টেলিফোন তুললেই একটা গম্ভীর গলা শােনা যাচ্ছে , সিক্স ফোর নাইন ওয়ান . . . সিক্স ফোর নাইন ওয়ান . . . . সিক্স ফোর নাইন ওয়ান . . . ।
সকাল থেকেই ডায়াল – টোন নেই । টেলিফোনের হরেক গণ্ডগােল থাকে বটে , কিন্তু এ অভিজ্ঞতা নতুন । গলাটা খুবই যান্ত্রিক এবং গম্ভীর । খুব উদাসীনও ।
প্রদীপের কয়েকটা জরুরি টেলিফোন করার ছিল । করতে পারল না ।
কিন্তু কথা হল , একটা অদ্ভুত কণ্ঠস্বর কেবল বারবার চারটে সংখ্যা উচ্চারণ , করে যাচ্ছে কেন ? এর কারণ কী ? ঘড়ির সময় জানার জন্য বিশেষ নম্বর ডায়াল করলে একটা যান্ত্রিক কণ্ঠে সময়ের ঘােষণা শােনা যায় বটে , কিন্তু এ তাে তা নয় । মিনিটে মিনিটে সময়ের ঘােষণা বদলে যায় , কিন্তু এই ঘােষণা বদলাচ্ছে না ।
অফিসে এসে সে তার স্টেনােগ্রাফারকে ডেকে টেলিফোনের ত্রুটিটা এক্সচেঞ্জে জানাতে বলেছিল । তারপর কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল । সে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির বড় অফিসার । বহু বছর দিল্লিতে ছিল । সম্প্রতি কলকাতায় বদলি হয়ে এসেছে । কোম্পানিই তাকে বাড়ি , গাড়ি ও টেলিফোন দিয়েছে । তার আগে এই পদে ছিলেন কুরুপ্পু নামে দক্ষিণ ভারতের একজন লােক । তিনি রিটায়ার করে দেশে ফিরে গিয়ে ফুলের চাষ করছেন বলে শুনেছে প্রদীপ । খুবই দক্ষ ও অভিজ্ঞ মানুষ ছিলেন । রিটায়ার করার বয়স হলেও কোম্পানি তাকে ছাড়তে চায়নি । বরং আরও বড় পােস্ট দিয়ে ধরে রাখতে চেয়েছিল । কুরুপ্পু কিছুতেই রাজি হননি ।
দুপুরে লাঞ্চের আগে সে একটা পার্টিকে একটা বকেয়া বিলের জন্য তাগাদা করতে টেলিফোন তুলে ডায়ালের প্রথম নম্বরটায় বােতাম টিপতেই আচমকা সেই উদাসীন , গম্ভীর , যান্ত্রিক বণ্ঠস্বর শুনতে পেল , সিক্স ফোর নাইন ওয়ান তারপরেই অবশ্য কণ্ঠস্বর থেমে গেল ।
প্রদীপ খুবই অবাক হয়েছিল । সামলে নিয়ে বাকি নম্বর ডায়াল করতে রিং বাজল এবং ওপাশে একজন ফোন ধরল । প্রয়ােজনীয় কথা সেরে নিয়ে প্রদীপ খুব চিন্তিত ভাবে অফিসের ইলেকট্রনিক টেলিফোনটার দিকে চেয়ে রইল । এই ফোনেও । কণ্ঠস্বরটা এল কী করে ? এসব হচ্ছেটা কী !
কলকাতার বাড়িতে প্রদীপের আত্মীয়স্বজন কেউ নেই । তার মা , বাবা , বােন , ভাই সব দিল্লিতে । সে বিয়ে করেনি । একা থাকে । একজন রান্নার ঠিকে লোক রেঁধে দিয়ে যায় । আর ঘরদোর সাফ করা , বাসন মাজা ও কাপড় কাচার জন্য ঠিকে একজন কাজের মেয়ে আছে । তারা কেউ বাড়িতে থাকে না । আলিপুরের নির্জন অভিজাত পাড়ায় তিনতলার মস্ত ফ্ল্যাটে প্রদীপ সম্পূর্ণ একা । তবু প্রদীপ হঠাৎ ফ্ল্যাটের নম্বর ডায়াল করল এবং শুনতে পেল ওপাশে রিং হচ্ছে ।
মাত্র তিনবার রিং বাজতেই কে যেন ফোনটা ওঠাল । কিন্তু কথা বলল না । প্রদীপ বলল , হ্যালাে ! হ্যালাে !
কেউ জবাব দিল না । কিছুক্ষণ পর ফোনটা কেউ আস্তে নামিয়ে রাখল ।
দুপুরবেলাতেও প্রদীপের শরীর হিম হয়ে এল ।
এসব হচ্ছেটা কী ? যদি রং নম্বরই হয়ে থাকে তা হলেও তাে ওপাশ থেকে কেউ না কেউ সাড়া দেবে ।
বিকেলে পার্টি ছিল , ফ্ল্যাটে ফিরতে একটু রাতই হয়ে গেল তার । আর ফেরার সময় মাথায় দুশ্চিন্তাটা দেখা দিল । সে অলৌকিকে বিশ্বাসী নয় , কিন্তু কোনও ব্যাখ্যাও তো পাওয়া যাচ্ছে না ।
দরজা খুলে ফ্ল্যাটে ঢােকার পর একটু গা ছমছম করছিল । তবে আলাে জ্বেলে ঝলমলে আধুনিক ফ্ল্যাটটার দিকে চেয়ে তার ভয় – ভয় ভাবটা কেটে গেল । তবে ফোনটার ধারে – কাছে সে আর গেল না ।
প্রদীপের গভীর ঘুম ভাঙল রাত দুটো নাগাদ । হলঘরে ফোন বাজছে । ঘুমচোখে । সে তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে । দিল্লিতে মা – বাবার শরীর খারাপ হল না তাে !
ফোন ধরতেই শিউরে উঠল সে । সেই যান্ত্রিক উদাসীন গম্ভীর গলা বলতে লাগল , সিক্স ফোর নাইন ওয়ান . . . সিক্স ফোর নাইন ওয়ান . . . সিক্স ফোর নাইন ওয়ান . . . । ফোনটা রেখে দিল সে । বাকি রাতটা আর ঘুম হল না । বিছানায় এপাশ ওপাশ করে কাটিয়ে দিল ।
কলকাতা টেলিফোন – ব্যবস্থা যে খুব খারাপ , তা প্রদীপ জানত । তবু সকালে ব্রেকফাস্টের সময় টেলিফোন বেজে উঠতেই প্রদীপ কম্পিত বক্ষে গিয়ে টেলিফোন ধরল , তখন একটি অমায়িক কণ্ঠস্বর বলল , স্যার , আপনি টেলিফোন খারাপ বলে কমপ্লেন করেছিলেন কাল । কিন্তু আমরা টেস্ট করে দেখেছি আপনার লাইনে তাে কোনও গণ্ডগােল নেই । লাইন তাে চালু আছে ।
কিন্তু আমি যে টেলিফোনে একটা অদ্ভুত গলা শুনতে পাচ্ছি ।
হয়তাে ক্রস কানেকশন হয়ে গিয়েছিল ।
আমাদের যন্ত্রপাতি সব বহু পুরনাে , তাই মাঝে মাঝে ওরকম হয় ।
আপনি ডায়াল করে দেখুন এখন , লাইন ঠিক আছে । বাস্তবিকই লােকটা কানেকশন কেটে দেওয়ার পর ডায়াল – টোন চলে এল এবং অফিসের নম্বর ডায়াল করতেই লাইনও পেয়ে গেল প্রদীপ । ফোন স্বাভাবিক হল বটে , কিন্তু প্রদীপের মাথা থেকে সিক্স ফোর নাইন ওয়ান . . . গেল না । কাজকর্মের ব্যস্ততার ফাকে ফাকে নম্বরটা মনে পড়তে লাগল । এক আধবার প্যাডে নম্বরটা লিখেও ফেলল ।
বিকেলের দিকে কয়েকটা চিঠি সই করতে গিয়ে হঠাৎ চিঠির ওপরে টাইপ করা তারিখটা দেখে সে একটু সচকিত হল । টু – ফোর নাইন্টি ওয়ান । অর্থাৎ একানব্বই সালের দোসরা এপ্রিল । সিক্স ফোর নাইন ওয়ান মানে কি এপ্রিলের ছয় তারিখ ?
কথাটা টিকটিক করতে লাগল মাথার মধ্যে । অফিস থেকে বেরিয়ে সে গেল একটা ক্লাবে টেনিস খেলতে । তারপর একটা হােটেলে রাতের খাবার খেয়ে ফ্ল্যাটে ফিরে এল । টেনিস খেলার ফলে ক্লান্ত শরীরে খুব ঘুম পাচ্ছিল । শােবার আগে সে সভয়ে টেলিফোনটার দিকে চেয়ে রইল । দিল্লিতে ফোন করে মা বাবার একটা খবর নেওয়া দরকার । ফোন করাটা উচিত হবে কি ? যদি আবার ?
না , ফোন তুলে ডায়াল – টোনই পাওয়া গেল । দিল্লির লাইনও পাওয়া গেল একবারেই । মা , বাবা , ভাই ও বােনের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে মনটা হালকা লাগল । আজ শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ল ।
তিন – চারদিন আর কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটল না । টেলিফোন স্বাভাবিক । দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগটাও আস্তে আস্তে সরে যেতে লাগল মন থেকে ।
কিন্তু রবিবার সকালে গলফ খেলতে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল প্রদীপ । হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল । প্রদীপ অন্যমনস্ক ভাবে টেলিফোন তুলতেই সেই অবিস্মরণীয় যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর শােনা গেল , দিস ইজ দ্য ডে . . . . দিস ইজ দ্য ডে . . . দিস ইজ দ্য ডে . . . দিস ইজ দ্য ভে . . . . ।
সকালের আলাের মধ্যেও ভয়ে হঠাৎ হিম হয়ে গেল প্রদীপ । চিৎকার করে বলল , হােয়াট ইজ দ্য মিনিং অব ইট ?
অবিচলিত কণ্ঠস্বর একই ভাবে বলে যেতে লাগল , দিস ইজ দ্য ডে . . . দিস ইজ দ্য ডে . . . . ।
প্ৰদীপ চিৎকার করে ধমকাল , দু – একটা নির্দোষ গালাগালও দিল , কাকুতি মিনতি করল । কিন্তু কণ্ঠস্বরের অধিকারী ওই একটা বাক্যই উচ্চারণ করে গেল ।
এপ্রিলের কলকাতা এমনিতেই গরম । ফোনে চেঁচামেচির পর আরও ঘেমে উঠল সে । ফোনটা রেখে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইল । এর মানে কী ?
হঠাৎ খেয়াল হল , আজ এপ্রিলের ছয় তারিখ । সিক্স ফোর নাইন ওয়ান । আজকের দিনটা সম্পর্কে কেউ তাকে কিছু বলতে চাইছে কি ? কী বিশেষত্ব এই দিনটার ?
আজ তাে চমৎকার একটা দিন । আজ সারাদিন তার দারুণ প্রােগ্রাম । তাদের অফিসের সবচেয়ে বড় ক্লায়েন্ট মান্টু সিং সরখেরিয়ার আমন্ত্রণে তারা আজ যাচ্ছে কলকাতার বাইরে দিল্লী হাইওয়ের কাছে সরখেরিয়ার বিশাল বাগান বাড়িতে । সকালে সেখানে গলফ আর টেনিসের আয়ােজন , দুপুরে বিশাল লাঞ্চ , সন্ধ্যেবেলায় হাই টি । তারপরও গান বাজনা হবে । একেবারে ডিনার সেরে ফেরার কথা । এমন চমৎকার মজায় ভরা দিনটা নিয়ে চিন্তা করার কী আছে ?
ফুরফুরে হাওয়ায় হাওড়া ব্রিজ পেরিয়ে দিল্লী রােড হয়ে সরখেরিয়ার বাগানবাড়িতে পৌছনাের সময় দুশ্চিন্তাটা কখন উবে গেল ! অনেক অতিথি জড়াে হয়েছে , হাসি – হট্টগােল চলছে ! এক কাপ কফি খেয়ে নিয়েই গল কিট নিয়ে বেরিয়ে পড়ল প্রদীপ ।
সরখেরিয়ার খামারের পাশেই গলফের বিশাল মাঠ । মাঝে মধ্যে ঝােপজঙ্গল , জলা । অনেক গল্ফ – খেলােয়াড় জড়াে হয়েছেন । খেলতে খেলতে সব দুশ্চিন্তা সরে গেল মাথা থেকে ।
বলটা একটা ঝােপ – জঙ্গলের মধ্যে পড়েছিল । প্রদীপ বল খুঁজতে সেখানে ঢুকল । জায়গাটা যেন অন্ধকার এবং দুর্গম । কিন্তু জঙ্গলটা এমন জায়গায় যে , গর্ত পর্যন্ত যেতে হলে এই জঙ্গলটি পেরােতেই হবে ।
সেই জঙ্গলে নিচু হয়ে বলটা খুঁজবার সময়ে আচমকাই একটা দূরাগত কণ্ঠ যান্ত্রিক ভাবে হঠাৎ বলে উঠল , দিস ইজ দ্য ডে . . . .
একটা ক্লিক করে শব্দ হল কোথাও । সন্দেহজনক কিছু নয় কিন্তু হঠাৎ প্রদীপের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ই যেন কিছু জানান দিল । সে বিদ্যুৎ – গতিতে মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল । আর সঙ্গে সঙ্গে বজ্রপাতের মতাে একটা বন্দুকের শব্দ হল । গাছের গােটা কয়েক ডাল প্রচণ্ড শক্তিশালী বুলেটের ঘায়ে ভেঙে পড়ল । তারপরই একজোড়া পায়ের দ্রুত পালানাের শব্দ ।
প্রদীপ যখন উঠে বসল তখন খানিকটা হতভম্ব হয়ে চারদিক দেখল সে । কেউ তাকে মারার চেষ্টা করেছিল । কিন্তু খুবই সামান্যর জন্য সে বেঁচে গেছে ।
উঠে গায়ের ধুলােটুলাে ঝেড়ে চারদিকটা দেখল সে । কে তাকে মারতে চায় ? কেনই বা ?
বন্দুকের শব্দ শুনে কেউ ছুটে আসেনি । তার কারণ আশপাশে অনেকেই শিকারে বেরিয়েছে । বন্দুকের শব্দও হচ্ছে আশেপাশে ।
সারাদিনটা খুব অন্যমনস্কতার মধ্যে কেটে গেল প্রদীপের । ঘটনাটার কথা সে কারও কাছে প্রকাশ করল না । রাতে বাড়ি ফিরে সে টেলিফোনটার দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ , টেলিফোনে এই দিনটার পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছিল তাতে । কিন্তু কেন ? কে দিচ্ছিল ?
রাত সাড়ে দশটা নাগাদ টেলিফোন বেজে উঠল । সভয়ে টেলিফোন ধরল প্রদীপ ।
— হ্যালাে ।
ওপাশ থেকে একটি ভরাট গলা তার নম্বরটা উচ্চারণ করে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল , এই নম্বর তাে !
– হ্যা । আপনি কে ?
— আমি কুরুগ্ধ ।
আপনি কে ?
— প্রদীপ রায় ।
— ওঃ , হ্যা ।
আমি আপনার নাম জানি । দিল্লিতে ছিলেন । শুনুন , জরুরি একটা । কথা আছে । সরখেরিয়ার এক কোটি চব্বিশ লাখ টাকার একটা বিল আছে । আপনি কি সেটা পাস করে দিয়েছেন ?
না । বিলটা একটু ইরেগুলার । যাচাই করার জন্য ডিপার্টমেন্টকে বলেছি ।
খুব ভাল । ওই বিলটা একদম জালি । কিন্তু বিলটা আটকালে আপনার বিপদ হতে পারে । সরখেরিয়া বিপজ্জনক লােক ।
বােধ হয় আপনি ঠিকই বলেছেন । আজ কেউ আমাকে খুন করার চেষ্টা করেছিল ।
হ্যাঁ , এরকম ঘটনা আরও ঘটতে পারে । কিন্তু ভয় পাবেন না , টেলিফোনটার দিকে মনোেযােগী থাকবেন ।
এইবার প্রদীপ চমকে উঠে বলে , হ্যা , টেলিফোনেও একটা অদ্ভুত কাণ্ড হচ্ছে . . .
কুরুপ্পু স্নিগ্ধ গলায় বললেন , জানি মিস্টার রায় , ভূত মাত্রই কিন্তু খারাপ নয় । অন্তত ওই ফ্ল্যাটটায় যে থাকে সে খুবই বন্ধু – ভূত । তাকে অবহেলা বা উপেক্ষা করবেন না , ভয়ও পাবেন না । তা হলেই নিরাপদে থাকতে পারবেন । বিপদের আগেই সে সাবধান করে দেবে । আমাকেও দিত । তার পরামর্শেই আমি রিটায়ার করে ফুলের চাষে মন দিয়েছি ।
আচ্ছা গুড নাইট ।
প্রদীপ হাতের স্তব্ধ টেলিফোনটার দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল ।