভালো করে টর্চের আলোয় লেখাটা পড়ার চেষ্টা করে রিঙ্কা, ছবিটার নিচে লেখা মিস্টার ব্রগেঞ্জা এন্ড ফ্যামিলি। টর্চ ঘুরিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে রিঙ্কা বাঁদিক দিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে পেছনের দিকের রুমটায় যাবার সময় খেয়াল করে ডানদিকে সম্ভবত কিচেন একটা। মোবাইলের টর্চে কোনোকিছু তীক্ষ্ম ভাবে দৃষ্টিগোচর হয়না।
ভায়োলিন টা রেখে নিজের হাতঘড়িটার দিকে টর্চ ফেলে রিঙ্কা, দেখে পৌনে বারোটা, এবার নিচের ওই সোফাটাকে বসার যোগ্য করে রাতটা কাটিয়ে দিতে হবে এই ভেবে পেছন ফিরে সিঁড়ির দিকে এগোবে এমন সময় কিছু চেঁচামেচির আওয়াজ পায়, চমকে ওঠে রিঙ্কা আস্তে আস্তে পা ফেলে দোতলা থেকে একতলার মাঝে সিঁড়ির চাতালে নেমে এসে দাঁড়ায়, গায়ের রক্ত হিম হয়ে যায় ওর! রিঙ্কা দেখতে পায় দুটো বাচ্ছা ওই সোফাটায় বসে, তাদের হাত,পা,মুখ বাঁধা আর একজন মহিলা একটা ব্যারেল থেকে তেল ঢেলে দিচ্ছে ওদের শরীরে একটু দুরে দাঁড়িয়ে স্যুট পরা একটা লোক, মুখে চুরুট। তেল ঢালার পর ওই লোকটা ছুঁড়ে দেয় নিজের মুখের জ্বলন্ত চুরুটটা বাচ্ছা দুটোর দিকে।
রিঙ্কার কানে আসছে মর্মান্তিক আর্তনাদ বাচ্ছা দুটো দাউদাউ আগুনে জ্বলে ছটফট করছে ঠিক তখনি ওই লোক টা মহিলাটাকে বুকে জড়িয়ে তাকিয়ে দেখছে ঝলসানো অসহায় মৃত্যু দুটো। রিঙ্কার চোখ বুজে আসছে, গলা, বুক শুকিয়ে কাঠ। এমন সময় একটা কলিং বেলের আওয়াজ করে কোনো তৃতীয় কেউ ঘরে ঢুকলো তাকে দেখেই হকচকিয়ে যায় ওরা দুজনে, কিছু বলার আগেই ওই তৃতীয় ব্যক্তি রিভলভার উঁচিয়ে পর পর গুলি চালাতে শুরু করলো উপস্থিত দুজনের দিকে। সাথে সাথে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে দুজনে, আগুন তখনো নেভেনি, আগুনের দিকে তাকিয়ে হাউহাউ করে কাঁদছে তৃতীয় লোকটা, চিৎকার করছে পাগোলের মতো। একটু পরে সব কিছু শান্ত, রিঙ্কা দেখছে লোকটা ওই অগ্নীপিন্ডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তারপর খুব জোর একটা গুলির আওয়াজ। মাথা ঘুরে ওখানেই জ্ঞান হারায় রিঙ্কা!
ঘুম ভাঙে তখন রিঙ্কা হিল ভিউ রোডের স্টিফেন হসপিটালের বেডে। ডাক্তার জানায় তার দাদা কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পৌঁছোবে এটাও জানায় রিঙ্কা প্রায় কুড়ি ঘন্টার বেশি বেহুঁশ ছিলো সাথে ধুম জ্বর। কিন্তু এখন সে বেটার। অঙ্কন আসে বোনকে নিয়ে ফেরার সময় ফ্লাইটে বসে জানায় ওই বাড়ির ইতিহাস। প্রায় কুড়ি বছর আগে ওখানে মিস্টার নাইজেল ব্রগেঞ্জা সুখী পরিবারের সাথে বসবাস করতো স্ত্রী মার্গারেট বেথেল আর দুই ছেলে মেয়ে প্রিন্স এবং মেরিয়ম কে নিয়ে। নাইজেল মিলিটারিতে কর্মরত থাকাকালীন বেথেল ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে রেমন্ড ডিকোস্টা নামে এক কুখ্যাত ড্রাগস মাফিয়ার সাথে তারা দুজনে মিলে নাইজেলের বাচ্ছাদের মেরে অস্ট্রেলিয়া পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল সেদিনই নাইজেল বাড়ি ফিরে দুজনকে খুন করে খুন করে এবং প্রিন্স আর মেরিয়মের শোকে নিজে আত্মঘাতী হয়। এর আগেও কিছু লোক ওই বাড়িতে এমন ঘটনা চাক্ষুস করেছে বলে জানা যায় তাই দীর্ঘ বেশ কিছু বছর সাধারণ মানুষ বেথেল হাউসের ধারে কাছে আর ঘেঁসে না। সব শুনে ক্লান্ত রিঙ্কা দাদার কাঁধে মাথা রেখে জিগ্গেস করে ওর ভায়োলিন টা কোথায়!!!!!!