ভূতের গল্প : কুয়েমুরির ফিস মার্কেট

সাড়ে তিন ঘন্টা বাসে, কোমর টা একেবারে ধরে গেছে পাছা গুলো যেন অবশ হবার জোগাড়! বিড় বিড় করে নিজের মনে কথা গুলো বলতে বলতে বাস থেকে নামলো অনুভব। এসপ্ল্যানেড থেকে রামগঙ্গা বেশ দুর। নেমে একটু অবাক হলো, বাস যেখানে থামলো রাস্তা সেখানেই শেষ তারপর জল, যতদূর চোখ যায় শুধুই জল। প্রথম বার রামগঙ্গায় আসা। বেশ সুন্দর।

অনুভব একটা ওষুধ কোম্পানির রেজিওনাল সেলস ম্যানেজার গোটা পশ্চিমবঙ্গই তার টেরিটোরি। একটা সিগারেট ধরিয়ে অনুভব ফোন করলো জয়দীপ কে। জয়দীপ এখানকার মেডিক্যাল রিপ্রেসেন্টেটিভ ওর হেড কোয়ার্টার পাথরপ্রতিমা। জয়দীপ এলো পাঁচ মিনিটে, স্যার কে নিয়ে হোটেলে পৌঁছে দিল বাইকে করে। কাছেই হোটেল “সি ভিউ”। নামেই হোটেল আসলে একটা লজ। জয়দীপ সকাল আটটায় আসবে বললো কাল কুয়েমুরি দ্বীপে কাজ, বাইকে জেটি ঘাট অবদি গিয়ে বাইক টা নৌকায় তুলে নিয়ে যেতে হবে, পৌঁছে বাইক নৌকা থেকে নামিয়ে কাজ সেরে আবার এক ই ভাবে ফেরা, মৃদু হাসি দিয়ে কথা গুলো বলে জয়দীপ বেরিয়ে গেলো। অনুভব ফ্রেশ হয়ে ডিনার অর্ডার করলো।

পরদিন ঠিক আটটায় হোয়াটস্যাপে টেক্সট এলো জয়দীপের, ও নিচে রাস্তায় ওয়েটিং। প্ল্যান অনুযায়ী প্রায় এগারো কিলোমিটার বাইকে গিয়ে সূর্যপুর ফেরিঘাট থেকে বাইক নৌকায় তুলে দুজনে কুয়েমুরি পৌঁছোল তখন পৌনে দশটা। গন্তব্যের যাত্রাপথে খুব আনন্দ পেয়েছে অনুভব। অনেক ছবি তুলেছে ম্যানগ্রোভের। চারদিক শুধু জল আর মাঝে মাঝে একটা করে সবুজ দ্বীপ। তার মধ্যেই এখন একটাতে ওরা। নেমে ঘুগনি মুড়ি ডিমভাজা আর চা খেয়ে লেগে পড়ল দুজনে। জয়দীপের এখানে দশ জন ডাক্তার মিট করার প্ল্যান সবাই কোয়াক কিন্তু এনারাই ত্রাতা।

বড় অসুখ হলে রুগী নিয়ে ছুটতে হয় কাকদ্বীপ অথবা ডায়মন্ড হারবার। যাই হোক কাজকর্ম করতে করতে প্রায় বেলা সাড়ে তিনটে আকাশ কালো করে তুমুল ঝড় বৃষ্টি নামলো, ওরা তখন ডা: অশান্ত জানার চেম্বারে। বাড়িতেই চেম্বার। প্রায় দু ঘন্টা টানা বৃষ্টি একেবারে মুষলধারা। ডাক্তারবাবু বললেন সাড়ে ছটায় শেষ খেয়া কুয়েমুরি থেকে কিন্তু এ যা দুর্যোগ আজ আর নৌকা চলা মুশকিল।

অনুভব জয়দীপের দিকে অসহায় ভাবে তাকালো! এদিকে বৃষ্টি থামার নাম নেই। ক্রমশ সন্ধ্যে নামলো ডাক্তার বাবু বললেন বাইক টা গেটের ভিতর ঢুকিয়ে আজ রাতটা ওনার বাড়ি কাটিয়ে কাল সকালে ফিরে যেতে এছাড়া কোনো রাস্তা নেই কারণ কুয়েমুরিতে অধিকাংশ জায়গায় বিদ্যুত ই নেই সুতরাং হোটেল পাবার নো চান্স! অগত্যা কোনো উপায় না থাকায় দুজনেই ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো ডাক্তারবাবুকে। দোতলার ঘরে একজন মহিলা এসে দুটো জলের বোতল আর দুটো লুঙ্গি দিয়ে গেলো ওদের। নটা নাগাদ নিচে বোয়াল মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে ওপরে শুতে এলো জয়দীপ আর অনুভব, তখনো বৃষ্টি থামেনি। রাত জেগে মোবাইলে সিনেমা দেখা বা দরকারি মেলের রিপ্লাই দেওয়া অভ্যেস কিন্তু ফোনে নেটওয়ার্ক নেই তাই বিরক্ত হয়ে শুয়ে পড়ল অনুভব। ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়েছে অনুভব, নতুন সকাল, নতুন জায়গা ঘুরে দেখার তাগিদে। বৃষ্টি থেমেছে। জামা প্যান্ট পরে টেবিল থেকে জয়দীপের বাইকের চাবি টা নিয়ে নিচে নামে। তখনো আলো ফোটেনি। বাইকটা গেটের বাইরে নিয়ে গিয়ে স্টার্ট দেয় অনুভব, কান মুলে এগিয়ে যায় সামনে। বেশ কিছুটা গিয়ে মন প্রাণ জুড়িয়ে যায় অনুভবের, একটা নিশ্চিন্ত সুবিশাল নদীর পাড়, শান্ত নিরিবিলি, আলো আঁধারিতে মিলেমিশে গেছে আকাশ আর জল। প্রাণ ভরে প্রশ্বাস নেয় অনুভব, অনুভব করে প্রকৃতির কোলে একটুকরো নির্মল আনন্দময় পৃথিবী।

হঠাৎ কিছু কোলাহল কানে আসে তার, বাইকটা নিয়ে আস্তে আস্তে বালির ওপর দিয়ে এগিয়ে যায় অনুভব। দেখে মাছের বাজার বসেছে, সামুদ্রিক মাছ সব। নৌকা ভিড়িয়ে মাছ নামানো হচ্ছে, নীল, হলুদ প্লাষ্টিক বিছিয়ে মাছ গুলো মেলে দেওয়া হচ্ছে সারি দিয়ে, কতো রকমের সব মাছ, নাম জানেনা অনুভব। পুরুষ, মহিলা, বাচ্চা সব্বাই খুব ব্যস্ত। হঠাৎ মাথায় আসে কাল থেকে ডাক্তার বাবু এতো আপ্যায়ন করলেন ওদের, কৃতজ্ঞতা বশত কিছু মাছ কিনে নিয়ে যাওয়া উচিৎ তাই বেশ কয়েক রকমের মাছ কেনার পর বাইক নিয়ে ডাক্তারবাবুর বাড়ির দিকে রওনা দেয় অনুভব, তখন আলো ফুঁটেছে একটু একটু!

বাড়ির সামনে এসে ঘাবড়ে যায় সে। ডাক্তারবাবু, জয়দীপ, বাড়ির বাকি সদস্য সবাই গেটের বাইরে, অনুভবকে দেখেই ডাক্তারবাবু প্রশ্ন করেন কোথায় ছিলেন আপনি? অনুভব সব বলার পর ডাক্তারবাবু জানতে চান মাছ গুলো কোথায়? বাইকের হ্যান্ডেল থেকে প্লাষ্টিকের ক্যারিপ্যাক টা নামিয়ে ডাক্তারবাবুর হাতে দেয় অনুভব। উনি প্যাকেট টা উল্টে মাছ গুলো ঢালতে গিয়ে দেখেন শুধু গুঁড়ো ছাই! চমকে ওঠে অনুভব গা শির শির করে ওঠে ওর! ডাক্তারবাবু ভেতর থেকে এনে একগ্লাস জল দিয়ে শান্ত হয়ে বসতে বলেন অনুভবকে।

উনি জানান কুয়েমুরির নদীর ধারে একটা জেলে বস্তি ছিল বহুদিনের পুরনো। ওরা নদী, সমুদ্র, খাঁড়ি থেকে মাছ ধরে কিছুটা বিক্রি করতো এখানে আর বেশিরভাগ টা পাঠাতো ডায়মন্ড হারবারের পাইকিরি মাছের বাজারে কিন্তু 2009 সালের মে মাসে আয়লা তে জেলে দের পুরো বস্তি টাই উজাড় হয়ে গিয়েছে কিছু জেলে সমুদ্রে ডুবে মারা যায়, কিছু জেলে দের পরিবার বাড়ি চাপা পড়ে প্রাণ হারায়, কিছু মানুষের খোঁজই মেলেনি আর, যে কয়েকজন জীবিত ছিল মহিলা বা শিশু তারা সরকারের তৈরি অস্থায়ী শিবিরে আশ্রয় নেয়, জায়গা টা এখন ধু ধু মৃত্যুপুরী, এক নিশ্বাসে কথা গুলো বলে থামেন ডাক্তার বাবু! সব শুনে অনুভব প্রশ্ন করে তাহলে কি…. শেষ করার আগেই ডাক্তারবাবু উত্তর দেন হ্যাঁ আপনি ভূত ই দেখেছেন!!
ঈশ্বরের অসীম কৃপা আপনার কোনো ক্ষতি হয়নি!!

স্নান, খাওয়া সেরে রামগঙ্গার উদ্দেশ্যে বেরোবার আগে জয়দীপ আর অনুভব ডাক্তারবাবুকে বিদায় জানাতে চেম্বারে যায় ডাক্তারবাবু অনুভবকে বলেন একটু বসুন..
আপনার বডি টেম্পারেচার আর ব্লাড প্রেসার টা একবার চেক করবো!!!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page