ভূতের গল্প : নিশির ডাক

ঝন্টা তখন একেবারে কোলের ছেলে — তখন তার মায়ের শক্ত অসুখ করে । সেইজন্যে সে আহ্লাদী পিসির কোলে মানুষ হয় । আহ্লাদী পিসি ঝণ্টার বাবার দূর সম্পর্কের এক বােন , মাথায় একটু ছিট আছে বলে শ্বশুরঘর করতে পারেনি । আবার কারণে – অকারণে এলােমেলাে আহ্লাদীর মতাে কথা বলে তাই তার নাম হয়েছে আহ্লাদী । বাড়ীর ছেলেমেয়ের সে তাই আহ্লাদী পিসি ! মায়ের অসুখ থেকে সেই যে ঝণ্টাকে সে কোলে তুলে নিলাে , তার পরেই ছেলেটা ওর এমন ন্যাওটা হয়ে গেলাে যে , মায়ের অসুখ ভাল হলেও আহ্লাদী পিসি আর ওকে কোল থেকে নামাতে চায় নি । ঝণ্টাও আহ্লাদী পিসি বলতে একেবারে অজ্ঞান ; আহ্লাদী পিসি স্নান করিয়ে দেবে । পিসিকে না হলে ঝণ্টার এক মুহূর্ত চলে না ! ঝণ্টার মাও সাত ঝামেলায় দিবা – রাত্রি জড়িয়ে থাকেন , তাই আহ্লাদী পিসির কোলে ছেলে দিয়ে তাঁরও সকল রকমে নিশ্চিন্তি ।আহ্লাদী পিসি মাছ খেতে বড়াে ভালােবাসে । বিশেষ করে শােল মাছ । ঝন্টা যখন একটু বড় হলাে সে পিসির জন্যে নানা রকম মাছ ধরে নিয়ে আসে । পিসি এক গাল হেসে বলে ভাগ্যিস আমার ঝণ্টা ছিলাে , তাই দুটো মাছ – ভাত খেয়ে বাঁচি !বর্ষার জলে নদী – নালা ভরাট হয়ে আছে — নিজেদের পুকুরের জল ফেঁপে উঠেছে ঝণ্টা গভীর রাত্রে গিয়ে নানা জাতের মাছ ধরে নিয়ে আসে বিশেষ করে আহ্লাদী পিসির জন্যে শােল মাছ যদি পায় তবে তার মুখে হাসি ধরে না ।আহ্লাদী পিসি মরলে যে ঝণ্টাই গয়ায় তার পিন্ডি দেবে — এই কথাই সে সগর্বে সবাইকে বলে বেড়ায় !আহ্লাদী পিসি হঠাৎ তিন দিনের জ্বরে মারা গেলাে ।দিব্যি শক্ত – সমর্থ আহ্লাদী পিসি — দেহে রােগ বালাই নেই — অমন ভাবে যে হঠাৎ মারা যাবে তা বাড়ির কেউ ধারণাই করতে পারে নি । দুর্দান্ত দস্যি ছেলে ঝন্টা — আহ্লাদী পিসির মৃত্যুর পর কে যেন তার মুখে বােবা – কাঠি ছুঁইয়ে দিয়েছে । কারাে সঙ্গেই কথা কয় না , খায় না দায় না , উদাস চোখে একদিকে তাকিয়ে থাকে ! ছেলে যেন দিন দিন শুকিয়ে যেতে লাগলাে !রাত্তিরে ঘুমের ঘােরে ঝণ্টা হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে বসে ।মা শুধােয় , হ্যাঁরে ঝণ্টা বিছানার ওপর উঠে বসলি কেন ? এখন তাে অনেক রাত । ঘুমিয়ে পড় !ঝণ্টা ফ্যাল ফ্যাল করে এদিক – ওদিক তাকায় , তারপর ফিসফিস্ করে মাকে । সে বলে , ‘আহ্লাদী পিসিমা আমায় ডাকলাে যে ।’ শুনে মা শিউরে ওঠেন । ঝণ্টার গায়ে মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দেন । মুখে বলেন , ‘রাম রাম ।’পাড়ার পাঁচজন বৌ – ঝি বলে , ঝণ্টার মা , ওর দিকে বেশ কড়া নজর রেখাে ।পােড়ামুখী আহ্লাদী মরেনি । তাই বুঝি এখনাে আশে – পাশে ঘুর-ঘুর করছে ।’ঝন্টাদের বাড়ির নীচে পুকুরপাড়ে একটা শ্যাওড়া গাছ ; গায়ের লােকেরা হাট থেকে সওদা করে ফেরবার মুখে ওই শ্যাওড়া গাছের ডালে কাকে যেন বসে থাকতে দেখেছে ।বৃন্দাবন গাঙ্গুলি একদিন নাকি একেবারে সামনা – সামনি পড়ে গিয়েছিলেন । বললেন , ভাগ্যিস আমি বুদ্ধি করে পৈতেটা হাতে জড়িয়ে ধরে গায়ত্রী জপ করতে শুরু করলাম । নইলে ঝন্টাদের পুকুরের খালে আমার ঘাড় মটকে রাখতাে ! এইভাবে সারা গাঁয়ে একটা চাপা ফিসফিস আলােচনা । কেউ বিশ্বাস করে , কেউ হেসে উড়িয়ে দেয় ।তখন আষাঢ় মাস । আশেপাশের নদী – নালা বর্ষার জলে ভরাট হয়ে গেছে । ঘােলা জল পাক খেতে খেতে ধানের জমি ভরিয়ে মাঠ – ঘাট ডুবিয়ে উঁচু – নিচু গাঁয়ের পথগুলিকে পিছল করে ঝন্টাদের বাড়ির পুকুরে খালে ঢুকছে ।তখন বােধ করি দুপুর রাত । এমন একটা জ্যোছনা ফুটেছে যে আশে – পাশে দুরে সব কিছু নজরে পড়ে , কিন্তু ভালাে করে ঠাহর করা যায় না । মনে হয় , যেন একটা পাতলা কুয়াশা জ্যোছনার সঙ্গে মিশে গােটা গ্রামটিকে ঘিরে রেখেছে ।মায়ের পাশে শুয়ে ঝণ্টা অকাতরে ঘুমােচ্ছে । বাড়ির পিছন দিক দিয়ে একটা কালাে বেড়াল বিকট ভাবে ডেকে গেল । কোথায় একটি ভূতুম পাখি একটানা ডেকে ডেকে বিরক্তি জাগিয়ে তুলছে ! একটা থমথমে ঝিমঝিম ভাব . . .এমনি সময় ঝণ্টার হঠাৎ মনে হলাে — ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আহ্লাদী পিসি ওকে ডাকছে । বলছে , ‘ওরে ঝণ্টা শিগগীর আয় — তােদের পুকুরে নতুন জল এসেছে । কতাে মাছ উঠেছে — দেখবি আয় । তাের পােলােটা নিয়ে আসতে ভুলিসনি যেন !’আচমকা ঝণ্টার ঘুম ভেঙে গেলাে ! সে বিছানার ওপর উঠে বসলাে । আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাে , সবাই অকাতরে ঘুমােচ্ছে । তার মায়ের ডান হাতটি ওর গায়ের ওপর ছিলাে । আস্তে আস্তে হাতটা সরিয়ে রাখলাে ।কে যেন কানের কাছে বললাে , ‘দরজাটা ভেজিয়ে দে ঝণ্টা , নইলে ওরা জেগে উঠবে ।’ ঝণ্টা বিনা প্রতিবাদে ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে হনহন করে পুকুরের ধারে চলে গেলাে ।নিশুতি রাত কেউ কোথাও জেগে নেই । কলকল করে বর্ষার জল ঢুকছে খালে , ঝন্টা ছপ্‌ ছপ্‌ করে পােলাে ফেলছে আর রাশি রাশি মাছ ধরছে । এতাে শােল মাছ কোত্থেকে এলাে – ঝণ্টা ভেবে কিনারা পায় না । যে খালৈ সঙ্গে এনেছিলাে , সেটা মাছে ভর্তি হয়ে গেল । কিসের যেন একটা পােড়া গন্ধ ক্রমাগত তার নাকে আসছিলাে । কার আকর্ষণে ঝণ্টা সেই মাছ ভর্তি খালৈ নিয়ে এগিয়ে চললাে — একি ! এ যে সেই শ্যাওড়া গাছ !‘— আঁমায় শোঁলমাঁছ পোঁড়া খাঁওয়াবি ঝঁন্টা ! ‘ঝণ্টা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাে , গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে কে যেন বসে আছে ! আহ্লাদী পিসি না ? দেখতে ঠিক সেই রকম ।এতােক্ষণে ঝণ্টার যেন জ্ঞান ফিরে এলাে ! আহ্লাদী পিসি তাে মরে গেছে । ও তা হলে কার ডাকে এই নিশুতি রাতে মাছ ধরতে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে ? ভয়ে ওর মাথার চুলগুলাে খাড়া হয়ে উঠলাে । সে প্রাণপণ চেষ্টা করলাে পালিয়ে যেতে কিন্তু পা দুটো কিছুতেই উঠছে না ।শেষকালে মনে জোর এলে ঝণ্টা মরিয়া হয়ে ছুটতে শুরু করে দিলাে , পেছন থেকে আহ্লাদী পিসির কান্না শােনা গেল , ‘ওঁরে ঝঁন্টা , শোঁল মাঁছগুঁলাে আঁমায় দিঁয়ে যাঁ আঁমি আর কিঁছু চাঁইনে ।’আহ্লাদী পিসির কথা যতো কানে আসে , ঝণ্টা ততাে ছােটে । হঠাৎ তার হাতের মাছের খালৈ কে যেন ছিনিয়ে নিয়ে গেল ।একটা আর্তনাদ করে ঝণ্টা সেইখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাে । তার চিৎকার শুনে বাড়ি থেকে লােকজন এসে যখন পৌঁছালাে , ওর মুখ দিয়ে তখন গ্যাঁজলা বেরােচ্ছে ।অবশেষে মায়ের বুকভরা কান্নায় তিনদিন পর ঝণ্টা তাকালাে । কিন্তু কী হয়েছিল কোন কথাই সে মনে করতে পারে না , শুধু বােকার মতাে ড্যাবডেবে চোখে চেয়ে থাকে ।গাঁয়ের সবাই বললাে , ‘দেখাে ঝণ্টার মা , এখন থেকে ঝণ্টাকে একেবারে চোখে চোখে রাখতে হবে । পেত্নীরা ওই রকম করে নিশির ডাকে ভুলিয়ে জলার ধারে ঘাড় মটকে রাখে ।শুনে ঝণ্টার মার বুকের রক্ত শুকিয়ে যায় । সারারাত ধরে ছেলের শিয়রে জেগে থাকে । ঘন ঘন দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়তে থাকে । ভাবে আমার শান্তির সংসারে এ কী হলাে । কি কুক্ষণেই পরের মেয়েকে ঘরে ঠাই দিয়েছিলাম ।এদিকে হঠাৎ বাড়ির লােকে লক্ষ্য করলাে যে , কেমন যেন ঘােলাটে চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে ঝণ্টা ।হঠাৎ সে বলে বসলাে , ‘আমি পােড়া শােল মাছ খাবাে । ‘ অমনি সঙ্গে সঙ্গে কোথেকে একটা পােড়া শােলমাছ ঘরের মাঝখানে এসে পড়লাে । ভয়ে আঁৎকে উঠলাে সব্বাই ।ক্ৰমে ব্যাপারটা সহজ হয়ে এলাে । দেখা গেলাে যে , ঝন্টা যখন যা চায় কে যেন সঙ্গে সঙ্গে তাই এনে হাজির করে !সেদিন দুপুরে গরমে আই ঢাই করতে করতে ক্ষীণস্বরে ঝণ্টা বললাে , ‘মা এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল দাও না ।’মুখের কথা খসাতে যতােটুকু সময় ! দেখা গেলাে , সুন্দর একটি গেলাসে টলটলে পরিষ্কার জল । ঝণ্টা সেই জল খেতে যাচ্ছিলাে — কিন্তু ওর মা হাত দিলে সবটুকুন মেঝেতে ফেলে দিয়ে বললেন , ‘কক্ষণাে মুখে দিসনে ঝণ্টা . . . ওসব পেত্নীতে যােগাচ্ছে !’সন্ধ্যের পর পাড়ার মেয়েরা দল বেঁধে আসতাে ঝণ্টাকে দেখতে । কথায় কথায় গাঙ্গুলী গিন্নী বললেন , ‘আমার জর্দা ফুরিয়ে গেছে ! কাশীর জর্দা না হলে আমার মুখে রােচে না ।’আপন মনে ঝণ্টা বললাে , ‘তুমি কাশীর জর্দা খাবে ঠানদি ? ’ সঙ্গে সঙ্গে ঠন করে মেঝেতে পড়লাে একটা কৌটো !গাঙ্গুলী – গিন্নী অবাক হয়ে বললেন , ‘ এই তাে কাশীর জর্দা ? একেবারে নতুন কৌটো । কোত্থেকে এলাে ঝণ্টার মা !’আর যারা আশে – পাশে ছিলাে — ব্যাপারটা জানতে পেরে তারা খুলে বলল , ‘ জর্দার কৌটোটা গাঙ্গুলী-গিন্নী হাতে তুলে নিতে যাচ্ছিলেন , কিন্তু যেই আহ্লাদী পেত্নীর কথা শুনলেন অমনি ‘রাম রাম’ করতে করতে একেবারে নিজের বাড়ির দিকে পা চালিয়ে দিলেন ।যতােদিন ব্যাপারটা তামাশা থাকে লােকে ভিড় জমায় , কৌতূহলী হয়ে বসে থাকে পেত্নীর কাণ্ড দেখতে । কিন্তু কতাে রাত্তির লােকে এই ভাবে না ঘুমিয়ে জাগতে পারে ।কিসের যেন দুঃস্বপ্ন দেখে মাঝ রাত্তিরে ঝণ্টার মায়ের ঘুম ভেঙে যায় । মা ছেলেকে বুকের কাছে প্রাণপণে টেনে নেন । বাঁশঝাড়ের দিকে যেখানে একটানা ঝিঁঝিঁ ডেকে চলে , সেখানে যেন কার কান্নার রেশ শুনতে পাওয়া যায় ।মা চমকে উঠে বসেন । ছেলের মাথায় হাত রেখে সারারাত ধরে দুর্গা নাম জপ করতে থাকেন । কেবলি মনে হয় , তার কোলের ছেলেকে কে যেন ছিনিয়ে নিতে আসছে ।সেদিন সন্ধ্যে থেকেই একটানা ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে । দূর বনে প্রহরে প্রহরে শেয়াল ডাকছে , মনে হচ্ছে যেন ওরাও খুব ভয় পেয়েছে , পাখি – পাখালিরা কখন যে গিয়ে বাসায় সেঁধিয়েছে — কেউ খবর রাখে না । গেরস্ত বাড়ির গােয়ালগুলােতে গরুগুলাে এমন বিশ্রী ভাবে ডাকছে যে মনে হয় তারা অশুভ কোনাে ইঙ্গিত পেয়েছে । মাঝে মাঝে কালাে – প্যাঁচার – চ্যাঁচানি কানে ভেসে আসছে ।শ্মশানের দিক থেকে একটা শোঁ শোঁ হাওয়া বুক চিরে উত্তর অঞ্চলের জলাভূমির উপর দিয়ে বইছে । মনে হচ্ছে , কোনাে পেত্নী বুঝি নিঃশ্বাস ফেলছে । গাঁয়ের পথে আজ একটি লােকও নেই । কোনাে বাড়িতে একটি ছেলেও কেঁদে উঠছে না । মনে হচ্ছে , রুদ্ধ আতঙ্কে সবাই প্রহর গণনা করছে ।ঝন্টাদের বাড়িতে আজ সবাইকে কী কাল ঘুমে পেয়েছে কে জানে ! সন্ধ্যেবেলা উনুনে আগুন পড়েনি । বামুনদিদি খুঁটে আর কয়লা সাজাতে গিয়ে সেইখানেই ঘুমিয়ে পড়েছে ; বাইরের ঘরে বাড়ীর কর্তারা সন্ধ্যে থেকেই দাবা পাশা খেলতে বসেন , তাঁদের চীৎকারে আশেপাশের দশটা বাড়ীর লােকে ঘুমােতে পারে না । আজ আঁধার ঘনিয়ে আসবার সঙ্গে সঙ্গে দাবার ছক্ একপাশে সরিয়ে রেখে সবাই ফরাসের উপর অঘােরে নাক ডাকিয়ে ঘুমােচ্ছে ।অবিশ্রান্ত বর্ষা চলছে , তারই সঙ্গে তাল রেখে খানা – ডোবার ব্যাঙেরা আসর জমিয়ে তুলছে । আকাশের সমস্ত তারা মেঘে ঢাকা পড়েছে । মাথার ওপর কালপুরুষ — সাংঘাতিক কিছু ঘটবে বলে বুঝি দম বন্ধ করে প্রহর গণনা করছে । ঝড়ের গর্জনে বিপদের ইঙ্গিত ।মায়ের পাশে শুয়ে অকাতরে ঘুমােচ্ছে ঝণ্টা । এমন ঘুম যে , দেখে মনে হয় — ওর দেহে বুঝি প্রাণ নেই ।আকাশের বৃষ্টি , ঝােড়াে হাওয়া , ঝিঁঝির ডাক , ব্যাঙের শব্দ , প্যাঁচার চ্যাঁচানি আর কালপুরুষের নীরব ইঙ্গিত ওকে যেন এমনভাবে ঘুম পাড়িয়েছে যে সে ঘুম আর ভাঙবে না ।কিন্তু হঠাৎ বেড়ার পাশে কার ফিসফিসেনি কথা শােনা গেলাে – ঝণ্টা , উঠে আয় জলের ধারে আজ মাছ থই থই করছে ।ঝণ্টা এক মুহূর্তে সচকিত হয়ে ওঠে । আবার সেই ফিসফিসেনি আহ্বান ভেসে এলাে ।উদাস দৃষ্টিতে ঝণ্টা উঠে বসলাে । কার ডাক — কোথায় যেতে হবে কিছু জানে না — তবু সে উঠে দাঁড়ালে পাগলের মতাে ।আবার সেই বাঁশবনের মধ্যে কার আহ্বান ।‘আজ আর পােলাে নিসনে ঝণ্টা , খ্যাপ্‌লা জালটা হাতে নিয়ে তাড়াতাড়ি আমার সঙ্গে বেরিয়ে আয় – ‘এই প্রহেলিকাময় নিশির ডাকে সাড়া না দেবার উপায় নেই ।ঝণ্টা খ্যাপলা জালটা কাঁধের উপর তুলে নিয়ে দরজার হুড়কোটা খুলে উঠোনে বেরিয়ে এলাে । সঙ্গে সঙ্গে কানে – তালা লাগানাে মেঘের গর্জন — আর বাদুড়ের ডানার ঝটপটি ।কিন্তু মেঘের ডাকেও কারাে ঘুম ভাঙলাে না । ছায়ামূর্তির হাতছানিতে ঝণ্টা জলের দিকে এগিয়ে যায় । পথে অন্ধকার এত জমাট বেঁধে আছে . . . . তবু ওর পথ চলতে কোনাে অসুবিধে হয় না ।‘ওই যে ওইখানে কতাে মাছ ঘাই মারছে . . . . । তুই দেখতে পারছিস নে ঝণ্টা ?এগিয়ে যা , ছুঁড়ে দে খ্যাপ্‌লা জাল -’অশরীরীর নির্দেশ শুনে ঝণ্টা একেবারে জলের মধ্যে পা চালিয়ে দিলাে ।তারপর কচুরিপানার মধ্যে তার দেহটা যে কোথায় তলিয়ে গেল , সারা গাঁয়ের কেউ জানতেও পারলাে না ।শুধু ঝণ্টাদের বাড়ির কালাে বেড়ালটা ওর মায়ের কাছে কেঁদে কেঁদে ফিরতে লাগলাে । মায়ের কাল – ঘুম তবু ভাঙল না ।পরদিন জেলেরা যখন ঝণ্টার মৃতদেহটা জালে টেনে তুললাে , সারা গাঁয়ের মানুষজন একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়লাে ।গাঁয়ের একজন বর্ষীয়সী মহিলা কপাল চাপড়ে বললেন , ‘ আহ্লাদী পােড়ামুখী পেত্নী হলেও ওকে ভুলতে পারে নি তাইতাে রাহু হয়ে ঝণ্টাকে কোলে টেনে নিলে ।বহু বছর কেটে গেছে , এখনও গাঁয়ের লােকেরা একটু বেশী রাত্তিরে জলার ধার দিয়ে যেতে ভয় পায় । মনে হয় , কে যেন ওখানে কেঁদে কেঁদে , এলােচুল উড়িয়ে , বুক চাপড়িয়ে ছােটাছুটি করে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page