জ্ঞান ও তথ্য সম্পর্কে আলোচনা । পার্থক্য

প্রশ্ন : জ্ঞান ও তথ্য সম্পর্কে আলোচনা করুন । এদের মধ্যের পার্থক্য নিরূপণ করুন ।

উত্তর জ্ঞান হল সেই সমস্ত বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হল বিভিন্ন সত্য , তথ্য , বর্ণনা অথবা দক্ষতাসমূহ যা অভিজ্ঞতা বা শিক্ষা দ্বারা অর্জিত । এটি যে – কোনো বিষয়ের তাত্ত্বিক বা ব্যাবহারিক উপলব্ধির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত । আবার এটি কমবেশি আনুষ্ঠানিক ও নিয়মসিদ্ধ । দর্শনে জ্ঞানচর্চাকে বলা হয় জ্ঞানতত্ত্ব বা Epistemology । এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় বিখ্যাত দার্শনিক প্লেটো জ্ঞানকে বলেছেন ‘ justified true belief ” বা বিচারকৃত যথার্থ বিশ্বাস । যদিও জ্ঞান সম্পর্কে সেরকম কোনো ধারণা বা সংজ্ঞা এখনও পর্যন্ত নেই ।

জ্ঞান অর্জন কতকগুলি জটিল মানসিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত । এগুলি হল — ধারণা , সংযোগসাধন , সম্মেলন ও যুক্তিপ্রদর্শন । আবার জ্ঞান মানুষের গ্রহণ করার ক্ষমতার উপরেও নির্ভরশীল ।

Richard Rorty- র মতে , দর্শনের সঙ্গে বিজ্ঞানের পার্থক্য হল , দর্শনের কেন্দ্র হল ‘ জ্ঞানের তত্ত্ব ‘ ( Theory of Knowledge ) । জ্ঞানের তত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা না থাকলে আধুনিক বিজ্ঞানের জগতে কোন্ ধরনের দর্শন প্রয়োজন সে সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব নয় ।

উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে , জ্ঞানের সংজ্ঞা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক বর্তমান । প্রাচীন সংজ্ঞা অনুযায়ী বলা যায় কোনো বক্তব্য জ্ঞান হিসেবে স্বীকৃত হবে যদি তা তিনটি শর্ত পূরণ করে—

( ক ) এটি সত্য হবে ।

( খ ) এটি বিশ্বাসযোগ্য হবে এবং

( গ ) বিশ্বাসের সাপেক্ষে তথ্য ও যুক্তি থাকা চাই । জ্ঞানের উৎপত্তি সম্পর্কে চারটি মতবাদ আছে । যথা—বুদ্ধিবাদ বা প্রজ্ঞাবাদ , অভিজ্ঞতাবাদ প্রত্যক্ষবাদ বিচারবাদ এবং স্বজ্ঞ্যবাদ ।

( i ) প্রজ্ঞাবাদ : বুদ্ধিবাদ বা প্রজ্ঞাবাদ অনুসারে বুদ্ধি বা প্রজ্ঞাই হল যথার্থ জ্ঞান লাভ করার একমাত্র না হলেও প্রধান উৎস । প্রাচীনতম গ্রিক দার্শনিকগণ , যেমন– সক্রেটিস এবং প্লেটোর মতে জ্ঞানলাভের একমাত্র উপায় হল প্রজ্ঞা । সংবেদন কিংবা অনুভূতির মাধ্যমে প্রকৃত জ্ঞান লাভ করা যায় না । কারণ ব্যক্তিভেদে তা পৃথক হতে পারে । কখনোই তাকে নিশ্চিত জ্ঞান বলা যায় না । আধুনিক সময়ের পাশ্চাত্য দার্শনিক , যেমন — দেকার্তে ( Descartes ) , স্পিনোজা ( Spinoza ) , লাইবনিজ ( GW Leibniz ) , উলফ ( Wolff ) প্রমুখ বলেন , প্রজ্ঞার সাহায্যে যে জ্ঞান পাওয়া যায় তা নিশ্চিত এবং যথার্থ ।

( ii ) অভিজ্ঞতাবাদ : অভিজ্ঞতাবাদের মূল কথা হল অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের একমাত্র উৎস । অভিজ্ঞতাবাদের জনক হলেন জন লক ( John Locke ) । পরবর্তীকালে বার্কলে ( Berkeley ) এবং হিউম ( Hume ) অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক হিসেবে খ্যাত হন । অভিজ্ঞতাবাদীদের মতে বাস্তব বিষয়ের জ্ঞান ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা ছাড়া হতে পারে না । জাগতিক যে – কোনো বিষয়ের জ্ঞান ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা ছাড়া হতে পারে না এবং তা অর্জন করতে গেলে পর্যবেক্ষণ , পরীক্ষণ ও আরোহী পদ্ধতির অবলম্বন করতে হবে ।

( iii ) বিচারবাদ : বিচারবাদীদের মতে , বুদ্ধিবাদ এবং অভিজ্ঞতাবাদ উভয়ই চরমপন্থী এবং একদেশদর্শী মতবাদ । জ্ঞানের তত্ত্ব হিসেবে দুটি মতবাদের কোনোটিই সমর্থনযোগ্য নয় । জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট এই মতবাদের স্রষ্টা । তিনি বুদ্ধিবাদ এবং অভিজ্ঞতাবাদের মধ্যে সমন্বয়সাধন করে বিচারবাদের প্রতিষ্ঠা করেন । কান্টের মতে , মানব – মন বাইরে থেকে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সংবেদন গ্রহণ করে । এইসব সংবেদন পরস্পর স্বতন্ত্র ও বিচ্ছিন্ন । মন বা আত্মার সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার দ্বারা সংবেদন পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হলে তবেই তা অর্থবহ হয় এবং জ্ঞানের সৃষ্টি হয় ।

( iv ) স্বজ্ঞাবাদ : স্বজ্ঞাবাদী দার্শনিক বার্গসো ( H Bergson ) মনে করেন , অভিজ্ঞতা বা বুদ্ধি কোনোটিই যথার্থ জ্ঞানলাভের উপর নয় । এঁদের মতে , একমাত্র স্বজ্ঞার দ্বারাই জ্ঞান লাভ করা যায় । স্বজ্ঞাবাদীরা আরও বলেন যে , বিচার – বুদ্ধি মনের একমাত্র শক্তি নয় । বুদ্ধি ছাড়াও মনের একটি শক্তি আছে যা দিয়ে মন সরাসরি সত্যকে উপলব্ধি করতে পারে । এই শক্তির নাম স্বজ্ঞা । কোনো রকম বিচার – বুদ্ধির সাহায্য না নিয়েই একটি বস্তুকে মন দিয়ে সরাসরি উপলব্ধি করার ক্ষমতাই হল স্বজ্ঞা । স্বজ্ঞার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বার্নমো একে বৌদ্ধিক সমবেদনা ( Intellectual Sympathy ) বলেছেন । এই বৌদ্ধিক সমবেদনার সাহায্যে মানুষের মন কোনো বস্তুর অন্তরে প্রবেশ করে সেখানে যা কিছু অনন্য এবং অসাধারণত্ব আছে তার সঙ্গে একাত্মতা লাভ করে প্রকৃত জ্ঞান লাভ করে । ইংরেজি শব্দ Information- এর উৎপত্তি হয়েছে লাতিন শব্দ ‘ Informatio ‘ থেকে , যার উৎপত্তি আবার ‘ Informere ‘ নামক ক্রিয়া থেকে । যার অর্থ হল ‘ মনকে আকার প্রদান ’ , ‘ নির্দেশদান ’ বা ‘ শিক্ষণ দান ‘ । তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তথ্যকে কতকগুলি সংকেতের পর্যায়ক্রম বলা যায় , যা একটি অক্ষর নির্মাণ করে । তথ্য প্রক্রিয়াকরণের মধ্যে উপকরণ বা Input এবং উপপাদ বা Output কার্যপ্রক্রিয়া যুক্ত , যাকে অনেক সময় ‘ x ’ ও ‘ y ’ দ্বারা প্রকাশ করা হয় । এটি স্মৃতিযুক্ত বা স্মৃতিহীন হতে পারে । তথ্যকে কখনো কখনো পরিবেশ থেকে মানুষের জ্ঞানেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করা উপাদান হিসাবেও গণ্য করা হয়ে থাকে । আবার যে – কোনো ব্যবস্থার উপকরণ হিসাবেও ধরা হয় ।

তথ্যকে আমরা যে – কোনো ধরনের ধাঁচ বা Pattern বলতে পারি যা অন্যান্য বিষয়ের গঠন বা ধাঁচকে পরিবর্তন করতে পারে । এটি সমর্থন করে যে ধারণা গঠনে কোনো সচেতন মনের প্রয়োজন হয় না । উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে , DNA- এর মধ্যে ক্রোমোজোমের ধাঁচ বা Pattern একটি প্রাণীর বৈশিষ্ট্যগুলির জন্ম দেয় যার জন্য কোনো সচেতন মনের প্রয়োজন নেই । ব্যবস্থাজ্ঞাপক তথ্য ( Systems Theory ) বহু ক্ষেত্রে তথ্যের ব্যাখ্যাকে সমর্থন করেছে এবং উল্লেখ করেছে তথ্যের সঙ্গে কোনো সচেতন মন বা ধাঁচ বা Pattern যুক্ত নয় । অন্যভাবে বলা যায় , তথ্য কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের জন্য নির্মিত বা প্রস্তুতকৃত নয় । প্রজ্ঞামূলক চিন্তাবিদগণ মানুষের শিখনের সঙ্গে সম্পর্কিত যে সমস্ত প্রকল্পকে গুরুত্ব প্রদান করেছেন তথ্য প্রক্রিয়াকরণ বা Information Processing ‘ তার মধ্যে অন্যতম । এই শব্দটিকে ভাঙলে আমরা দুটি শব্দ পাই । প্রথমটি হল Information বা তথ্য , যার সম্পর্কে আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি । কম্পিউটারের ক্ষেত্রে এই তথ্য যেমন পূর্বনির্দিষ্টভাবে নিজেই পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করে , আমাদের অর্থাৎ মানুষের ক্ষেত্রে সংগৃহীত তথ্যগুলি উদ্দীপকের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তিত হয় । একে বলা হয় Processing বা প্রক্রিয়াকরণ ।

তথ্য প্রক্রিয়াকরণের মূল বক্তব্যগুলি হল—

1. তথ্যের একটি মানসিক প্রতিরূপ বর্তমান । তথ্য হল মূল বিষয়ের সাংকেতিক উপস্থাপন ।

2. তথ্য ব্যক্তিগত । এর প্রতিরূপ ইন্দ্রিয়ভিত্তিক বা ভাষাভিত্তিক হতে পারে ।

3. তথ্য দুই ধরনের হতে পারে — ঘটনাভিত্তিক তথ্য ও ভাষাভিত্তিক তথ্য ।

4. তথ্যের প্রক্রিয়াকরণ গভীর বা অগভীর হতে পারে । এর উপর নির্ভর করে স্মৃতি সাময়িক নাকি স্বল্পস্থায়ী নাকি দীর্ঘস্থায়ী হবে ।

তথ্য ও জ্ঞানের সম্পর্ক সংক্ষেপে উল্লেখ করা হল—

1. তথ্য হল প্রক্রিয়াজাত পরিসংখ্যান এবং জ্ঞান হল সেই তথ্য যাকে ব্যবহার করা যায় ।

2. জ্ঞান অর্জনের জন্য তথ্য প্রয়োজন ।

3. পরিসংখ্যান সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে তথ্য পর্যালোচনা করে আবার জ্ঞান একটি নির্দিষ্ট তথ্যের ধাঁচকে তুলে ধরে ।

4. জ্ঞান অর্জনের জন্য কিছু প্রজ্ঞামূলক ও বিশ্লেষণাত্মক ক্ষমতার প্রয়োজন , সেখানে তথ্যের জন্য কোনো প্রজ্ঞামূলক ক্ষমতার প্রয়োজন নেই ।

Related posts:

বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের জীবন কথা
পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী : 2024
চন্দ্রযান-3 : চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণকারী প্রথম দেশ ভারত
GENERAL STUDIES : TEST-2
GENERAL STUDIES : 1
কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স: 8ই সেপ্টেম্বর
'জ্ঞানচক্ষু' গল্পের নামকরণের সার্থকতা বিচার করো।
তপনের জীবনে তার ছোটো মাসির অবদান আলোচনা করো।
সমান্তরাল আলোকরশ্মিগুচ্ছ বলতে কী বোঝ ?
আলোকরশ্মিগুচ্ছ বলতে কী বোঝায় ? এটি কয়প্রকার ও কী কী ?
একটি সাদা কাগজকে কীভাবে তুমি অস্বচ্ছ অথবা ঈষৎ স্বচ্ছ মাধ্যমে পরিণত করবে ?
ঈষৎ স্বচ্ছ মাধ্যম কাকে বলে ? উদাহরণ দাও ।
অস্বচ্ছ মাধ্যম কাকে বলে ? উদাহরণ দাও ।
স্বচ্ছ মাধ্যম কাকে বলে ? উদাহরণ দাও ।
অপ্রভ বস্তুও কি আলোর উৎস হিসেবে কাজ করতে পারে?
বিন্দু আলোক - উৎস কীভাবে পাওয়া যেতে পারে ?
বিন্দু আলোক - উৎস ও বিস্তৃত আলোক - উৎস কী ?
অপ্রভ বস্তু কাকে বলে ? উদাহরণ দাও ।
স্বপ্নভ বস্তু কাকে বলে ? উদাহরণ দাও ।
দিনেরবেলা আমরা ঘরের ভিতর সবকিছু দেখতে পাই , কিন্তু রাত্রিবেলা আলোর অনুপস্থিতিতে কোনো জিনিসই দেখতে পা...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page