গণতান্ত্ৰিক শিক্ষাব্যকথা সম্পর্কে লিখুন ।
উত্তর:- স্বাধীনতা অর্জনের পর সংবিমানে ভারতবর্ষকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে । শিক্ষার ক্ষেত্রেও গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থাকে বাস্তবায়িত করার কথা বলা হয়েছে । গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যকথা বলতে বোঝায় শিক্ষার প্রতিটি ক্ষেত্র যেমন শিক্ষার লক্ষ্য , পাঠক্রম , শৃঙ্খলা , শিক্ষক , প্রশাসন এবং বিদ্যালয় সবক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক প্রথা মেনে চলা ।
গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য হল
( 1 ) গণতন্ত্র ব্যক্তির মর্যাদাকে স্বীকৃতি দেয় ।
( 2 ) সকলের অধিকারকে নিশ্চিত করে ।
( 3 ) গণতন্ত্র রাজনৈতিক এবং সামাজিক স্বাধীনতাকে মর্যাদা দেয় ।
( 4 ) গণতন্ত্রে ব্যক্তির অধিকার ও দায়িত্বকে স্বীকৃতি দেয় ।
( 5 ) গণতন্ত্র তিনটি মূল্যবোধের উপর গুরুত্ব দেয় । এই তিনটি মূল্যবোধ হল স্বাধীনতা , সমতা এবং ভ্রাতৃত্ববোধ । গণতন্ত্র এবং শিক্ষার লক্ষ্য : মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশনের ( 1953 ) মতে শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা । অন্য লক্ষ্যগুলি হল বৃত্তির ক্ষেত্রে উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করা , ব্যক্তিত্বের বিকাশ এবং নেতৃত্বদানের গুণাবলির বিকাশ । গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় বৌদ্ধিক বিকাশের লক্ষ্যগুলি হল ( 1 ) শিক্ষার লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীদের মধ্যে চিত্তাকরণের দক্ষতা বিকাশ । ( 2 ) শিক্ষার লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীদের উন্মুক্ত মনের বিকাশ ঘটানো । ( 3 ) শিক্ষার লক্ষ্য হল মৌখিক এবং লিখিতভাবে শিক্ষার্থীরা যাতে তাদের বক্তব্য প্রকাশে সক্ষম হয় তার ব্যবস্থা করা । ( 4 ) শিক্ষার লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীরা তাদের চিন্তা – ভাবনাগুলি মুক্ত অর্থাৎ খোলাখুলিভাবে আলোচনা এবং বিনিময় করার ক্ষমতা অর্জন করবে ।
গণতান্ত্রিক শিক্ষার নৈতিক লক্ষ্য হল ধৈর্য , শৃঙ্খলা এবং সহযোগিতার মনোভাব গড়ে তোলা এবং সর্বোপরি চারিত্রিক বিকাশ ঘটানো হিসেবে গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থার সামাজিক লক্ষ্য হল
( 1 ) সকলের সঙ্গে মিলেমিশে বেঁচে থাকা এবং সকলের সঙ্গে সদ্ভাব গড়ে তোলা ।
( 2 ) সামাজিক ন্যায়ের প্রতি আস্থা ।
( 3 ) দেশপ্রেমের বিকাশ ।
( 4 ) আন্তর্জাতিকতার মানসিকতার বিকাশ ।
পাঠক্রম : —
গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থার পাঠক্রম নিম্নোক্ত নীতির ভিত্তিতে রচিত হবে
( 1 ) শিক্ষার্থীদের চাহিদা এবং প্রত্যাশার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হবে ।
( 2 ) বৈচিত্র্যের নীতি অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের আগ্রহ এবং প্রবণতা অনুযায়ী পাঠক্রম গ্রহণের সুযোগ থাকবে ।
( 3 ) শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার নীতি অর্থাৎ শিক্ষা – শিখন প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের সক্রিয়তা এবং অংশগ্রহণের উপর সর্বাধিক সুযোগ সৃষ্টি করা হবে ।
( 4 ) বৃত্তি উৎকর্ষতার নীতি অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা যাতে সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় এবং উৎপাদনক্ষম ব্যক্তিতে পরিণত হয় সেদিকে লক্ষ রেখে পাঠক্রমে উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকবে ।
( 5 ) অন্তর্ভুক্তি শিক্ষার নীতি ।
শিক্ষা – শিখন পদ্ধতি : —
গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় যেসব শিক্ষণ পদ্ধতির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয় তা হল –
( 1 ) দলগত কাজ ,
( 2 ) প্রকল্প পদ্ধতি ,
( 3 ) ভূমিকাভিনয় , খেলা ইত্যাদি ,
4 ) সার্ভে পদ্ধতি ,
( 5 ) অনুসন্ধান পদ্ধতি এবং কৌশল ,
( 6 ) নির্মাণবাদ ভিত্তিক কৌশল ।
শৃঙ্খলা :–
গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় আত্মশৃঙ্খলা এবং সামাজিক শৃঙ্খলার উপর আস্থা রাখা হয় । শিক্ষার্থীরা যাতে নিজেদের বিষয়গুলি নিজেরাই সমাধান করতে সক্ষম হয় সেজন্য শিক্ষার্থী পর্ষদ এবং শ্রেণিকমিটি গঠন করা হয় । বিভিন্ন সহপাঠক্রম কার্যাবলিতে দলগতভাবে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয় যাতে শিক্ষার্থীরা ধৈর্য , সহযোগিতা ইত্যাদির মূল্য অনুধাবন করতে সক্ষম হয় ।
শিক্ষক : —
শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি , আদর্শ এবং মূল্যবোধ বিকাশে শিক্ষকের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । সেজন্য প্রথমে তাঁকে গণতন্ত্রপ্রেমী শিক্ষক হিসাবে নিজেকে তুলে ধরতে হবে । তিনি শিক্ষার্থীদের ব্যক্তি হিসাবে মর্যাদা দেবেন এবং শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত পার্থক্য অনুযায়ী পঠন – পাঠনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন ।
বিদ্যালয় প্রশাসক : —
গণতান্ত্রিক শিক্ষায় বিদ্যালয় প্রশাসনের নীতি হবে— ( 1 ) প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে সঠিকভাবে ক্ষমতা এবং দায়িত্ব বণ্টন । ( 2 ) প্রশাসনের মূল লক্ষ্য হবে বিকেন্দ্রীকরণ এবং মানব সম্পর্ক স্থাপন । বিদ্যালয় : Thomas H Briggs- এর মতে — বিদ্যালয় হল গণতন্ত্রের প্রকৃত অভিভাবক School is truly the gurdian of Democracy ) । উইলিয়াম কিলপ্যাট্রিক ( William Kilpatrick ) এর মতে গণতান্ত্রিক বিদ্যালয় নিম্নলিখিত কাজগুলি করবে
( 1 ) শিক্ষার্থীরা যাতে গণতন্ত্রের বিষয়গুলিকে সঠিকভাবে এবং বুদ্ধিমত্তার অনুধাবন করতে সক্ষম হয় তার ব্যবস্থা করা ।
( 2 ) শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করা ।
( 3 ) শিক্ষার্থীদের সমবেতভাবে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে কাজ করার দক্ষতা গড়ে তোলা ।
শিক্ষায় গণতন্ত্রের সঠিক প্রয়োগের অভাবে সমস্যা :–
ভারতবর্ষে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সঠিকভাবে প্রয়োগ না হওয়ায় এবং শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবের ফলে একাধিক সমস্যা দেখা দিয়েছে । প্রতিটি রাজনৈতিক দলই তাদের শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য শিক্ষাব্যবস্থাকেই হাতিয়ার করছে । শাসক দল তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করে শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রে দলীয় রাজনীতিকরণে সচেষ্ট । স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক দলগুলি এর বিরোধিতা করছে যার ফলেই শিক্ষাক্ষেত্রে নানা অশান্তি দেখা দিয়েছে । বিভিন্ন শিক্ষা কমিশন এই ধরনের সমস্যাসমাধানে সুপারিশ করা সত্ত্বেও রাজনৈতিক দলগুলি তার প্রয়োগ করছে না উপরন্তু গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে তারা সমাধানের পথ গ্রহণে অনিচ্ছা প্রকাশ করছে ।