মৌর্য – পরবর্তী পর্ব

💠 মৌর্য – পরবর্তী পর্ব :

◼️ শুঙ্গ ও কাম্ব বংশ :

🔹 শুঙ্গ বংশের আমলে ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্মকে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা দেখা যায় । পুষ্যমিত্র দু’বার অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন । পুষ্যমিত্র শুঙ্গের পর সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র অগ্নিমিত্র , যিনি কালিদাস রচিত ‘ মালবিকাগ্নিমিত্রম ’ – এর নায়ক ।


🔹শুঙ্গ সম্রাট ভাগভদ্রের শাসনকালের চতুর্দশ বর্ষে তক্ষশিলার ব্যাকট্রিয় গ্রিক শাসক অ্যান্টিয়ালকিডাসের দূত হিসেবে সম্রাটের দরবারে উপস্থিত হন হেলিওডােরাস । হেলিওডােরাস ভাগবত ধর্ম গ্রহণ করেন এবং বিষ্ণুর বাহন গরুড়ের সম্মানে বেসনগরে একটি স্তম্ভ নির্মাণ করন । বেসনগরের এই স্তম্ভলেখ প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে বিশেষ মূল্যবান ।


🔹মাত্র 100 বছরের মধ্যেই শুঙ্গ বংশের কর্তৃত্ব মগধ ও মধ্য ভারতের কিছু অংশে সীমিত হয়ে যায় । শেষ শুঙ্গ রাজা দেবভুতিকে হত্যা করে তার মন্ত্রী বাসুদেব ক্ষমতা দখল করেন ( 75 খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ) ।


🔹বাসুদেব কাম্ব বংশের প্রতিষ্ঠা করেন , কিন্তু 28 খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যেই এই রাজবংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ।



◼️ অন্যান্য অঞ্চল :

🔹উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় শক্তিরা এই সময় মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে । এর মধ্যে ছিল পাঞ্জাবের কুনিন্দ , যৌধেয় প্রমুখ শক্তি এবং মধ্য ভারত ও রাজস্থানে শিবি , মালব ও অর্জুনায়নরা ।

🔹কলিঙ্গের বিখ্যাত শাসক ছিলেন খারবেল , খারবেল প্রাচীন চেদি রাজবংশের মহামেঘবাহন পরিবারভুক্ত ছিলেন । মগধ , দাক্ষিণাত্য ইত্যাদি অঞ্চল আক্রমণ এবং জৈনধর্মের পৃষ্ঠপােষকতার জন্য খারবেল বিখ্যাত । উদয়গিরির হাতিগুম্ফা গুহার বিখ্যাত শিলালিপি থেকে খারবেলের সম্পর্কে জানা যায় ।


🔹দাক্ষিণাত্যের বিভিন্ন স্থানীয় শক্তিকে পরাস্ত করে এই অঞ্চলে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে সাতবাহন বংশ । সাতবাহনরা ‘ অন্ধ্র ‘ বা ‘ অন্ধ্রভৃত্য ‘ নামেও পরিচিত ছিল । যদিও প্রকৃতপক্ষে তারা অন্ধ্রের নয় মহারাষ্ট্রের অধিবাসী ছিল । সাতবাহন বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সিমুক , কিন্তু এই বংশের সবচেয়ে খ্যাতনামা শাসক ছিলেন গৌতমীপুত্র সাতকর্নি এবং তাঁর পুত্র বশিষ্ঠিপুত্র পুলুমায়ি । সাতবাহন বংশের রাজধানী ছিল প্রতিষ্ঠান ( পৈথান ) । সাতবাহন আমলে পশ্চিম ভারতের বাণিজ্য বিশেষ সমৃদ্ধি অর্জন করেছিল ( প্রধান বন্দর – ভারুচ , কল্যাণ , সােপারা ইত্যাদি ) । সাতবাহন আমলে ব্রাহ্মণ্যধর্ম , বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম বিস্তারলাভ করে । অমরাবতী ও নাগার্জুনিকোন্ডার অনুপম স্থাপত্য ও ভাস্কর্য কীর্তি এই আমলেরই সৃষ্টি । এছাড়া পাহাড়ের গায়ে গুহা কেটে শিল্পকর্মের নমুনাও ( কার্লে , কানহেরি , নাসিক , অজন্তা ও ইলােরার – প্রথমপর্বের স্থাপত্য ) এই সময়ই প্রথম দেখা যায় ।


🔹মৌর্য – পরবর্তী যুগে দক্ষিণ ভারতের তিনটি প্রধান শক্তি ছিল — চের বংশ ( বর্তমান মালাবার অঞ্চল ) , পান্ড্য বংশ ( দক্ষিণ – পূর্ব উপকূল ও কাবেরী নদী উপত্যকা ) । সঙ্গম সাহিত্য থেকে এই সময়কার দক্ষিণ ভারত সম্পর্কে জানা যায় ।




◼️ উত্তর – পশ্চিম ভারত :

🔹এই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল উত্তর – পশ্চিম ভারতে বিদেশিদের আগমন । এর মধ্যে ইন্দো – গ্রিকরা আলেকজান্ডারের অভিযানের ফলস্বরূপ এসেছিল । ইন্দো – গ্রিক ছাড়া অন্যান্যরা মধ্য এশিয়া থেকে এসেছিল ।

🔹উত্তর – পশ্চিম ভারতে আগত বিভিন্ন গােষ্ঠীর মধ্যে প্রথম ছিল ইন্দো – গ্রিকরা । এরা ইতিহাসে ব্যাকট্রিয় ( ব্যাকট্রিয়া — বর্তমান আফগানিস্তানের বলখ অঞ্চল ) গ্রিক নামেও পরিচিতি । আফগানিস্তান থেকে এদের সাম্রাজ্যসীমা একসময় মথুরা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । ইন্দো – গ্রিক রাজারাই ভারতে প্রথমে তাদের নিজেদের নাম , উপাধি ও ছবি – সহ ধাতব মুদ্রার প্রচলন করেন । ইন্দো – গ্রিক রাজাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন মেনান্দার বা মিলিন্দ ( 165-145 খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ) । মিলিন্দ বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন । বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুনের সঙ্গে তাঁর কথােপকথন ‘ মিলিন্দ পনহো ‘ গ্রন্থে বিবৃত হয়েছে । ইন্দো – গ্রিক শাসনের সবচেয়ে মূল্যবান ঐতিহ্য হিসেবে পরিগণিত হয় ইন্দো – গ্রিক শিল্পকলার ঐতিহ্য , যা ‘ গান্ধার শিল্পকলা ‘ রূপে বিখ্যাত ।


◼️ শকদের আদি বাসস্থান ছিল মধ্য এশিয়ার সিরদরিয়া নদীর উত্তর দিকে । শক বা সিথিয়ানরা ইন্দো – গ্রিকদের হঠিয়ে ব্যাকট্রিয়া , ইরান ও ভারতের উত্তর – পশ্চিমে প্রবেশ করে । ভারতে শক রাজাদের পদবী ছিল স্যাট্রাপ ( Satrap ) বা ক্ষত্ৰপ । উত্তর ভারতে মথুরায় শক ক্ষত্রপদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন মহাক্ষত্ৰপ রঞ্জভুল বা রাজুভুল ও তার পুত্র সােদাস । শেষ পর্যন্ত পশ্চিম ভারতে শকদের ক্ষমতার সবেচেয়ে অধিক বিস্তার দেখা যায় । এখানে যে শক ক্ষত্রপদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় তারা শকদের ক্ষথরট ( মহারাষ্ট্র ) ও কর্দমক ( উজ্জয়িনী ) নামক দুই শাখার বংশধর । ক্ষহরটী বংশের ক্ষত্রপদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য ছিলেন নহপান । পশ্চিম ভারতের শক রাজারা সাতবাহনদের সঙ্গে নিয়মিত সংঘর্ষে লিপ্ত থাকতেন । উজ্জয়িনীর কর্দমক বংশীয় শক রাজাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন রুদ্রদমন ( 130-152 খ্রিষ্টাব্দ ) , যার সংস্কৃতে রচিত জুনাগড় প্রশস্তি বিশেষ উল্লেখযােগ্য । তিনি মহাক্ষএপ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন ।

◼️ খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত পশ্চিমের এই শক – আধিপত্য চূর্ণ করে ‘ শকারি ‘ ( বা শক – শত্রু ) উপাধি গ্রহণ করেন ।

◼️ উত্তর ও পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন অংশে শকদের সমসাময়িক ছিল পার্থিয়রা , যারা ভারতে পহ্লব নামে পরিচিত । পহ্লবরা খুব সম্ভবত বর্তমান ইরান থেকে এসেছিল । পহ্লবদের সবচেয়ে বিখ্যাত শাসক ছিলেন গন্ডােফারনেস ( প্রথম খ্রিষ্টাব্দের প্রথমার্ধ ) , তাঁর আমলেই সেন্ট টমাস ভারতে এসেছিলেন এবং ভারতে প্রথম খ্রিষ্টধর্ম প্রচার করেছিলেন বলে মনে করা হয় ।



◼️ বহিরাগত এই গােষ্ঠীগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত কুষাণরা , যারা চীন ও মধ্য এশিয়ায় ইয়ু – চি বা তােখারিয় নামেও পরিচিত ছিল । খ্রিষ্ট – পরবর্তী প্রথম শতাব্দীতে মধ্য এশিয়ার চীনের কাছাকাছি অঞ্চলে পাঁচটি ইয়ু – চি গােষ্ঠীকে একত্রিত করেন কুজুল কদফাইসেস । তাঁর পরে আসেন বিম কদফাইসেস , যিনি প্রথম স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেন । বিম কদফাইসেসের পরে কুষাণদের রাজা হন কণিষ্ক । খুব সম্ভবত 78 খ্রিষ্টাব্দে তিনি সিংহাসনে আরােহন করেন ( শকাব্দের সূচনা ) । কণিষ্কের আমলেই কুষাণ সাম্রাজ্য তার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছায় , মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ছাড়াও কণিষ্কের সাম্রাজ্য ভারতে সাঁচি ও বারাণসী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কণিষ্কের রাজধানী ছিল পুরুষপুর বা পেশােয়ার । মনে করা হয় তাঁর দ্বিতীয় রাজধানী ( অথবা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নগর ) ছিল মথুরা । কণিষ্ক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং বৌদ্ধধর্মের প্রচারের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন । কণিষ্কের পৃষ্ঠপােষকতাতেই কাশ্মীরে চতুর্থ বৌদ্ধ সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয় । বিখ্যাত বৌদ্ধ দার্শনিক বসুমিত্র , সংস্কৃত নাট্যকার অশ্বঘােষ , পণ্ডিত নাগার্জুন ছাড়াও প্রাচীন ভারতের দুই বিখ্যাত চিকিৎসক চরক ও সুশ্রুত কণিষ্কের সমসাময়িক ছিলেন বলে মনে করা হয় । কণিষ্কের আমলেই গান্ধার শিল্পের চরম বিকাশ ঘটে । এই শিল্পরীতিতে ভারতীয় , ইরানীয় ও গ্রিক – রােমান রীতির সংমিশ্রণ ঘটে । এই গান্ধার শিল্পের এক অনবদ্য নিদর্শন হল বুদ্ধমূর্তি ।