ভূতের গল্প : কার সংকেত

ছোট পাড়াগেঁয়ে শহর । ঢালামাঠ , অনেকটা দূরে দূরে কয়েকখানা টিনের ঘর । ঘরগুলাে ছুঁয়ে ছুঁয়ে আঁকাবাঁকা , কাচা মাটির রাস্তা । বিকেল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে । পথে লােকজন নেই , একটা গরুর গাড়িও চলছেনা । সবে সন্ধ্যে , কিন্তু মনে হচ্ছে যেন মাঝ রাত ।পৃথিবী যেন ভয়ে চোখ বুজে আছে , এমন অন্ধকার । চলেছে একটানা ধারাবাহিক বৃষ্টি — শূন্যময় শােনাচ্ছে একটা কাতর গােঙানির মত । তাতে শরীরের ঘুম আসে না , একটা ক্লান্তিকর বিভীষিকা । বৃষ্টির একঘেয়ে কাতরতা ছাড়া কোথাও এতটুকুশব্দ নেই — না বইছে জোলাে হাওয়া না ডাকছে একটা ঝি ঝি । মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকালে বােধ হয় অন্ধকারকে এমন ভয়ঙ্কর লাগত না । একটা বাজ ডাকলে দেখা যেত কাছাকাছি কোনাে বাড়ি – ঘর আছে কিনা , তাহলে একটা আশ্রয় পাওয়া যেত । সব-কিছুকে এমন একা , এমন দূর মনে হচ্ছে ।মাঠের শেষ সীমানাতেই কেশব মজুমদারের বাড়ি । তেজারতি কারবার করে কেশবের বিস্তর পয়সা । কিন্তু হলে কী হবে , মনে তার সুখ নেই । তার মুখের চেহারা আজকের এই আকাশের চেয়ে ঘােরালাে । তার সমস্ত বাড়িতে আজকের এই বিবর্ণ অন্ধকার যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ।ক – দিন থেকেই এ – অঞ্চলটায় ডাকাত আসছে উড়াে খবর এসেছে , কেশবের বাড়িতেও শিগগিরই ডাকাতদের দলের পদধূলি পড়বে । কেশব দিনে – রাতে তটস্থ , শুয়ে আছে সে । কিন্তু সে ভয়ে কাঁটা । বিছানায় লাঠি – সোঁটা হাতিয়ার বন্দুক সব সে হাতের কাছে যােগাড় করে রেখেছে বটে , কিন্তু মনে তার তবু স্বস্তি নেই । চোখে একটু ঘুম জড়িয়ে এলে মনে হয় গায়ে তার কে সুড়সুড়ি দিচ্ছে , চোখ খাড়া রেখে জেগে থাকলে মনে হয় , পেছনের দেওয়ালে কার যেন এই ছায়া পড়ল । তারপর আজ যা বৃষ্টি শুরু হয়েছে , প্রতিক্ষণে মনে হচ্ছে এই যেন কারা এল , এই শােনা গেল কাদের চাপা গলায় ফিস্‌ফিসানি ।বৃষ্টির আর বিরাম নেই । জলে-কাদায় রাত উঠেছে ঘােলা হয়ে । কেশবের স্ত্রী এল তাকে অভয় দিতে ; বললে , ‘ এবার শুয়ে পড় । ডাকাতদের আর খেয়ে – দেয়ে কাজ নেই , এই ঝড়জলের মধ্যে তারা বিছানা ছেড়ে বাইরে বেরুবে ! কেশব বললে , হ্যাঁ , এইবার শুয়ে পড়তে হয় বৈকি । কিন্তু বাইরে কে দরজাটায় ধাক্কা দিচ্ছে না ?কেশবের স্ত্রী খেঁকিয়ে উঠল , ‘দরজায় তাে নয় , তােমার মাথায় ধাক্কা দিচ্ছে । ‘‘না , না , শােন কান পেতে ! কে ডাকছে না আমাকে ?’‘ ডাকাতরা তােমার নাম ধরে আদর করে ডাকতে যাবে না ।’কেশব চঞ্চল হয়ে উঠে দাঁড়াল । ভীত , অসহিষ্ণু গলায় বললে —“ আওয়াজটা বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠছে । আশ্চর্য , তুমি শুনতে পাচ্ছ না ।’ স্ত্রী ধারালাে গলায় তাকে ধমকে উঠলঃ কী বুদ্ধি তােমার ! ডাকাতরা তােমাকে দরজা খুলে দেবার জন্যে সকাতরে অমন সাধবে কিনা !তারা হুড়মুড় করে খিল কপাট ভেঙে চলে আসতে পারে না ? হাওয়া , ওটা হাওয়ার শব্দ ।’‘না , না স্পষ্ট মানুষের গলা !’ লণ্ঠনটা উসকে দিয়ে কেশব বন্দুকটা বাগিয়ে ধরল ।বলল , ‘ কে ?কোন সাড়া নেই ।স্ত্রী হেসে উঠল ডাকাতরা তাদের নাম – ধাম তোেমাকে বলবে কিনা ! কী বুদ্ধি !’কেশব আবার হাঁক দিল — ‘ কে ?’দরজার ওপার থেকে ভিজে মসৃণ গলায় কে বলল , “ আমি !”ভয়ে সমস্ত ঘরটা যেন ছােট হয়ে এল । লণ্ঠনের আলাে যেন গেল কমে , দেয়ালগুলাে হেঁটে কেশবের চারপাশে এল সরে , দাঁড়াল ঘন হয়ে । প্রাণপণে সাহস সঞ্চয় করে কেশব বললে , ‘ কে ’ আমি কে ?‘ আমি মণীন্দ্র ।’মণীন্দ্র ! কোন মণীন্দ্র ? ’ কেশবের গলা চিরে আওয়াজ বেরুল ।ওপার থেকে রাত্তির অন্ধকার যেন কথা কয়ে উঠল — “ মণীন্দ্র , মণি — আপনার ভাইপাে । ব্যাণ্ডেলে যে কাজ করত , যাকে আপনি ছেলেবেলা থেকে মানুষ করেছেন । দরজাটা খুলুন , বাইরে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায় ।‘ কে মণি ? কতদিন পরে ।’উৎসাহিত হয়ে কেশব দরজা খুলতে যাচ্ছিল , স্ত্রী তাকে বাধা দিল । গলা নামিয়ে বললে , ‘কে না কে মণির নাম ভঁড়িয়ে এসেছে । খবরদার দরজা খুলাে না বলছি , নইলে তিন – চার বছর যে এদিক মাড়ায়নি , বলা কওয়া নেই হঠাৎ সে এসে দরজায় ঘা মারবে ? তা আবার এ দুর্যোগের রাতে ! কী বুদ্ধি তােমার ।’পাশের জানালাটায় ছিটকানি লাগানাে ছিল না , মণি হঠাৎ ভিতর দিয়ে তার একখানি হাত বাড়িয়ে দিলে । রােগা লিকলিকে , সরু একখানি হাত । বললে , ‘আলােটা নিয়ে আসুন , দেখুন , সেই যে ছেলেবেলায় কব্জির কাছটায় কেটে গিয়েছিল সেই দাগটা স্পষ্ট , অটুট আছে । খুলে দিন দরজা , জলে আর কতক্ষণ দাঁড়াব বলুন ? ‘আর সন্দেহ নেই । কেশব এক হাতে দরজা খুললে , আরেক হাতে বন্দুকটা বাগিয়ে ধরেছে । বিস্ময়ে বন্দুকটা হাত থেকে খসে পড়ে আর- কী !সত্যি সত্যিই সামনে মণি দাঁড়িয়ে । মণি হাসিমুখে বললে , ‘আমাকে সম্বর্ধনা করবার এই অদ্ভূত আয়ােজন দেখছি যে ।’লজ্জায় বিমর্ষ হয়ে কেশব বললে , ‘কিছু মনে করিসনে । এদিকে আজ কাল বড্ড ডাকাত পড়ছে , তাই সব সময় এমনি সাবধান হয়েই থাকি।’‘কখন কী হয় বলা যায় না তাে !’মণি বললে , ‘তা আমি জানি ! তা জেনেই তাে আমি এলাম ।’কেশব অবাক হয়ে বললে , ‘কোত্থেকে এলি এত রাত্রে !’‘বাঃ সেই ব্যাণ্ডেল থেকে । আমাদের কী , ‘ মণি তার সমস্ত শরীরটা বিস্ফারিত করে বললে , ‘আমরা সােজা হেঁটেই চলে আসতে পারি ।’‘তাের চাকরি আছে না ?’মণি খিক খিক করে হেসে উঠল : ‘ সে চাকরিটা গেছে । কদিন এখানে ওখানে ঘােরাঘুরি করলুম । শুনলুম আপনাদের এখানে বিপদ , তাই ভাবলুম একবার দেখা করে আসি ।’‘ তা বেশ করেছিস ’ , স্ত্রীকে কেশব বললে , ‘ওর কিছু খাবার যােগাড় কর চট করে ।’মণি ব্যস্ত হয়ে বললে , ‘না আমার ক্ষিদে নেই । শােবার জন্যে এখন একটা বিছানা পেলেই আমি বাঁচি ।আপনারাও আর মিছিমিছি কেন জেগে আছেন ? ঘুমােতে যান এবার । ডাকাত এলে আসবে ভয় কী ? আমি তাে আছি । আমি তবে এত পথ ভেঙ্গে এলুম কী করতে ?’মণির খুড়িমা মুখ বেঁকিয়ে বললেন , ‘চাকরি খুইয়ে এখন থেকে এইখানেই তবে শেকড় গজিয়ে বসবে নাকি ? কাকার ভাত খুব সস্তা পেয়েছ না ?’‘না !’ মণি গম্ভীর মুখে বলল , ‘ কাল ভােরেই আবার আমি চলে যাব ভয় নেই ।’‘তবে একরাত থেকে তুমি কী এমন সাহসের ভােজবাজি দেখাবে শুনি ?’ খুড়িমা ঝাঁজিয়ে উঠলেন : ‘ডাকাতরা তো আর তােমার ফরমাস মত আসবে না ।’‘তবু তাে একটা রাত আপনারা নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমুতে পারবেন ।’ মণি কী – রকম অদ্ভূত করে হাসল ? বলল ‘ ঘুমে আমার চোখ ঢুলে আসছে , শিগগির বিছানা করে দিন । এই বাইরের ঘরটাই বা মন্দ কী ! আমার কিছুতেই আর ভয় নেই ।’খুড়িমা বিছানা পাততে লাগল ।কেশব মণির আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বলল , ‘এত জলের মধ্যে দিয়ে এলি , তবু একফোঁটা ভিজলি না , মণি !‘ সঙ্গে আমার এক বন্ধু আসছিল যে , সে – ই তাে তার ছাতায় আমাকে এগিয়ে দিয়ে গেল !’ মণি একলাফে বিছানায় শুয়ে পড়ল আগাগােড়া একটা কথা মুড়ি দিয়ে বলল , ‘ আপনারাও আর কেন মিছিমিছি জেগে আছেন ? নরম ঠাণ্ডা রাত , গা ভরে চমৎকার ঘুম আসবে । বাইরের ঘরে আমি তাে রইলাম পাহারায় তবে আর কিসের ভয় ?’‘ আহা যা একখানা টিঙ-টিঙে চেহারা , তার বীরত্বের বহর দেখ একবার !’ খুড়িমা ঠাট্টার কণ্ঠস্বর বিকৃত করে বললেন , ‘ খাটের নিচে দুয়েকটা ইদুরের গর্ত আগে থেকে খুঁজে রেখাে । নইলে চাকরি গেছে , প্রাণটাও যাবে আর কী !’কাঁথার তলা থেকে মণি বিকৃত গলায় হেসে উঠল ।বৃষ্টি থেমে গেছে , আকাশ মরা মুখের হাসির মত ফ্যাকাশে হয়ে ।কেশবরা তাদের ঘরে গেছে । স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কেমন একটা আতঙ্কিত স্তব্ধতা !স্ত্রী বললে , ‘ঐ লােককে যে তুমি পরিপাটি করে বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে রেখে এলে , সত্যি ও তােমার ভাইপাে তাে ? ”কেশব ভীত অথচ স্মিত মুখে বললে , ‘ বা মণিকে তুমি চেন না ? ‘‘ চিনি তাে । কিন্তু এতদিন বাদে খুড়াে – খুড়ির সঙ্গে দেখা , কাউকে একটা প্রণাম পর্যন্ত করলে না । চেহারা গলার স্বর অবধি কেমন বদলে গেছে । হাত – পায়ের শির উঠে এসেছে , খাড়া – খাড়া চুল , গালে – গলায় হাড় উঠেছে ঠেলে — ভাল করে লােকটার দিকে তাকিয়ে দেখেছিলে তাে ? ”কেশবের শিরদাঁড়াটা ভয়ে কনকনে হয়ে উঠল । অথচ মুখে সাহস এনে বললে , ‘কী যে তুমি বল ! চাকরি – বাকরি নেই , তাই চেহারা এমন দুর্ভাবনায় খারাপ হয়ে গেছে ।দেখছ না ডাকাতের ভয়ে আমিই কেমন শুকিয়ে যাচ্ছি । ও কিছু নয় ।’কেশবের স্ত্রী খাটো গলায় বললে , ‘কিন্তু এসেই একেবারে লম্বা দিল কেন ? তাও মুখ – চোখ ঢেকে , — এমন কী একেবারে লম্বা , জিজ্ঞেস করি ? তােমাকে বলছি ও মণি নয় । পাছে মণি নয় বলে চিনতে পারি তাই অমনি ঝুপ করে কাঁথার তলায় লুকিয়ে পড়ল , চল , এখনও হয়ত ঘুমিয়েছে , কাঁথার ঢাকনাটা আস্তে আস্তে তুলে চেহারাটা ওর একবার দেখে আসি ।’কেশবের গা – হাত পা শির্‌ শির্‌ করে উঠল , সােজা গলায় বললে , ‘আজ আর নয় , কাল ভােরে ।’‘ কাল ভােরে তাে চলেই যাবে । যা ঘটবার তা তাে আজ রাতেই – ‘‘কেশব অস্ফুট গলায় চিৎকার করে উঠল ? এত কথা আগে তবে বলনি কেন ?’কেশবের স্ত্রী কণ্ঠস্বরকে ঝাপসা করে বললে , ‘ ও যে – ই হােক , আমার মনে হচ্ছে ওই ডাকাত !’‘ বল কী ! বল কী !’ অন্ধকারে শূন্যে চোখ মেলে কেশব বললে , ‘ ডাকাত গণিতে শুয়ে শুয়ে ঘুম দিচ্ছে কেন ?’

‘ ও আগে থেকে এখানে রয়েছে দলের লােকদের দরজা খুলে দিতে । তুমি দেখাে আমার কথা ঠিক হয় কী না । কথায় – বার্তায় এমন একখানা ভাব দেখালাে যেন আজ রাত্রে আমাদের বাড়িতে ডাকাতি হবে বলেই ও এসেছে । কী করে জানল ও এত কথা ? আর কী বড়ফাট্টাই , আমাদের উনি বাঁচাবেন । সবংশে শেষ করে দেবার মতলব !’

কেশব যেন বন্দী , অসহায় একটা পশুর মত গর্জে উঠল ‘এখন কী করা যায় ?’

কেশবের স্ত্রী ঝামটা মেরে উঠল ‘ ঘুমােনো ছাড়া কী আর করা যাবে ? সারা জীবন তাে কেবল নাকে তেল দিয়েই ঘুমুলে ! ’

কেশব দেয়ালের দিকে আরাে একটু ঘন হয়ে সরে বসল ! বললে , ‘ তুমি বলতে চাও মণি আমার এই সর্বনাশ করবে । আমি যাকে ছেলেবেলা থেকে মানুষ করলাম ।’

‘ মণি কী না তাই বা কে জানে ! আর কাটুক না খানিকটা রাত ।’

আরাে খানিকটা রাত কাটল । কোথাও কোন সাড়া – শব্দ নেই । বাইরের ঘরটা ঘুমে একেবারে মুছে গেছে । একটি নিঃশ্বাস পর্যন্ত শােনা যাচ্ছে না ।

দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসে থাকতে থাকতে কেশবের হালকা একটু তন্দ্রা এসেছিল । হঠাৎ একটা গােলমালে তার হাড়ে – হাড়ে ঠোকাঠুকি লেগে গেল । গােলমালটা যে কিসের , স্পষ্ট সে কিছু ধারণা করতে পারল না । স্তম্ভিত হয়ে একতাল মাংসের মত বসে রইল । মনে হল মরবার আগের মুহূর্তে মানুষ বুঝি এমনি নিস্তব্ধ হয়ে যায় ।

তার গায়ে একটা ধাক্কা মেরে তার স্ত্রী বললে , শুনছ , বাড়িতে ডাকাত পড়েছে !’ কেশব মুর্ছাহতের মত বললে , ‘ কোথায় ?’

গােলমালটা ঠিক আক্রমণের জয়ােল্লাস নয় , যেন পলায়মান কতকগুলি লােকের ভীত – কাতর আর্তনাদ । গােলমালটা ক্রমশ যেন দূরে সরে যাচ্ছে ব্যাপার কী ।

কেশব সাহস পেয়ে বলে উঠে – ‘বন্দুক আমার বন্দুক ।’ বন্দুকের দরকার ছিল না , চিৎকারটা তখন রাস্তা ছেড়ে মাঠে পড়েছে ।

বাইরের ঘরে এসে কেশব জানলাটা খুললে । বৃষ্টির পর আকাশে তখন ঘােলাটে একটু জ্যোৎস্না ফুটেছে । সেই আবছা – আলােয় স্পষ্ট দেখা গেল একদল লােক উৰ্দ্ধশ্বাসে । প্রাণ নিয়ে ছুটে পালাচ্ছে দুর্দান্ত বেগে । এক একবার তারা পেছন ফিরে তাকায় – কী দেখে তারা কে জানে — আবার মাঠের উপর দিয়ে এলােপাথাড়ি ছুটতে থাকে ।

‘ ঐ এল ঐ এল ধরতে ’ — সবার মুখেই সেই ভয়ার্ত চিৎকার ।

কেশবের স্ত্রী বললে , ‘এত গােলমাল , রাস্তায় লােকজন জমে গেল , আর তােমার বীর ভাইপাের এখনও ঘুম ভাঙল না ! উনি এসেছিলেন আমাদের ধনেপ্রাণে রক্ষা করতে ।’

কেশব খাটের কাছে এগিয়ে এসে হুঙ্কার দিলে – ‘মণি ‘ । কাঁথাটা কোথাও এইটুকু কুঁচকানাে পর্যন্ত নেই ।

‘মণি !’

কে কাকে ডাকছে ।

কেশব একটা হেঁচকা টানে কাঁথাটা তুলে ফেলল । কোথায় মণি ! সমস্থ বিছানাটা সাদা , তেমনি পরিপাটি কোথাও একটা রেখা পর্যন্ত নেই ।

কী ব্যাপার !

বাইরে এসে দেখা গেল , ডাকাত সত্যিই এসেছিল । অনেক সব চিহ্ন তারা ফেলে গেছে — ছােরা , শাবল , মুখােস , লােহার ছােট ছােট ডাণ্ডা । একজন এমনকি একপাটি জুতাে , পালাবার তাড়ায় কারুরই কোন দিশে ছিল না । কিন্তু মণি গেল কোথায় ?

কেশবের স্ত্রী বললে , ‘এই সামান্য ব্যাপারটা তুমি বুঝতে পারছ না ? বীটের পুলিশ কোথাও এদিকে টহল দিচ্ছিল হয়ত , তাই দেখে ডাকাতরা চোঁচা ছুটে পালিয়েছে । আর উনি তােমার মণি হচ্ছেন ডাকাতের দলের সর্দার — কী করে আর শুয়ে থাকেন বল , ওদের সঙ্গে উনিও দিলেন দৌড় ।’

কেশব হতভম্ব হয়ে বললে , ‘তাই হবে ।’

‘তাই যদি না হয় তবে ও ফিরে আসত না ? ডাকাত তাড়িয়ে দেবারই যদি ওর মুরােদ থাকত তবে নিজেও সে সেই সঙ্গে পালিয়ে যাবে কেন ?’

‘ঠিক বলেছ , নইলে ও-ই বা সেই সঙ্গে পালিয়ে যাবে কেন ?’ কেশবের এতক্ষণে বুদ্ধি খেলল । পরে ঢােক গিলে বলল , কিন্তু কিছু নেবার চেষ্টা না করে দল-কে দল পগার পার হয়ে গেল , এ – ও একটা রহস্য বটে ।’

‘ রহস্য না হাতি ।’ কেশবের স্ত্রী মুখ ঘুরিয়ে বলল – ‘না পালালে দেখতে কখন ঐ তােমার ভাইপােটিই তােমার বুকে ছুরি বসিয়ে দিত ।’ আসুক না পুলিশ , দলের সর্দারকে যখন চিনতে পেরেছি তখন আর ভাবনা নেই ।’

সকালবেলা যথাসময়ে পুলিশ এল ।

কেশব মণীন্দ্রের নাম – ধাম জ্ঞাতি – গােষ্ঠীর সব পরিচয় দিয়ে হঠাৎ বেদনায় উল্লাসিত হয়ে উঠলঃ ‘কী দারুণ অকৃতজ্ঞ ভাবুন ! আমি তাকে ছেলেবেলা থেকে মানুষ করেছিলুম , আর সে এসেছিল আমার বুকে ছুরি বসাতে ! তাকে দিলুম আশ্রয় , আর তার কিনা এই ছিল মতলব ।’

কেশবের স্ত্রী ঘর থেকে মুখ-ঝামটা দিয়ে উঠল – ‘আমি তাে তখনই বলেছিলুম !’

‘ ডাকাতের সর্দার ! ওর দশটি বছর জেল চাই , দারােগাবাবু ! হাড়ে-হাড়ে শয়তান , নইলে কোনদিন কেউ খুড়াের বুকে ছুরি তুলতে পারে ? হ্যাঁ , ঐ ছুরি প্রায় বুকে বসাচ্ছিল আর কী , এক ইঞ্চি নামলেই সাবাড় — ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে ।

দারােগাবাবু জিজ্ঞেস করলেনঃ – ‘আপনি কী করলেন ?’

কেশব লাফিয়ে উঠলঃ ‘ বন্দুক , আমার বন্দুক আছে না ? খপ্‌ করে তাই উঁচিয়ে ধরলুম । ভয়ে সে চেঁচিয়ে উঠল , মুখ থেকে মুখােস গেল খসে । দেখলুম মণীন্দ্র । ব্যাণ্ডেলে সে কাজ করে , আমার আপন ভাইপাে । রাতে যে লণ্ঠন জ্বালিয়ে রাখি । চিনতে দেরি হবে কেন ? ‘

‘তারপর ?’

‘ ছুট দিল লম্বা । যা ছিল যন্ত্রপাতি , সব গেল ? ‘ কেশব গর্বে টগবগ করে উঠল – ‘ বন্দুকের সঙ্গে পারবে কেন ? ঘােড়াটা টিপতে গেলুম দারােগাবাবু , পারলুম না । শত হলেও তাে নিজের বংশের রক্তপাত’ –

কেশবের স্ত্রী ঘর থেকে খেঁকিয়ে উঠল ; ‘ আমিই বারণ করলুম বন্দুক ছুঁড়তে !’

‘হ্যাঁ ’, কেশব মুখ কাঁচুমাচু করে বললে , ‘ বলার তো আর অপেক্ষা রাখে না । ওঁর পরামর্শ শুনেই আমাকে কাজ করতে হয় ।’

দারােগাবাবু বললেন , “ কিছু নিতে পারেনি তাে ?’

‘ নেবে ?’ কেশব বুক চিতিয়ে দাঁড়ালঃ ‘ নিক্‌ না , দেখি , তার কতখানি বুকের পাটা !’

দারােগাবাবু যন্ত্রপাতি সব কুড়িয়ে নিলেন থানায় জমা দিতে । বললেন , ‘ওদের সহজেই ধরে ফেলতে পারব । অনেক সব ক্লু পেয়ে গেলাম – এর আগে কোথাও একটা পায়ের দাগ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি । অথচ বন্দুক সব বাড়িতে ছিল । ‘

কেশব অহংকারে স্ফীত হয়ে বললে , ‘বিন্দুক থাকলেই তাে চলে না তাকে বাগিয়ে ধরবার কায়দা জানা চাই ।’

দারােগাবাবু যাবার আগে বললেন , ‘ এ গ্যাঙ ধরতে পারলে দেশের একটা খুব স্থায়ী উপকার করা হবে , কেশববাবু । আপনার সাহস ও কৌশলকে পুরস্কৃত করতে পারলে আমরা খুশী হব । আপনার ভাইপাের খোঁজে আজই আমরা ব্যান্ডেলে লােক পাঠাচ্ছি । আর এই যে এক পাটি জুতাে দেখছেন , তা থেকে এর মালিককে খুঁজে পেতে আমাদের দেরি হবে না ।’

আবার রাত এল ঘনিয়ে । আজকে আর বৃষ্টি নয় , ফুটফুটে জ্যোৎস্না ! দিয়েছে এলােমেলাে হাওয়া !

লণ্ঠন নিভিয়ে কেশব বাইরের ঘরে তার মশারির মধ্যে এসে ঢুকল । চারিদিক ভাল করে খুঁজে সে নিশ্চিন্ত হয়ে শুয়ে পড়ল । হঠাৎ দেখতে পেল মশারির ভিতর ঠিক তার গলার উপর কার একটা হাত । তেমনি রােগা , লিকলিকে । আঙুলগুলি সাপের মত পিছল , আঁকাবাঁকা । আঙুলগুলি তার গলার উপর আলগােছে সুড়সুড়ি দিচ্ছে ।

প্রাণপণে চোখ বুজে সমস্ত শরীর কঠিন করে কেশব চেঁচিয়ে উঠল , “ কে ? মশারির বাইরে থেকে স্পষ্ট উত্তর এল – ‘ আমি !’ চিনতে পাচ্ছেন না ! এই দেখুন কব্জির দাগ ।’

কেশব ভয়ে – ভয়ে চোখ মেলল । মশারির বাইরে কারুর কোন অস্তিত্বের আভাস নেই ।

‘ বন্দুক , আমার বন্দুক’ কেশব ধড়মড় করে উঠে বসল । নামতে গেল খাট থেকে । মশারি তুলতে যাবে , অমনি আবার তার বুকের ওপর সেই হাতটা লােলুপ হয়ে উঠল । কে বললে , ‘আমিই আপনাকে খুন করতে এসেছিলাম , না ? আমি খুবই অকৃতজ্ঞ ?’

স্পষ্ট পরিচিত গত রাত্রির কণ্ঠস্বর ।

কিন্তু চোখ কচলে কেশব দেখল , ঘরে বাইরে ঝিম্ ঝিম্ করছে শূন্যতা !

‘ বন্দুক , আমার বন্দুক নিয়ে এস শিগগির ! ’ কেশব স্খলিত পায়ে নিচে নেমে এল । ছুটে গেল দরজার দিকে । পা দুটো নিমেষে পাথর হয়ে গেল — দরজার কাছে একটা চেয়ার টেনে মণি গা এলিয়ে বসে আছে ।

‘ একি , মণি যে ! তুমি কোত্থেকে ? ’ কেশব একেবারে বসে পড়ল ।

মণি নির্লিপ্ত গলায় বললে , ‘ কাল যেখান থেকে এসেছিলাম ।’

‘ কী মনে করে এসেছ জিজ্ঞেস করতে পারি ।’

‘ধরা দিতে এসেছি । আপনি থাকতে পুলিশ কেন কষ্ট করে ধরবে বলুন ? পুরস্কারটা আপনারই হােক ।’

‘ আহাহা , সে কী কথা ! তুমি আমার ভাইপাে ! তােমাকে ধরিয়ে দেব কী ? বস , কেশব ভিতরে চলে যাচ্ছিল , দরজার উপর আবার সেই হাত ঝুলছে ।

‘ বন্দুক আনতে যাচ্ছেন ? ” মণি হেসে উঠল : ‘ তার দরকার নেই । ‘বন্দুকে আমার কিছু করতে পারবে না । বসুন , একটা কথা বলি ।’

কেশব কাঁপতে কাঁপতে বলল , কী ?’

‘ কাল আমিই ডাকাতদের তাড়িয়ে দিয়েছিলুম । আপনি আমাকে মানুষ করেছিলেন সেই কথা আমি ভুলিনি । ‘

‘ কিন্তু কী করে তাড়ালে ? ’ কেশব ভয়ে একেবারেই ছাই হয়ে গেছে ।

‘ আমি ম্যাজিক জানি । ‘ বলে মণি অনর্গল হেসে উঠল । ‘সেই ম্যাজিক দেখাতেই তারা চম্পট দিল । দেখবেন সেই ম্যাজিক ?’

দেয়ালের দিকে কেশব তার দৃষ্টিহীন শূন্য দুটো চক্ষু তীক্ষ করে তুলে ধরল ।

হঠাৎ সমস্ত দেয়াল – ছাদ বিদীর্ণ করে কেশবের গলা থেকে প্রবল একটা চিৎকার বেরুল । মণি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে । তার মাংসল মূর্তিটা ধীরে ধীরে শুকনাে সাদা , কঠিন , কঙ্কালে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে — পা , হাত , দাঁত , খুলি । এক একটা করে মাংসপিণ্ড ঝরে পড়ছে আর তার স্বর হয়ে আসছে অস্পষ্টতর : “ আমি আপনাদের এমন একটা উপকার করলুম , আর আপনি দিলেন আমাকে এই অকৃতজ্ঞতার অপবাদ ! ডাকুন খুড়িমাকে — দূর থেকে হাওয়ায় একটা হাতের আলােড়ন শােনা গেল : দেখে যান আমার এই টিঙটিঙে দুর্বল দেহ কী ভয়ঙ্কর শঁক্তি ধরে । দেখে যান আমি সত্য ডাকাত তাড়াতে পারি কীনা !’

হাওয়ায় সেই খন্ড – খন্ড সাদা হাড়গুলি হাহাকার করে উঠল ।

শিগগিরই পুলিশ-রিপাের্ট পাওয়া গেল অবিশ্যি । ফেলে যাওয়া নিদর্শনগুলি থেকে ডাকাত দল ধরা পড়েছে বটে , কিন্তু কোথায় তাদের সর্দার ! মণীন্দ্রের খোঁজ পাওয়া গেল । সে পলাতক – পৃথিবী থেকে পলাতক । ব্যান্ডেল স্টেশন ছাড়িয়ে হঠাৎ এক রাত্রে লাইন পেরােতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়েছে । কিন্তু তা নাকি ঘটনার ক – দিন আগে ।

খবর পেয়ে কেশব আর তার স্ত্রী গলা ছেড়ে কাঁদতে বসল । অবাক হয়ে চেয়ে দেখল , চোখে আর একফোঁটা কান্না নেই , সেই কাটা হাতটা তাদের চোখের জল মুছিয়ে দিতে এগিয়ে আসছে । কাঁদতে বসাও বিড়ম্বনা ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page