ভূতের গল্প : আঠারো বছর পরে

পরীক্ষার ঠিক আগেই পুলু মানে পুলকেশ তার সব থেকে নিকট বন্ধু উজ্জ্বলকে বলল কথাটা ।উজ্জ্বল হ্যাঁ হয়ে বলল , কী বললি ? পরীক্ষায় ফেল করলে তুই হয় গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়বি নয়তাে — রেল লাইনে গলা দিবি ?পুলু বীরদর্পে বলল , তাে ফেল করলে তাছাড়া আবার কী করব শুনি ? আঁ ? তােরা সবাই কলেজে ভর্তি হতে যাবি আর আমি এই মেচেদা বয়েজ হাইস্কুলে পড়ে থেকে জাবর কাটব ? ইয়ার্কি না কি ?উজ্জ্বল রেগে বলল , আগে থেকেই মড়াকান্না কাঁদছিস কেন ? না মরতেই কফিন বানিয়ে কবর খুঁড়ে রাখছিস কী জন্যে । ফেলই বা করতে যাবি কেন ?পুলু আরাে বীরদর্পে বলল , সারাবছর পড়ার বইয়ের পাতা ওল্টাবাে না , কেবল গােয়েন্দা গল্প পড়বাে আর আড্ডা মেরে বেড়াব আর পরীক্ষায় পাশ করব ? মামদোবাজি না কি ?উজ্জ্বল এবার রেগে বলল , ওঃ ! আমার কাছেও গুল মারতে এসেছিস ? সারা বছর তুই পড়ার বইয়ের পাতা ওল্টাসনি ? শুধু গল্পের বই পড়ে আর আড্ডা দিয়ে কাটিয়েছিস ? এই কথা বিশ্বাস করতে বলছিস আমায় ? বিশ্বাস করা না করা তাের ইচ্ছে । তবে গডপ্রমিস । মা কালীর দিব্যি !ফের পুলু ! কতদিন বলেছি যখন তখন এইসব মা কালীর দিব্যিটিব্যি বলবি না !সরি৷ কী করবাে বল , মুখে এসে যায় । তবে আর বেশীদিন বলতে আসবনা রেজাল্ট বেরােবার আগের দিনটা পর্যন্ত ।উজ্জ্বল রেগে মেগে বলল , তাে অতদিন অপেক্ষা করারই বা কী আছে ? আর কষ্ট করে পরীক্ষা দেবারই বা কী আছে ? এখনই রেল লাইনে গলা দিগে যা । নয়তাে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলেই পড়গে যা ।বাঃ ! এখনি কেন ?পুলু হিহি করে হেসে উঠে বলল , যতক্ষণ না গালে মুখে চুন কালি পড়বে ততদিন মনের আনন্দে চরে বেড়াব না ? পরীক্ষার পড়া পড়ছি বলে মা রােজ রােজ মাছের মুড়াে খাওয়াচ্ছে পিসি দুধ ঘি নিয়ে সাধছে । আর বাবা মাঝরাতে আমার ঘরে আলাে জুলতে দেখে দয়া দয়া গলায় বলছেন , “ আর রাত জাগিসনি বাবা । এবার শুয়ে পড় ।’ গল্পের বইগুলাে আমি অলওয়েজ পড়ার বইয়ের মধ্যে রেখে পড়ি । তা এইসব আদর টাদরগুলাে ছাড়ব কেন ? তাছাড়া পরীক্ষার পরের দুটো মাস ? কী সুখের সেই দিন ভাব ? তখন আর পড়ার বইয়ের খাজে ঢুকিয়ে গল্পের বই পড়তে হবে না । সকলের নাকের সামনে দেখিয়ে দেখিয়ে পড়া যাবে । দুপুর বেলা ছিপ হাতে নিয়ে পুকুর ধারে বসতে পারা যাবে । আবার শুনেছি আমার পরীক্ষাটা হয়ে গেলেই সবাই মিলে না কি হাজারিবাগে ছােটপিসির কাছে বেড়াতে যাওয়া হতে পারে । তাহলে ? এইগুলাে বরবাদ করব কেন ? তাছাড়া আমি তাে আর তাদের মতাে কষ্ট করে সত্যি পরীক্ষা দেব না । আমি মনের আনন্দে পরীক্ষার খাতায় যা – খুশি লিখে আসবাে ।উজ্জ্বল আবারও বলে উঠল , ভাগ ভাগ ! খুব কায়দা দেখানাে হয়েছে । তুই জানিস আমাদের থেকে ভালই লিখবি । আর তখন দাঁত বার করে হেসে বলবি , কেমন ধাপ্পাটি দিয়েছিলাম ।পুলু এখন গম্ভীর হয়ে গেল ।বলল , কী করে বিশ্বাস করাব বল ? তুই তাে আবার মা কালীর দিব্যি দিতে বারণ করেছিস । যদি তিন সত্যি – তে আপত্তি না থাকে তাে বলি সত্যি সত্যি সত্যি ।উজ্জলের মুখটা এখন শুকিয়ে গেল । বলল , তুই সারা বছর পড়ার বইয়ের পাতাও ওল্টাসনি , শুধু আজে বাজে করে কাটিয়েছিস এ কথা তাে কই আগে কোনােদিন বলিসনি ! আমি তাের এতাে বন্ধু – সেইজন্যেই তাে –পুলু মিটিমিটি হেসে বলল , বললেই তাে তুই কষে জ্ঞান দিতে আসতিস ! পড় পড় করে উৎপাত করতিস ! হয়তাে বা বন্ধু বাৎসল্যে একসঙ্গে পড়ি আয় , বলে আমার বাড়িতে এসে হানা দিয়ে আমার সুখের বারােটা বাজিয়ে দিতিস ।উজ্জ্বল ম্রিয়মান গলায় বলল , সারাবছর পড়ব না ফাকি মেরে কাটাব , আর ফেল করলেই সুইসাইড করবাে , এটা খুব সুখ ?পুলু বলল , আহা আগে কী আর এতােটা দূর পর্যন্ত ভেবেছি ?পড়তে ভাল লাগে না পড়ি না । কেউ ‘ পড় পড় ’ করে ডিসটার্ব করবে , এটা পছন্দ করি না । তাই নিজের ব্যাপার যতটা সম্ভব কাউকে জানাই না । তবে এখন ভেবে দেখছি তােরা সবাই কলেজে ভর্তি হতে শহরে চলে যাবি , আর আমি জুনিয়ারদের সঙ্গে এক বেঞ্চে বসে নাঃ ! অসম্ভব । এটা বরং বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চার হবে । পাড়ায় সাড়া পড়ে যাবে –উজ্জ্বল খুব অসহিষ্ণুভাবে বলে , আহা ! কী মহিমাই হবে ! মাসীমা মেলােমশাইয়ের কথা ভেবে দেখেছিস ?অতাে ভাবতে গেলে চলে না । ওঁদের আরাে দুটো ছেলে আর গােটা চারেক মেয়ে আছে ।বাঃ ! খুব চমৎকার বুদ্ধি । পুলু , আমি তােকে বিশেষ ভাবে রিকোয়েস্ট করছি — তুই ওসব পাগলামি চিন্তা ছেড়ে দে । এখনাে উঠেপড়ে লেগে তৈরি হ । আমার সব নােটগুলাে তােকে দিয়ে দেব । তাের যা ব্রেন , ও একবার চোখ বুলােলেও মারকাটারি রেজাল্ট দেখিয়ে দিবি ।দ্যাখ উজ্জ্বল আমায় বেশি রাগাসনি । আমি যা ভেবে রেখেছি , তা করবই । হাতে তাে মাত্র আর ছদিন সময় । এখন পড়াশুনা করে পাশ করব ? হুঁঃ। বাের্ডের ঠাকুর্দারও সাধ্যি নেই আমায় পাশ করায় ।এটা খুব বাহাদুরি ?বাহাদুরি – টাহাদুরি বুঝি না , যা ফ্যাক্ট তাই বলছি ।উজ্জ্বলের নিজের এখন সময়ের যথেষ্ট দাম । সত্যিই তাে আর ছটা দিন মাত্র বাকি । তবু বন্ধুর এই দুর্মতি তাকে যেন হতভম্ব করে বসিয়ে রাখল এবং অনেক বােঝাতে চেষ্টা করল । বলল , তুই এই পাঁচদিনই বইপত্র খুলে দ্যাখ না । পরীক্ষায় বসবই এই চিন্তাটা কর না ।কিন্তু পুলু সে সব হেসেই উড়িয়ে দিল এবং বলল , নেহাৎ তুই আমার বুজুম ফ্রেণ্ড তাই তাের এত কথা শুনে যাচ্ছি , আর কেউ হলে কখন ভাগিয়ে দিতাম ।উজ্জ্বল খুব দুঃখের গলায় বলল , কিন্তু একটা কথার জবাব দে তাে , বরাবর ক্লাশে ভালাে রেজাল্ট করে প্রােমােশন পেয়ে এসছিস হঠাৎ এ বছরে পরীক্ষার বছর জেনেও এরকম বিদঘুটেপনা করলি কেন ?পুলু অর্থাৎ পুলকেশ একটু পুলকের এক অলৌকিক হাসি মুখে মেখে বলল , ওই তাে মজা ! হঠাৎ মনে হলাে , সবাই যা করে আমাকেও তাই করতে হবে , তার মানে কী ? পড়তেই হবে , পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করতেই হবে , যথানিয়মে কলেজে গিয়ে ঢুকতেই হবে , এর কোনাে মানে আছে ? আমি কি একটা ক্রীতদাস ? আমার নিজের কোনাে স্বাধীনতা থাকবে না ? আমার যদি পড়ার বইগুলাে হঠাৎ দু চক্ষের বিষ লাগতে শুরু করে , যদি গল্পের বইগুলাে বেশি টানে , কেন আমি জোর করে আহ্লাদের জিনিসটা ছেড়ে বিরক্তিকর জিনিসটারই দাসত্ব করব ? অদ্ভুত ! তার কথা শুনে মনে হচ্ছে মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে । সত্যি বলছি পুলু , আমার মনে হচ্ছে তাের মাথার ট্রিটমেন্ট করা দরকার ।পুলু হাে হাে করে হেসে উঠল ।আমার মাথা তােদের চেয়ে অনেক ভাল ।আচ্ছা , তাহলে তুই রােজ স্কুলে আসতিন কেন ?সে তাে বাড়ির লােককে ভাঁওতা দেবার জন্যে । তাছাড়া না এলেই তাে বাড়িতে বকাবকি শুরু করে দেবে ।উজ্জ্বল শেষ চেষ্টা করে বলে , তা রােজ যখন ক্লাসে এসে বসেছিস , কিছুও তাে জানা হয়ে গেছে বাবা ! সেইগুলােই ভেবে ভেবে . . . .অত সস্তা নয় মানিক । ক্লাশে আমি বসে খাতায় স্যারেদের কার্টুন এঁকেছি , ওঁদের ভঙ্গি নকল করে মুখ ভেঙিয়েছি আর ডিটেকটিভ গল্পের বই পড়েছি ।উজ্জ্বল হতাশ হয়ে নিঃশ্বাস ফেলে ভাবে তার মানে সত্যিই মাথায় কিছু গােলমাল হয়েছে ।আরাে দুঃখের গলায় বলে , কিন্তু তুই তাে এমন ছিলি না পুলু ।ছিলাম না , হয়েছি । মানুষ কি চিরদিন একরকম থাকে ?চিরদিন একরকম থাকে বনমানুষরা ।বলে আবার ফ্যাক ফ্যাক করে হাসে পুলু ।কার কোথায় সিট পড়বে জানা নেই । উজ্জ্বল বলল , তাে রেজাল্ট বেরােনাের আগের দিন পর্যন্ত তাে তুই কিছু করছিস না ?নো ! নাে ! সেদিন পর্যন্ত আরামসে আমােদ করে বেড়াবাে ।আচ্ছা ঠিক আছে । তবে একটা কথা বলে রাখি , মরাফরার দিকে না গিয়ে নিরুদ্দেশ হলেও তাে পারিস ?নিরুদ্দেশ !হা ! দোহাত্তা তাে সবাই নিরুদ্দেশ হচ্ছে বাবা । মেয়ে ছেলে , ছােট বড় সব্বাই ।তা তাতে আর কী লাভ ? নিরুদ্দেশ হওয়া মানেই তাে আর কারাে সঙ্গে দেখাটেখা হবে না । কোথায় আছি কেউ জানতেও পারবে না । মরে গেলেও তাই ।আহা ! তবু তাে মনে হবে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও আছিস । বেঁচে আছিস । হয়তাে খুব ভালই আছিস ?শুধু তাে মনে হওয়া । ওর কোনাে মানে নেই । আচ্ছা । টা – টা ।ওরা কথা বলছিল একটা আমবাগানের মধ্যে একটা বিশাল গাছের গুঁড়ির ওপর রুমাল বিছিয়ে বসে । জায়গাটা ওদের ছেলেবেলার খেলার জায়গা ।ঝড়ের সময় কাঁচা আম কুড়ােতেও এখানেই ছুটে আসত ছােট ছেলের দল । পুলু , উজ্জ্বল , রবি , শােভন , জ্যোছন , নীলু , অনিমেষ ।এক পাড়ারই তো সব । তবে উজ্জ্বলের সঙ্গে পুলুর বরাবরই একটু বেশি ভাব । কিন্তু আজ উজ্জ্বল বড় আহত হয়েছে । সেই পুলু যাকে ও মনে করতাে তার সঙ্গে বুঝি হরিহর একাত্মা , সে তার সঙ্গে এ রকম করছে । এতদিনের মধ্যে একদিনের জন্যেও বলেনি , সে পড়ে না । সে ক্লাসে বসে স্যারদের কার্টুন আঁকে ।আর মনে মনে এই ভয়ঙ্কর সংকল্প এঁকে বসে আছে । মাথাটাতেই কি সত্যি কোনাে গোলমাল হয়েছে ।তবু উজ্জ্বলের এও মনে হচ্ছে সবই হয়তাে পুলুর গুল মারা । ঠিকঠাকই করবে সব । আর ভালাে রেজাল্টও করবে ।কবে থেকে ওদের পরামর্শ করা যে দুজনে একই কলেজে পড়বে , একই সাবজেক্টে অনার্স নেবে । দুজনেরই মা বাবার সিদ্ধান্ত ছেলেকে কলকাতার কলেজে পড়াবার ।পুলু কি সব গুবলেট করে দেবে ?দেখতে দেখতে পাঁচ ছটা দিন কেটেই গেল।একই জায়গায় সিট পড়েছে উজ্জ্বলের আর পুলুর । উজ্জ্বল ভাবল এটা ভগবানের দয়া ।তা পুলুকে ঠিক সময়ে আসতে দেখা যাচ্ছে রােজ । কপালে দইয়ের ফোঁটা লাগিয়ে । হল থেকে বেরিয়ে এসে উজ্জ্বল বলে , এই বল না কী লিখলি ?কী লিখলাম ? তার কী কিছু ঠিক আছে ? এই শেষের দিকে লিখে এলাম , স্কুলে এত বেড়াল ঘােরে কেন ? ইঁদুরের লােভে ? না স্যারেরা লুকিয়ে মাছভাজা এনে খান তার গন্ধে গন্ধে ।অ্যাঁ । এই কথা লিখলি তুই ?লিখলামই তাে ! আহা উজ্জ্বল রে । বে-পরােয়া হবার সুখটা যে কী তা যদি বুঝতিস ! ভেবে দ্যাখ , এখন আর আমার কোনাে কিছুতেই ভয় নেই । যা ইচ্ছে করতে পারি , যাকে যা খুশি বলতে পারি , মাঝ রাত্তিরে শ্মশানেও চলে যেতে পারি ।চমৎকার !উজ্জ্বল ভাবল , আমার কী একবার পুলুদের বাড়িতে গিয়ে বলা উচিত , ‘ মাসিমা , পুলুর মাথাটার একটু চিকিৎসার দরকার । ওকে একটা ডাক্তার দেখান ।’কিন্তু ওঁরা যদি রেগে ওঠেন ।যদি বলেন , তুমি কে হে বাছা এই পরামর্শ দিতে আসার ? আমাদের ছেলেকে ডাক্তার দেখাবার দরকার আছে কী নেই , সেটা আমরা বুঝবো ।তাছাড়া অন্য অসুখ না, ‘মাথায় গােলমাল ।’ সন্দেহ । এতে রেগে ওঠাই স্বাভাবিক । এরপর দিনের চেহারা বদলে গেল ।পরীক্ষার পরই উজ্জ্বল চলে এল কলকাতায় তার মামার বাড়িতে । একা নয় , মায়ের সঙ্গে । কারণ শুধু ছুটি পেল বলে নয় , এই সময় বড় মামার ছেলের পৈতে আর কদিন পরে মেজমাসির মেয়ের বিয়ে ।মেচেদার বাড়িতে ঠাকুমা আছেন , জ্যেঠিমা আছেন , মায়ের যাওয়া এবং অনেকদিন থাকার অসুবিধে কিছু নেই ।যাবার আগের দিন সন্ধেবেলায় পুলুর সঙ্গে দেখা করতে গেল । পুলু বাড়ি নেই ।কোথায় নাকি যাত্রা শুনতে গেছে ।পুলুর মা বললেন , আর বােলাে না , বাবা , পরীক্ষা মিটে যাওয়ায় ছেলে যেন সাপের পাঁচ পা দেখেছে । সারাক্ষণ বাইরে টো টো । এই তাে গেছে , এখন কখন যে ফিরবে তার ঠিক নেই । কিছু বললেই বলে , আর কদিনই বা এমন আমােদ করে বেড়াব ? আচ্ছা , কলেজে ভর্তি হবার পর কী আর ছুটিছাটা হবে না ?‘ আর কদিনই বা ।’উজ্জ্বলের বুকটা কেঁপে উঠল । তবু সামলে নিয়ে আস্তে বলল , কী রকম পরীক্ষা দিল , তা বলেছে কিছু ?পুলুর পিসি এগিয়ে এসে বললেন , আমায় তাে বলেছে অন্ততঃ দু – তিনটে স্টার পাবে । স্টার পাওয়াটা কী বল তাে বাবা ?উজ্জ্বলের মনটা আবার আহ্লাদে ভরে উঠল , তাহলে আমাদের কাছেই চালাকি মেরেছে । আসলে ঠিকই আছে ।বলল , মানে আর কী , কোনাে কোনাে বিষয়ে বিশেষ ভাল ফল হওয়া তারই চিহ্ন । তাে আপনাদের যে হাজারিবাগ না কোথায় যাওয়ার কথা ছিল ?হ্যাঁ ! আমার ছােটবােনের বাড়ি । কতবার বলে , যাওয়া হয় না । পুলুর বাবা অফিসে ছুটির দরখাস্ত করেছে , অর্ডার এলেই চলে যাওয়া হবে ।উজ্জ্বল একটু ইতস্ততঃ করে বলে , কবে ফিরবেন ?পিসি হেসে ওঠেন , আগে তাে যাওয়াই হােক । ওই পুলুর এগজামিনের খবর বেরােবার আগেই বােধহয় চলে আসা হবে । উনি তাে জানেন না পুলুর বন্ধুর ওই ফেরার দিনের খবরটার এত দরকার কেন ? পুলুর মা বলেন , তুমি কোথাও যাবে না ? এই একটা সময়ই তাে ছেলেপুলের নিশ্চিন্তির সময় । অন্য সব ছুটির সময়ই তাে মাথার ওপর খাঁড়া ঝােলানােই থাকে । তাই ছেলেটা যা খুশি হয়েছে , কিছু বলছি না । হেসে উঠলেন ।বললেন , এরপর বুঝবে ঠ্যালা !উজ্জ্বল পুলুর মা ও পিসির এই হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে চলে এল ।এই হাসি মুখগুলাে কি চিরতরে অন্ধকার করে দেবে পলু ? শুধু শুধু এত নিষ্ঠুর হবে ? যদি ফেলই করে ? কদিন আর সে ধিক্কারের জের থাকবে ? উঠে পড়ে লেগে পড়লে , সামনের বছর সত্যিই স্টার পেয়ে পাশ করে বেরােতে পারে । একটা বছর নষ্ট গেল , তা অসুখ – টসুখ করলেও তাে যেতো !কিন্তু কখন দেবে এই সুবুদ্ধি ?পুলুর সঙ্গে তাে দেখাই হলাে না ।তারপর ?না । তারপর আর কোনােদিনই দেখা হলাে না । হয়নি । কলকাতা থেকেই শুনে এসেছিল উজ্জ্বল , হাজারিবাগে পিসির বাড়ি গিয়ে খুব আমােদ আহ্লাদ হৈ – চৈ তে কাটিয়ে ঠিক ফেরার দিনই ‘ পুলু ‘ নামের ছেলেটা নিরুদ্দেশ হয়ে গেছিল । কীভাবে কখন ? তা কেউ জানে না ।নিরুদ্দেশ ! তাও ভাল ।উজ্জ্বল মনে মনে বন্ধুর প্রতি একটু কৃতজ্ঞতা বােধ করেছিল । তাহলে তার কথা রেখেছে পুলু । অন্ততঃ আত্মহত্যা করেনি ।কিন্তু এসবকী আজকের কথা । সেই প্রবেশিকা পরীক্ষা দেওয়া উজ্জ্বল আজ একজন প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনীয়ার । চাকরি নিয়ে চলে এসেছে আসামে । এতদিন পরে অলৌকিক অথবা অবিশ্বাস্য , হঠাৎ দেখা হয়ে গেল পুলুর সঙ্গে । ‘ সাইটে কাজ সেরে সন্ধের মুখে বাসায় ফিরে দেখে ঝিকিমিকি বেলায় ওর কোয়াটারের গেট – এর কাছে কে একজন দাঁড়িয়ে ।কে ? কে ? কে ? অ্যাঁ ! পুলু !পুলু ! পুলু ! তুই আছিস তাহলে ? আমার কথা রেখেছিলি তাহলে ? আয় আয় ভেতরে আয় ! ওঃ ! ধারণা করতে পারিনি আবার দেখা হবে । বিশ্বাস করতেই পারছি না । কিন্তু কী আশ্চর্য ! তুই যে মােটেই বদলাসনি দেখছি । একদম একরকমই আছিস ! এখনাে ‘স্কুলের ছেলে’ বলে চালিয়ে দেওয়া যায় ! আর আমার এই দ্যাখ । মাথার সামনের চুলে পাক ধরে এল বলে । প্রায় টানতে টানতেই তাকে ধরে নিয়ে এল ঘরের মধ্যে ।উজ্জ্বলের এত উচ্ছ্বাসের পরিবর্তে পুলু কিন্তু আদৌ কথা কইল না । শুধু মুচকি হাসি মাখা মুখে তাকিয়ে রইল । সেই তার পেটেন্ট হাসি । দুষ্টুমি আর চালাকিভরা হাসিটি ।তার মানে কোনােদিক থেকেই বদলায়নি পুলু । জীবনে যে আর কখনাে দেখা হবে , এ আশা ছিল না । সত্যি বলতে – ‘ পুলু ’ নামের সেই হঠাৎ বেপরােয়া হয়ে ওঠা ছেলেটিকে আর তেমন ননেও ছিল না উজ্জ্বলের । হয়তাে কদাচিৎ কখনাে মনে হতাে , কী জানি কোথায় আছে । ‘আছে’ কী নেই তাই বা কে জানে । থাকলে কী আর একবারও কোনাে খবর পেতাম না ?কিন্তু নিজেরও অবশ্য জীবনের ধারা অনেকদূরে প্রবাহিত হয়ে গেছে । বাবা মারা গেছেন । ঠাকুমা তাে আগেই । মা কলকাতায় বড়মামার কাছে থাকেন । ছােট ভাই প্রােজ্জ্বল কলকাতাতেই পড়াশােনা করছে । বােনের বিয়ে হয়ে গেছে । কাজেই মেচেদার সঙ্গে এখন আর কোনাে সম্বন্ধ নেই । যাওয়া আসাও নেই ।কিন্তু পুলু উজ্জ্বলের খবর – টবর জানবার জন্য কোনাে উৎসাহ দেখাল না আর উৎসাহ করবেই বা কোন্‌ ফাঁকে ? উজ্জ্বলের উৎসাহের তােড়েই তাে ভেসে যাবার যােগাড় ।হঠাৎ হারানিধিটি পেয়ে উজ্জ্বল যে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না । বুকে রাখবে ? না , কোথায় ! না কি জড়িয়ে ধরে –পুলু এখন একটু ফিকে হাসি হেসে বলল , তা না হলে তুই চিনবি কী করে ?আমি চিনব বলে তুই-হা হা হা । স্বভাবেও একরকম আছিস । কেবল গুল মারা কথা । আমার তাে আর মেচেদায় যাওয়া – টাওয়া হয় না । তুই আর বাড়িটাড়ি যাসনি ?বাডি ?পুলু খ্যানখ্যানে গলায় হেসে ওঠে , গেলে ঝেঁটিয়ে বিষ ঝেড়ে দুরদুর করে তাড়িয়ে দেবে না ?উজ্জ্বল গম্ভীর হয় ।“ ছিঃ পুলু এরকম বলিস না । গুরুজনদের প্রতি অবিচার করা হয় । ছেলে একবার ফেল করলেই কী লােকে তাকে – না না । ছিঃ ! তা যাক , বাড়ি তাে ফিরিসনি বুঝছি । তাে বিয়ে – টিয়ে করেছিস ?ভাগ ! বােকার মতাে কথা বলিস না ।আহা , তা জীবনটা কাটালি কী ভাবে জানতে ইচ্ছে করবে না ?জীবন ! পুলু আবার হেসে উঠে বলে , তাহলে তাের কথাতেই বলি , মাথা নেই তার আবার মাথা ব্যথা ! ‘জীবন’ মানুষ একটাই পায় উজ্জ্বল । আর সেটাকে হেলাফেলা করে বরবাদ করে দিলে এই আমার মতাে অবস্থা হয় ।হঠাৎ কেমন বিষন্ন হয়ে যায় পুলু । বলে , ‘জীবন ’ জিনিসটা যে কী তা যদি তখন বুঝতাম । সামান্য একটু খেয়ালের বসে শুধু আমিই বা কেন , আমার মতাে এমন কতজনই তাে এই ভুল করে মরছে । দেখছি তাে সর্বদা । সামান্য একটা পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হলাে — মা বাপ কোনাে কারণে একটু বকলাে . . . তাে অমনি জীবনটাকে খতম করে বসল ।দেখছি সর্বদা , ও তুই তাহলে এই দেশেই ছিলি ? আঁ ? আমি ভেবেছিলাম হয়তাে আফ্রিকায় কী আরবে ভেগে গেছিস ।পুলু হঠাৎ তীক্ষ্ণ গলায় বলল , আমার কথা ভাবতিস ?ভাবতাম না ? বাঃ ! কতদিন ভেবেছি । তারপর ক্রমশঃ , সত্যি বলব কাজের চাপে – তবু খবরের কাগজ টাগজ দেখি ।হুঁ । যা হয় । তাছাড়া কবে কোথায় একটা ছেলে বাসে করে হাজারিবাগ থেকে রাঁচি যাবার পথে চলন্ত বাস থেকে লাফিয়ে নেমে পালিয়ে যেতে গিয়ে গড়িয়ে খাদে পড়ে গেছল , সে খবর আর কোন খবরের কাগজে ছাপতে গেছে বল ? তবে বিশ্বাস কর গড়িয়েই পড়ে গেছল ।পুলু ! উজ্জ্বল চেঁচিয়ে ওঠে । চলন্ত বাস থেকে লাফিয়ে খাদে পড়েছিলি তুই ? তারপর ?রুদ্ধশ্বাসে পুলুর কাঁধটা প্রায় খামচাতে যায় উজ্জ্বল । পুলু সােজা হয়ে উঠে দাঁড়ায় ! উজ্জ্বল বলে , তারপর ?তারপর ? তারপরের কথা এমন চট করে বলা যায় না উজ্জ্বল ।উজ্জ্বল ফের বসে পড়ে বলে , আচ্ছা ঠিক আছে । ধীরে – সুস্থে শুনব । এখন তাে থাকবি কিছুদিন ? সহজে ছাড়ছি না তােকে । সামনেই একটা বড় ছুটি আছে । এদের এখানে সব থেকে বড় পরব ‘ বিহু পরব’ । তাে সে সময় দুজনে খুব বেড়িয়ে নেওয়া যাবে । কী সাংঘাতিক । খাদে পড়ে গেছলি ? চলন্ত বাস থেকে না নামলে নিরুদ্দেশ হওয়া যেত না ! সত্যি তুই সেকী — প্রফুল্ল এসে দাঁড়াল ।দাদাবাবু , চা রেডি ।আচ্ছা বাবা আচ্ছা । যাচ্ছি । পুলু , আমি চট করে একটু ফ্রেস হয়ে আসি । তুই ততক্ষণ বন এই ম্যাগাজিনটা —ওসব ম্যাগাজিন – ফ্যাগাজিন রাখ । এতদিন পরে আমার যে জন্যে তাের কাছে আসা । সেটা সেরে নিই । পরে হয় তাে আর হবে না ।কাজ ! কী কাজ ?উজ্জ্বল !পুলু স্থির ভাবে তাকিয়ে বলে , তাের মনে আছে তাের যখন পৈতে হয় । তখন তাের বড়মামা তােকে একটা বেশ দামী রিস্টওয়াচ দিয়েছিল ?উজ্জ্বল অবাক হয়ে বলে , হ্যাঁ দিয়েছিলেন বটে । তাে নেমন্তন্ন বাড়ির গােলমালে সেটা হারিয়ে গিয়েছিল । তুই তার কথা কী করে জানলি ? আর — এখনই বা –উজ্জ্বল , একটা হাতঘড়ি নিজে হেঁটে হেঁটে কোথাও চলে গিয়ে হারিয়ে যেতে পারে না। ঘড়িটা চুরি গিয়েছিল । আর সেটা চুরি করেছিলাম আমিই ।যাঃ ভাগ ! কী যা তা বলছিস ?যা তা নয় । সত্যি ।পুলু যেন যন্ত্রের মতাে বলে চলে , ঘড়িটা ভীষন সুন্দর দেখতে ছিল । আমার দেখে হঠাৎ খুব লােভ হলাে , তুলে নিলাম । নিয়ে ফেলেই ভাবলাম ছি ছি । এ কী ! কিন্তু তারপর মুস্কিল হলাে ঘড়িটি ফিরিয়ে দেবার ইচ্ছে হলেও লজ্জায় ফিরিয়ে দিতে পারলাম না ।ভেবেছিলাম চুপি চুপি একদিন তাের পকেটে চালান করে দেবার ইচ্ছে ছিল । কিন্তু সুবিধে হলাে না । তারপর তাে কত কী ! কিন্তু সেই চুরির বােঝা বয়ে বেড়াতে বেড়াতে –চুপ করে গেল ।পকেট থেকে সেই বহুদিন – বিস্মৃত হাতঘড়িটি বার করে টেবিলের ওপর রাখল পুলু ।একদম নতুনই রয়েছে । ঝকমক করে উঠল ।কী আশ্চর্য !হাঁ হয়ে ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে উজ্জ্বল ।তারপর আবেগের সঙ্গে বলল , এতদিন এত কাণ্ডর মধ্যেও তুই এই তুচ্ছ ঘড়িটা –খাদে গড়িয়ে পড়ার পর কী করে উঠে এলি ? আবার কি বাড়ি গেলি ? না কী ঘড়িটা তাের সঙ্গেই ছিল ? আমি তাে কিছুই বুঝতে পারছি নারে বাবা । মাথাফাতা গুলিয়ে যাচ্ছে । পৈতে হয়েছিল আমার সেই তেরাে বছর বয়সে । আর এখন এই ঊনতিরিশ । সেই ঘড়িটা , আঁ ! সত্যি সেইটাই ? না কী তুই — এখন — কিনেটিনে — এ কী ! একী ! গুলু ! পুলু ! পু – লু – উ ! প্রফুল্লো – ও – ও ! ও !চোখের সামনে আস্ত একটা মানুষকে আচমকা উবে যেতে দেখলে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে না মানুষ ?প্রফুল্ল ছুটে এসে দাদাবাবুর চোখে – মুখে জল দিতে দিতে বলে , যখুনি দেখেচি আপিস থেকে এসে বসে ঝিমােচ্ছেন তখনি বুজেচি শরীর খারাপ । হবে না ? সারাটা দিন মাঠে জঙ্গলে –উজ্জ্বল আস্তে বলে , অফিস থেকে এসে আমি ঝিমােচ্ছিলাম ? আজ্ঞে ওই আর কী ! সােফায় গেদিয়ে বসে , ঘুম ঘুম ভাব !আমার সঙ্গে কেউ আসেনি ?আপনার সঙ্গে ? আসবে আবার কেডা ? গাড়ির ড্রাইভার তাে আপনাকে ছেড়ে দিয়েই চম্পট ।আমি তােকে চা তৈরী করতে , ভাল ভাল রান্না করতে বলিনি ?বলবেন আবার কখুন ? তাে চা আমি বানিয়েছি ।তুই আমার হাতমুখ ধােবার জন্যে তাগাদা দিতে আসিসনি ?আজ্ঞে এয়েছিলুম একবার । তাে দেখলুম খুব ক্লান্ত তাই আর ডাকিনি । ফিরে গেলুম ।প্রফুল্ল !! সে সময় ঘরে কাউকে দেখিসনি ? কাকে আবার দেখব দাদাবাবু ! দেয়ালে একটা টিকটিকিও তাে নাই ।ঠিক বলছিস ?বেঠিক বলতে যাব কেন দাদাবাবু শুধু শুধু ? তাে আপনার বােধ করি একটু নিদ্রা এয়েছিল ? স্বপ্নটপ্ন দেখে থাকবেন । তাই হবে । আচ্ছা তুই যা । চা আন । আমি হাতমুখ ধুয়ে আসছি । প্রফুল্ল চর্লে যায় । তার উজ্জ্বল স্থির চোখ টেবিলের ওপর পড়ে থাকা সেই হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকে ।স্বপ্ন ! মায়া ! ঘুমের ঝিমুনি ?তাহলে – এটা কী ?বড়মামার দেওয়া সেই ঘড়িটাই !যেটা হারিয়ে যাওয়ায় ভীষণ মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল উজ্জ্বলের । কিন্তু এখন ?এতদিন পরে ফিরে পেয়ে ?মনটা কি খুব ভাল হয়ে গেল ? কই ?যন্ত্রণায় মুচড়ে উঠছে যে ?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page