ভুতের গল্প : অচেনা

রাত আনুমানিক দুইটার মত হতে পারে।
হাতে ঘড়ি না থাকার কারনে সময়টা
নির্ধারন করতে পারছিনা। খুব দ্রুত
হাটতেছি মাটির রাস্তা দিয়ে। আমাকে
যত তারাতারি সম্ভব মামা বাড়ি
পৌছতে হবে। সামনেই কবরস্থান, এই
জায়গাটুকু যত তারাতারি সম্ভব পেরুতে
হবে। নোকিয়া এগারশো দশ মডেলের
মোবাইলের টর্চ ধরে এগিয়ে চলেছি একা
একা। আমার মত যুবকরা যে যার মত দৌড়ে
পালিয়েছে বাড়ি যার যার বাড়ি থেকে।
গত রাতে দুইজনকে জবাই করে মেরে ফেলা
হয়েছে। অজ্ঞাতনামা এক হাজার
মানুষের নামে সরকারবাদী মামলা
হয়েছে। নেতা মেরে ফেলার কারনেই এত
রেট এলার্ট জারী করা হয়েছে এলাকায়।
আব্বুকে রাতে কাজ থেকে বাসা আসতে
নিষেধ করে দিয়েছি।
.
খুব ভয় করছে একা একা, আমি আবার ভীতুর
ডিম। এত বড় হয়েও আলিফ লায়লা যেদিন
দেখব, সেদিন আর কেউ লাঠি দিয়ে
পিটিয়েও বাইরে বের করতে পারবেনা
আমাকে। আর সেই আমি একা একা এই
কবরস্থানের পাশ দিয়ে যাচ্ছি এত রাতে,
এক প্রকার কলিজাটা হাতের মুঠোয়
নিয়ে হাটতেছি। বুকের হার্টবিট ক্রমেই
বাড়তেছে। গতকালের গলাকাটা লাশদুটো
পোস্টমর্টেম এর পরে এই কবরস্থানেই কবর
দেয়া হয়েছে। এই কথাটা ভাবতেই
শরীরের পশম সব দাড়িয়ে গেছে। একটু পর
পর ঢেকুর গিলতেছি আর জোরে জোরে
লাফিয়ে জায়গাটুকু পাড় হওয়ার চেষ্টা
করতেছি। এক প্রকার চোখ বন্ধ করে হাটা,
এই মূহূর্তে কবরস্থানের দিকে তাকানো
আমার পক্ষে সম্ভবনা। মনে হচ্ছে
তাকালেই গলা কাটা লাশ দুটোকে
দেখতে পাব।
.
কবরস্থান পাড়ি দিয়ে আসার পর থেকেই
এই ধবধবে সাদা বিড়ালটা আমার পিছু
নিয়েছে। একটু পর পর মেউ মেউ শব্দে
ডাকে। মনে মনে একনাগারে দোয়া পড়ে
বুকে ফুঁ দিয়ে জোরে জোরে হাটতেছি,
বিড়ালটাও মনে হচ্ছে একই গতীতে এগিয়ে
চলেছে। নতুন এক ভয় যোগ হল, মোবাইলের
চার্জ দুই দাগ বাকি আছে, কখন জানি বন্ধ
হয়ে যায়।
একটু পর পিছন ফিরে আর বিড়ালটিকে
দেখতে পাইনি। এত অল্প সময়ে কোথায়
উধাও হয়ে গেল। আজ রাস্তাও মনে হয়
ফুরোতে চায়না। একটু পরেই আমার পিছনে
কারো হাটার শব্দ পেলাম, পিছন ফিরে
দেখি কেউ নেই। আবার সামনে তাকিয়ে
হাটলেই শব্দটা পাওয়া যায়। কেমন যেন
পা টেনে টেনে হাটা। আজ মনে হয় আমার
আর মামার বাড়ি যাওয়া হবেনা, পথেই
লাশ হয়ে পড়ে থাকতে হবে। সামনে
তাকিয়ে এমনটাই ভাবতেছি, ত্রিশ
চল্লিশ হাত দূরে সাদা কাপড়ে মুড়ানো
একটা জ্যান্ত লাশ হেটে যাচ্ছে, এই
অন্ধকারে সাদা কাপড়ের উজ্জলতা
অনেক। আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে
গেছে, মনে হচ্ছে পানি খেতে না পারলে
মরেই যাব। লাশটা কেমন কুঁজো হয়ে ধীরে
ধীরে হাটতেছে। আমার পিছনেও পা
টেনে টেনে হাটার শব্দটা শোনা যাচ্ছে।
রাস্তার এক পাশে ধানের জমি, আরেক
পাশে দুই জমির আইল দেখা যাচ্ছে, দূরে
হয়তো কোন বাড়ি ঘর থাকতেও পারে নাও
থাকতে পারে।
হঠাৎ লাশটি পিছন ফিরে তাকাল, তার
ভয়ংকর দর্শন দেখে ঐ জমির আইল দিয়ে
দিলাম দৌড়, যা আছে কপালে।
.
কল চেপে পানি খাচ্ছি, বড় বাঁচা বেঁচে
গেলাম। দৌড়াতে দৌড়াতে এখানে চলে
এসেছি। এখানে দুইটা ঘর দেখতে পেয়ে
মনে সাহস হল। আপাতত ঘর যেহেতু আছে
মানুষ থাকবেই। বিপদে পড়লে ডাকা
যাবে, পানি খেয়ে তৃপ্তি পাচ্ছিনা।
হঠাৎ, দরজা খোলার শব্দ পেয়ে লাফিয়ে
তাকালাম। এক বুড়ো মহিলা হারিকেন
নিয়ে বের হইছে,,,,,,
— কে এখানে?
— জ্বি, আমি আমি পাশের গ্রামের। পথ
ভুলে চলে এসেছি, ভোর হলেই চলে যাব।
— ও, ঐ পাশের ছোট ঘরটায় থাকতে পারো,
ভোর হলে চলে যেও।
— আচ্ছা ঠিক আছে।
অনেক বড় উপকার হল। মোবাইলে আর
একদাগ চার্জ আছে। ঘরে ঢুকেতো পুরোই
অবাক, কোন খাট বা চৌকি নেই।
অনেকগুলো শুকনোপাতা স্তুপ করে রাখা
আছে। ধপাস করে বসে পড়লাম। আমি আর
কিছু ভাবার চেষ্টাও করছিনা, কি সব ঘটে
গেল আমার চোখের সামনে। হঠাৎ বাইরে
গুণ গুণ করে গান শুনতে পেলাম। খুব সুন্দর
কন্ঠ, মায়াবী। কেমন যেন অচেনা এক
মায়া আছে সে কন্ঠের সুরে। লোভ
সামলাতে পারলামনা। আস্তে আস্তে
ঘরের ফুটো দিয়ে বাইরে তাকালাম।
খুব সুন্দর, পরীর মত সুন্দর একটা মেয়ে
জামগাছে হেলান দিয়ে গুণ গুণ করতেছে।
পুরোটা চেহারা দেখা যাচ্ছেনা,
জামগাছটা আড়াল করে রেখেছে। আমি
ফুটো জায়গাটা আরেকটু বড় করলাম
মেয়েটাকে ভালকরে দেখার জন্য। এত
সুন্দর মেয়ে আমি কখনো দেখিনি।
তাহলে কি এটি বুড়ির মেয়ে? হতে পারে।
.
মেয়েটি একটু পর পর পিছন ফিরে তাকায়
আর মুচকি মুচকি হাসে। তবে গুণ গুণ বন্ধ
হয়নি। তবে কি মেয়েটিও জানে আমি এই
ঘরের মধ্যে লুকিয়ে আছি? হতেও পারে,
বুড়ি হয়তো বলেছে। তবে মেয়েটি এত
রাতে বাইরে কেন। আমার কেন যেন
অচেনা এই মেয়েটির প্রতি মুগ্ধতা বেড়েই
চলেছে।
আমি ফুটো জায়গাটা আরেকটু বড় করতে
চাইলাম। মেয়েটি পিছন ফিরে তাকিয়ে
গাছটির আড়ালে চলে গেল। আর কোন গুন
গুন শব্দ শোনা যাচ্ছেনা। মেয়েটিকেও
দেখা যাচ্ছেনা অনেকক্ষন। তাই আবার
শুকনো পাতায় বসতে গেলাম। পাতার
নীচে কি যেন শক্ত শক্ত লাগল। মনে হচ্ছে
কোন কিছু লুকিয়ে রেখেছে।
হঠাৎ মনে হল শরীরটা কেঁপে ওঠল, পাতার
নীচে শক্ত কিছু একটানড়ে ওঠল। মনের ভুল
নয়তো? কিছুনা ভেবেআবার বসলাম,
এবারও নড়ে ওঠল। বুকের হার্টবিট এবার
প্রচুর লাফাচ্ছে। ভয়ে ভয়ে পাতাগুলো একটু
সরালাম।
নিভো নিভো টর্চে দেখার চেষ্টা
করলাম। যা দেখলাম তার জন্য মোটেও
প্রস্তুত ছিলামনা। মানুষের পা দেখে
জোরে চিৎকার করে উঠলাম, ওমাগো………
.
আম্মু আব্বু আমার পাশে বসা। আমি আধা
জগ পানি খেলাম। আমি ভয়ংকর এই স্বপ্ন
দেখে ওমাগো বলে চিৎকার দিয়েছি শুনে
আব্বু আম্মু আমার রুমে এসেছে। ভয়ংকর
একটি স্বপ্ন দেখলাম। খুবই ভয়ংকর।
সকাল দশটায় পাশের বাড়ির লুৎফর ভাই
আব্বুকে ডেকে বলতেছে,,,
” কাকা শুনেছেন, গতকাল রাতে নাকি
বাপ্পী আর রাব্বীকে কারা যেন গলা
কেটে জবাই করে মেরে ফেলেছে, শুনেছি
পুরো গ্রামবাসীর নামে মামলা হবে।”
বুকের ভিতরটা আবার ধপাস করে উঠল।
আজকে রাতেকি তাহলে সত্যি সত্যিই
সে পরীর মত অচেনা মেয়ের সাথে আবার
দেখা হবে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page