ভূতের গল্প : শনি সন্ধ্যার পঞ্চভূত

আমরা উত্তর কলকাতার ক ’ জন বন্ধু মিলে একটা ক্লাব করেছিলুম । উদ্দেশ্য ছিল প্রতি শনিবার সন্ধ্যাবেলায় চুটিয়ে আড্ডা দেব । তাস , দাবা আর ক্যারাম খেলব । সেই সঙ্গে ফিস্টিরও আয়ােজন থাকবে ।

প্রথমে ঠিক হয়েছিল ক্লাবের নাম হবে স্যাটারডে ইভনিং ক্লাব । কিন্তু তারাপদর মধ্যে বাঙালি – বাঙালি ভাব বড় বেশি । তার মতে , স্বাধীন দেশে ইংরেজি প্রীতি দাস মনােভাবের প্রতীক । সেই কবে ইংরেজ এ দেশ থেকে পাত্তারি গুটিয়েছে । এখনও ইংরেজি আঁকড়ে থাকার মানে হয় না । ক্লাবের নাম হােক শনি – সন্ধ্যা ক্লাব ।

শেষ পর্যন্ত তা – ই হলাে । এ – ও ঠিক করা হলাে , আমরা ছজন বন্ধু বাদে আর কাউকে শনি – সন্ধ্যা ক্লাবের মেম্বার করব না । তারাপদ , দীপক , গােপাল , সেলিম , ব্রতীন এবং আমি এই ছজন মেম্বার । কিন্তু শুধু ক্লাব করলেই হলাে না , একটা ঘর চাই । দীপক সে – সমস্যার সমাধান করে দিল । গঙ্গার ধারে তার দাদামশাইয়ের একটা পুরনাে বাগানবাড়ি খালি পড়ে আছে । সেই বাড়ির হলঘরটাই ক্লাবের ডেরা হবে ।

গঙ্গার ধারে চারদিকে পাঁচিল ঘেরা দু একর জায়গা । মধ্যিখানে একতলা বাড়ি । কেয়ারটেকার রঘুনাথ একটা ঘরে থাকে । পুরনাে আমলের ফলবাগান জঙ্গল হয়ে গেছে । কিছু উঁচু গাছ ও পরিবেশকে জঙ্গুলে করে ফেলেছে । এক রবিবার সামনের লনটা পরিষ্কার করা হলাে । পরের শনিবার ফিস্টি হলাে ধুমধাম করে । রঘুনাথ খুব খুশি । বাড়িটা এতদিন হানাবাড়ি হয়েছিল । রাতবিরেতে ভূতের অত্যাচারে নাকি সে তিষ্ঠোতে পারছিল না । এবার ভূতেরা ভয় পেয়ে জব্দ হয়ে যাবে । মানুষ ভূতকে যেমন ভয় পায় , ভূতও তেমনি মানুষকে দেখে ভয় পায় ।

রঘুনাথের কথা শুনে আমরা হাসাহাসি করেছিলুম । এমন নিরিবিলি জায়গায় একা থাকলে মাথায় খুব কল্পনাশক্তি গজায় । বিশেষ করে রাতবিরেতে ছুঁচো – ইঁদুর আরশােলার চলাফেরা এবং গাছপালা ঝােপেঝাড়ে বাতাসের শব্দ ভূতুড়ে মনে হতেই পারে । তবে রঘুনাথকে সাহসী বলতেই হবে । তার তাগড়াই গড়ন । গায়ে জোরও আছে মনে হয় । প্রতি শনিবার সন্ধ্যার আড্ডায় সে কিছুক্ষণ অন্তর চা যােগান দেয় । বাইরে থেকে পান সিগারেট , আবার কখনও তেলেভাজা , মুড়ি , জিলিপি , কচুরি , সিঙাড়া যখন যা ফরমায়েস করা হয় , সে এনে দেয় । দীপক আর সেলিম দাবা খেলতে বসে । বাকি চারজন ক্যারাম খেলি বা তাস পিটি । হই – হল্লা করি । তারপর রাত দশটায় যে – যার বাড়ি ফিরি ।

আমরা ক্লাবের মেম্বাররা একটা শর্ত করে নিয়েছিলুম । ঝড় – বৃষ্টি হােক , রাস্তায় জল জমুক , কিংবা এলাকায় হাঙ্গামা হােক কিংবা কারফু জারি হােক , প্রত্যেককে শনিবার সন্ধ্যা ছ ‘ টা নাগাদ ক্লাবে পৌছুতেই হবে । না এলে একশাে টাকা ফাইন । ফাইন দেওয়ার ভয়ে প্রত্যেকে শনি – সন্ধ্যার আভড়ায় ঠিকই এসে জুটত ।

ক্লাব শুরু হয়েছিল এপ্রিলে । তারপর দেখতে দেখতে জুন মাস এসে গেল । বর্ষা শুরু হলাে । এক পশলা বৃষ্টিতেই রাস্তায় এক হাঁটু জল জমে যায় । একদিন বিকেলে প্রচণ্ড ঝড় – বৃষ্টি বিপদ বাধাল । রাস্তায় জল ঠেলে আমার যেতে আপত্তি নেই । কিন্তু ঝােড়াে হাওয়ায় ছাতা সামলানাে কঠিন । একটা রিকশাও পাওয়া গেল না । কিন্তু একশাে টাকা জরিমানার ভয়ে মরিয়া হয়ে বেরিয়ে পড়লুম । বুদ্ধি করে কিট – ব্যাগে একপ্রস্থ প্যান্ট শার্ট তােয়ালে নিলুম । তারপর বাগানবাড়িতে যখন পৌঁছলুম , তখন ভিজে একসার হয়ে গেছি । বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলুম বিকেল চারটেয় । পৌছুতে দু ঘণ্টা লেগে গেছে । রঘুনাথ একটা লণ্ঠন জ্বেলে দাঁড়িয়েছিল । বলল , বিকেল থেকে লােডশেডিং দাদাবাবু ! মনে হচ্ছে কেবলফল্ট । বেশি বৃষ্টি হলেই এই রকম হয় । বরাবর দেখে আসছি ।

বললুম , “ আর কেউ আসেনি ? ”

রঘুনাথ বলল , “ না । তবে এসে যাবেন একে একে । আপনি বসুন । খুব ভিজে গেছেন দেখছি । এক কাজ করুন । আমি , একটা শুকনাে কাপড় এনে দিচ্ছি ।

বললুম , “ দরকার হবে না রঘুনাথ । শুকনাে কাপড় সঙ্গে নিয়েই বেরিয়েছি । তুমি বরং এক কাপ চা খাওয়াতে পারাে নাকি দেখ ! ”

রঘুনাথ হলঘরে একটা টেবিলে লণ্ঠন রেখে চলে গেল । লণ্ঠনটা এ বাড়ির মতাে পুরনাে । কাচে কালি পড়েছে । আলােটা তেমন খেলছে না । মাঝে মাঝে দপদপ করছে । নিভে গেলেই কেলেঙ্কারি । বাইরে ঝােড়াে হাওয়া আর বৃষ্টি সমানে চলেছে । তােয়ালেতে গা মুছে শুকনাে প্যান্ট – শার্ট পরে ভিজে কাপড়গুলাে নিঙড়ে একটা জানালার রডে কোনওরকমে ঝুলিয়ে রাখলুম । তারপর চেয়ারে বসে পা দুটো টেবিলে তুলে দিলুম । জুতাে ভিজে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে ।

হ্যারিকেনের কাচে কালি বেড়ে যাচ্ছে দেখে দম কমিয়ে দিলুম । সেই সময়ে কেউ ঘরে ঢুকল । আবছা আলােয় দেখলুম , তারাপদ । বললুম , “ কী রে ? আসতে পারলি তা হলে ? ”

তারাপদ বলল , “ আসতেই হবে ।

“ ভিজে গেছিস তাে ? বুদ্ধি করে আমার মতাে -।”

তারাপদ আমার কথার ওপর বলল , “ আমি ভিজিনি । ” অবাক হয়ে বললুম , “ ভিজিসনি মানে ? এখনও তাে সমানে বৃষ্টি হচ্ছে । ” তারাপদ সেকথার জবাব না দিয়ে বলল , “ এক কাপ চা চাই । রঘুনাথ কোথায় ?

“ রঘুনাথ আমার জন্য চা করতে গেছে । ওকে বল্ গিয়ে ! ”

তারাপদ কিচেনের দিকে চলে গেল । তারপর হ্যারিকেনটা দপদপ করতে করতে নিভে গেল । আমি সিগারেট খাই না । তাই দেশলাই নেই । ডাকলুম , ‘ রঘুনাথ । একটা দেশলাই । আলাে নিভে গেছে । ”

রঘুনাথের কোনও সাড়া নেই । তারাপদও ফিরে আসছে না ।

ঘরের ভেতর গাঢ় অন্ধকার । মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ ঝিলিক দিচ্ছে । সেই আলােয় মুহূর্তের জন্য দেখলুম , দরজা দিয়ে কেউ ঢুকল । বললুম , “ কে ? ”

‘ আমি গােপাল ।’

“ হ্যারিকেনটা নিভে গেছে । দেশলাই জ্বাল । ”

গােপাল বলল , “ দেশলাই ভিজে গেছে । জ্বলবে না । রঘুনাথ কৈ ? “

কিচেনে চা করতে গেছে । ”

“ আর কেউ আসেনি ? ”

“ তারাপদ এসেছে । কিচেনে গেল চায়ের কথা বলতে । ”

” আমারও চা খেতে ইচ্ছে করছে । রঘুনাথকে বলে আসি । ”

অন্ধকারে গােপালের ভিজে জুতাের মচমচ শব্দ শােনা গেল । সেই সময় বিদ্যুতের আলােয় দেখলুম আরেক মেম্বার ঢুকছে । বললুম , “ কে ? ”

সেলিমের সাড়া পেলুম । “ পুটু নাকি ? আর কেউ আসেনি ? ”

“ তারাপদ এসেছে । কিচেনে গেল চায়ের কথা বলতে । ”

“ আমারও চা খাওয়া দরকার । বলে আসি । ”

অন্ধকার ভিজে চটি জুতাের শব্দ শুনে বললুম , সেলিমও কিচেনে চলে গেল । রঘুনাথ এখনও কেন আসছে না । বােঝা যায় কেটলির জলে আরও দু কাপ জল ঢালতে হবে তাকে । কাজেই সময় লাগবে জল গরম হতে । একসঙ্গে ছ ’ কাপ জল ঢাললেই তাে হয় । বারবার একজন করে আসবে আর চায়ের জল গরম হতে আরও সময় লাগবে । কথাটা কিচেনে গিয়ে বলার জন্য উঠবাে ভাবছি , দরজায় আর এক মেম্বারকে দেখা গেল । গলা শুনে বুঝলুম ব্রতীন । সে ডাকল , “ রঘুনাথ ! রঘুনাথ । ”

বললুম , “ ব্রতীন কি করে এলি রে ? ভিজিসনি ? ”

ব্রতীন বলল , “ পুঁটু নাকি ? অন্ধকারে বসে আছিস দেখছি । ”

“ লােডশেডিং । হ্যারিকেনটা নিভে গেল । দেশলাই দে । ”

– “ আর দেশলাই । ভিজে ঢােল হয়ে গেছে । হ্যাঁরে পটু, আর কেউ আসেনি ?”

“ তারাপদ , গােপাল আর সেলিম এসেছে ! কিচেনে রঘুনাথকে চায়ের কথা বলতে গেছে । ”

ব্রতীন অন্ধকারে খ্যা খ্যা করে হেসে বলল , “ তাহলে আমিও যাই । চা খেতে ইচ্ছে করছে । ”

জুতাের শব্দে বুঝলুম সে – ও চলে গেল । নাঃ , এরকম করলে , আর চা খাওয়াই হবে না । উঠে দাঁড়ালুম কিচেনে যাবার জন্য । সেই সময় কাছাকাছি দীপকের সাড়া পেলাম । “ কোথায় যাচ্ছিস পুঁটু ? ”

চমকে উঠে বললুম , “ দীপক , তুই কখন এলি ? তােকে তাে ঢুকতে দেখলুম না। ”

দীপক আমার উল্টোদিকের চেয়ার থেকে খি – খি করে হেসে বলল , “ দেখবি কী করে ? অন্ধকার যে ! ”

তারপর ব্রতীনের সাড়া পেলুম ! আমাকেও দেখতে পায়নি পুঁটু ! ”

ওরা দুজনে হাসতে লাগল । বললুম , হাসি পরে হবে । হ্যারিকেনটা জ্বালানাে দরকার যে । ”

দীপক বলল , “ অন্ধকার ভাল লাগছে । তাই না ব্ৰতীন ? ”

ব্রতীন সায় দিয়ে বলল , “ হ্যা । আর অন্ধকারের আড্ডাটা জমবে ভাল । কিন্তু চা – টা না হলে আড্ডা তাে জমবে না । দেখি , রঘুনাথ চায়ের ব্যবস্থা করছে নাকি । ”

দীপক বলল , “ চল । আমিও যাই । পুটু যাবি নাকি ? ”

রাগ করে বললুম , “ নাহ , কখন রঘুনাথকে চায়ের কথা বলেছি । তার পাত্তা নেই । এদিকে তারাপদ , সেলিম আর গােপাল গেল তা গেলই । চায়ের নিকুচি করেছে । ”

ব্রতীন বলল , “ আয় দীপক ! পুঁটু মনে হচ্ছে রাগ করে চা খাবে না । ”

অন্ধকারে খসখস চটাৎ চটাং মসমস্ শব্দ হলাে । বুঝলুম ভেজা জুতাের শব্দ । সবাই ভিজে গেছে । ভিজতে বাধ্য । রাস্তায় এতক্ষণ এক কোমর জল না হয়ে যায় না । কিন্তু তারাপদ যে বলল সে একটুও নাকি ভেজেনি ? নিশ্চয় বাস বা গাড়ি পেয়েছিল ।

কিন্তু আমি বসে আছি তাে আছিই । রঘুনাথের পাত্তা নেই , ওদেরও নেই । ‘ ব্যাপারটা দেখা দরকার । হলঘরের কোণার দিকে দরজা দিয়ে কিচেন – কাম ভাইনিং রুমে যাওয়া যায় । অন্ধকারে ঠাহর করে সেই দরজার কাছে গেলুম । গিয়ে দেখি , কেরােসিন কুকার জুলছে । কেটলিও চাপানাে আছে । সেই আলােয় আবছা দেখা গেল ডাইনিং টেবিলের পাঁচটা চেয়ারে আমার পাঁচ বন্ধু বসে আছে । একটা চেয়ার খালি । কিন্তু রঘুনাথকে দেখতে পেলুম না ।

আমাকে দেখে তারাপদ বলল , “ চলে আয় পুটু ! বসে পড় ! চা খাওয়াটা এখানেই জমবে । ”

বললুম , “ রঘুনাথ কোথায় ? ”

তারাপদ হ্যা হ্যা করে হেসে বলল , “ রিঘুনাথ পালিয়ে গেছে । ”

“ সে কী ! পালাল কেন ? ”

“ আমাকে দেখে ।”

অবাক হয়ে খালি চেয়ারটাতে বসে বললুম , “ তােকে দেখে পালানাের কী আছে ? ”

তারাপদ জবাব দিতে যাচ্ছিল দীপক বলল , “ চেপে যা , চেপে যা ! দ্যাখ , চায়ের জল ফুটল নাকি । ”

তারাপদ উঠে গিয়ে চা করতে থাকল । বললুম , “ হ্যা রে দীপু চেপে যা বললি কেন ? ”

দীপক মিটিমিটি হেসে বলল , “ সে সব কথা পরে হবে খন । চা খাওয়া যাক । বৃষ্টিটা বেশ জমেছে । ”

ব্রতীন বলল , “ শুধ চা ? তেলেভাজা – টাজা হলে ভাল হতাে । ”

গােপাল বলল , “ পরের বার হবে । আপাতত চা খেয়ে চাঙ্গা হওয়া যাক ? ”

আমি বললুম , “ একটা আলাে চাই যে । এ ঘরে মােমবাতি নেই ? বরং হ্যারিকেন নিয়ে আসা যাক । ”

সেলিম বলে উঠল , “ না না ! এই শনি সন্ধ্যাটা বিনি আলােতেই আড্ডা দেওয়া যাক । ”

ততক্ষণে তারাপদর চা তৈরী হয়ে গেছে । কাপগুলাে সে প্রত্যেকের হাতে ধরিয়ে দিল । চায়ে চুমুক দিয়ে তেতাে লাগল । বললুম , “ বিচ্ছিরি কড়া হয়ে গেছে । তারাপদ , তুই চা করতে জানিস , নে । ”

তারাপদ চেয়ারে বসে বলল , ‘ কড়া চা না হলে এখন চলে ? ”

দীপক বলল , কুকারটা নিভিয়ে দে । খামােকা তেল খরচ করা কেন ?

তারাপদ বলল , “ একটু জুলুক না । পুটু অন্ধকার পছন্দ করে না ! ”

কথাটা বলে সে আমার দিকে ঘুরল । হঠাৎ দেখলুম , তারাপদ নয় । প্যান্ট শার্ট পরা একটা কঙ্কাল । চমকে উঠে অন্যদিকে তাকালুম । আতঙ্কে শরীর হিম হয়ে গেল । বুক ধড়াস ধড়াস করতে লাগল । পাঁচটি পােশাক পরা কঙ্কাল ডাইনিং টেবিল ঘিরে চায়ে চুমুক দিচ্ছে ।

অমনি বিকটভাবে চেঁচিয়ে উঠলম , “ রঘুনাথ ! রঘুনাথ ! “

কঙ্কালগুলাে হিহিহিহি করে হাসতে লাগল । চেয়ার থেকে উঠে মরিয়া হয়ে হলঘরে , তারপর সেখান থেকে বাইরে বেরিয়ে চেঁচাতে থাকলুম , “ রঘুনাথ ! রঘুনাথ ।”

বৃষ্টি সমানে ঝিরঝির করে ঝরছে । লনের ওখানে একটা গ্যারেজ ঘর আছে । দেখেছি । সেখানে দীপকের দাদামশাইয়ের গাড়ি থাকত একসময় ।

সেখান থেকে রঘুনাথের সাড়া এল , “ পালিয়ে আসুন দাদাবাবু ! পালিয়ে আসুন ! ”

দৌড়ে ঘাস ঝােপঝাড়ের ভেতর দিয়ে গ্যারেজ ঘরে পৌছলুম ! আবছা রঘুনাথকে দেখা যাচ্ছিল । সে দাঁড়িয়ে আছে । বলল , “ খুব বেঁচে গেছেন দাদাবাবু ! ”

হাঁপাতে হাঁপাতে বললুম , “ পাঁচ পাঁচটা ভূ – ভূ – ভূ . . . . ”

“ চুপ ! চুপ ! ” রঘুনাথ বলল , “ এই বিপদের সময় ও কথাটা বলতে নেই ।

একটু ধাতস্থ হওয়ার পর বললুম , “ কিন্তু এখানে আর কতক্ষণ থাকব ? বৃষ্টি ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে না । চলাে ! বরং আশেপাশের বাড়ির লােকজনের কাছে । গিয়ে ব্যাপারটা বলি । ওদের তাড়ানাে দরকার । ”

রঘুনাথ বলল , “ ঠিক বলেছেন । কথাটা এতক্ষণ কেন যে মাথায় আসেনি । তবে আপনাকে আর কষ্ট করে বেরুতে হবে না । আমি এক্ষুনি , লােক ডেকে আনি । ”

মুখে বললুম বটে , “ তাই যাও ” , কিন্তু একা থাকতে ভয় করছিল । রঘুনাথ চলে যাওয়ার পর ভয়টা আরো বেড়ে গেল । প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল , এই ।বুঝি একটা কঙ্কাল চুপিচুপি এসে আমার ঘাড়টি মটকে দেবে । অবশেষে গুঁড়ি মেরে বসলুম , যাতে ওরা আমাকে এখানে দেখতে না পায় ।

তারপর বসে আছি তাে আছি । রঘুনাথের পাত্তা নেই । অন্ধকার আরও ঘন হয়েছে । বৃষ্টিটা অবশ্য কমে গেছে । একসময় বাড়ির দিক থেকে কাদের চাপা গলায় কথাবার্তা শােনা গেল । উঁকি মেরে দেখি , হলঘরের ভেতর হারিকেন জুলছে । খােলা দরজা – জানলা দিয়ে ছায়ামূর্তির মতাে যাদের দেখা যাচ্ছে , তারা সেই পঞ্চভূত ছাড়া আর কারা হবে ? একটু পরে তারাপদর ডাকাডাকি শুনতে পেলুম , “ রঘুনাথ ! রঘুনাথ ! ”

সর্বনাশ ! পঞ্চভূত আবার আমার বন্ধুদের রূপ ধরে নতুন কোনও মতলব ভেঁজেছে । রঘুনাথটা একেবারে অপদার্থ । পঞ্চভূতের খবর পেয়ে জল কাদা ভেঙে লোকেরা মার মার করে তেড়ে আসবেই । সে বােধহয় ঠিক ভাবে কথাটা বুঝিয়ে বলতে পারছে না । কিংবা লােকে তার কথা বিশ্বাস করছে না ।

আবার চাপা গলায় কথাবার্তা , তারপর ক্যারামের গুটি চালার খটখট শব্দ শুনতে পেলুম । রােসাে ব্যাটাচ্ছলেরা , রঘুনাথ এখনই এসে যাবে লােকজন নিয়ে । মেরে ভূত ভাগিয়ে দেবে ।

আরও কিছুক্ষণ কেটে গেল । গ্যারেজ ঘর থেকে দেখতে পাচ্ছি পঞ্চভূত ক্যারাম আর তাস খেলছে ! রাগে গায়ে জ্বালা ধরে গেল । একবার দীপকের কথা শুনতে পেলুম । সে বলল , “ এই ভিজে জামা নিশ্চয় পুঁটুর । ”

তারপরই একটা হল্লা শােনা গেল । বাগানবাড়ির গেট দিয়ে টর্চ জ্বেলে লাটিসােটা নিয়ে একদল লােক ঢুকছে । তাদের আগে “ মার মার ” বলে হাঁক ছেড়ে রঘুনাথ দৌড়ে আসছে । ভেতরে ঢুকেই সবাই চেঁচাতে লাগল , ‘ কৈ ভূত ? মার মার । ঠ্যাং ভেঙে দে । ”

সাহস পেয়ে আমিও যােগ দিলুম ওঁদের সঙ্গে । লন পেরিয়ে মারমুখী ভিড় হলঘরের দরজার সামনে যেতেই দড়াম করে দরজা বন্ধ হয়ে গেল । হ্যারিকেনের আলােও গেল নিভে । এতে মারমুখী লােকগুলাে আরও রেগে গিয়ে দরজায় লাথি মারতে লাগল । লাথির চোটে দরজা মড়মড় করে ভেঙে পড়ল । লােকগুলাে “ কৈ ভূত ? মার মার ! ভূতের ঠ্যাং ভেঙ্গে দে ! ” বলে ঘরে ঢুকল । টর্চের আলােয় কাকেও দেখা গেল না ।

একটা দল নিয়ে আমি আর রঘুনাথ কিচেনে ঢুকলুম । আর একটা দল বাড়ির চারপাশে খুঁজতে বেরুল । কিন্তু পঞ্চভূহের পাত্তা পাওয়া গেল না । কিচেনের ডাইনিং টেবিলে ছটা কাপ দেখতে পেলুম । পাঁচটা কাপে চায়ের তলানি পড়ে আছে । একটা কাপ চায়ে ভর্তি । এই কাপটা আমার ।

রঘুনাথ বলল , “ মানুষের ভয়ে ভূতগুলাে পালিয়ে গেছে দেখছি । ”

একজন তাগড়াই চেহারার লােক তার লাঠিটা রঘুনাথকে দিয়ে বলল , “ এটা হাতের কাছে রেখে দিও রঘুদা । আমরা যাই । ফের যদি ঝামেলা করে , খবর দিও । ”

বাড়ির চারদিকে যারা খোঁজাখুঁজি করছিল , তারা হলঘরে ফিরে এসে বলল , ‘ পালিয়ে গেছে । তাদের একজন দেশলাই জ্বেলে লণ্ঠনটা ধরাল । তারপর বলল , “ চলি রঘুদা ! তেমন কিছু হলে আবার খবর দিও । ”

পাড়ার লােকগুলাে চলে যাওয়ার পর রঘুনাথ বলল , “ হ্যারিকেনটা নিয়ে কিচেনে চলুন দাদাবাবু ! ভূতের এঁটো কাপগুলাে ধুয়ে ফেলি । তারপর দুজনে চা খাওয়া যাবে । বড় ধকল গেছে ! ”

কিচেনের ডাইনিং টেবিলে হ্যারিকেন রেখে বসে আছি । রঘুনাথ বেসিনে কাপগুলাে রগড়ে রগড়ে ধুচ্ছে । এমন সময় জানালায় কে চাপা স্বরে ডাকল , “ পুটু পুঁটু ! পুঁটু ! ”

চমকে উঠে বললুম , “ রঘুনাথ ! লাঠি লাঠি । আবার এসেছে ওরা ? ”

রঘুনাথ বেসিনে কাপ রেখে লাঠি বাগিয়ে দাঁড়াল । জানালায় তারাপদর মুণ্ডু দেখা গেল । সে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল , “ আমরা ভূত নই । দরজা খুলে দাও , ঢুকি।

বললাম , “ দরজা খুলাে না রঘুনাথ । ঝামেলা করলে লাঠির গুতাে মারাে । ”

তারাপদর পাশে দীপক , সেলিম , ব্রতীন আর গােপালের মুণ্ডু দেখা গেল । মুখগুলাে করুণ । দীপক বলল , “ আমরা ভূত নই রঘুনাথ ! পুঁটু , তুই একটু বুঝিয়ে বল না ওকে । ” বললুম , “ তােমরা যে ভুত নও , তার প্রমাণ ? ”

পাঁচ দুগুনে দশখানা হাত জানালার ভেতর গলিয়ে দিল ওরা । তারাপদ বলল , ‘ ছুঁয়ে দ্যাখ পুটু ! ভুতের হাত হলে ঠাণ্ডা হিম হবে । আমি ছুঁয়ে দেখার জন্য হাত বাড়িয়েছি , রঘুনাথ বলল , “ ছােবেন না দাদাবাবু । বরং আমি আগে পরীক্ষা করে দেখি । যদি ভূত না হয় , রাম রাম বলুক ওরা । ”

পাঁচটা মুখে করুণ সুরে উচ্চারিত হলাে , রাম রাম রাম রাম রাম । ”

রঘুনাথ এ ঘরের দরজা খুলে দিল । পাঁচজন হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসে পড়ল । সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে ওদের দেখতে দেখতে বললুম , “ ব্যাপারটা কিছু বােঝা যাচ্ছে না কিন্তু ! ”

তারাপদ বলল , “ আমরাও বুঝতে পারছি না পুটু ! একটু আগে আমরা পাঁচজনে একটা টেম্পাে ভাড়া করে চলে এলুম । এসে দেখি দরজা খোলা ।

কেউ কোথাও নেই । হ্যারিকেনটা জ্বেলে তাস আর ক্যারাম খেলতে খেলতে হঠাৎ শুনি হল্লা করে কারা তেড়ে আসছে । অমনি ভয় পেয়ে হ্যারিকেনটা নিভিয়ে আমরা পালিয়ে গেলুম । তারপর অতিকষ্টে গাছে চড়ে গা ঢাকা দিলুম । ”

দীপক বলল , “ ভাগ্যিস গাছের ওপর টর্চের আলাে ফেলেনি ওরা । ”

রঘুনাথ হাে হাে করে হেসে ফেলল । বলল , “ বুঝেছি , বুঝেছি । আপনাদের ঢুকতে দেখে ভূত পাঁচটা পালিয়ে গিয়েছিল । মানুষ যেমন ভূত দেখে ভয় পায় , ভূতেরাও মানুষ দেখে ভয় পায় । ”

তারাপদ বলল , “ পুটু কী হয়েছিল বল্ তাে ? তুই কখন এসেছিস ? ”

দীপক বলল , “ পুঁটুর ভিজে প্যান্ট – শার্ট দেখে আমার খটকা লেগেছিল কিন্তু । ”

বললুম , “ চা খেতে খেতে সব বলছি । রঘুনাথ , শীগগির চা করাে । ”

রঘুনাথ কেরােসিন কুকার ধরাল । তারপর বলল , “ আজ রাত্তিরে আর বাড়ি ফিরে কাজ নেই দাদাবাবুরা । চা করে খিচুড়ির ব্যবস্থা করছি । কী বলেন ? ”

আমরা সবাই একবাক্যে সায় দিলুম । . . . .

Related posts:

বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের জীবন কথা
পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী : 2024
চন্দ্রযান-3 : চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণকারী প্রথম দেশ ভারত
GENERAL STUDIES : TEST-2
GENERAL STUDIES : 1
কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স: 8ই সেপ্টেম্বর
'জ্ঞানচক্ষু' গল্পের নামকরণের সার্থকতা বিচার করো।
তপনের জীবনে তার ছোটো মাসির অবদান আলোচনা করো।
সমান্তরাল আলোকরশ্মিগুচ্ছ বলতে কী বোঝ ?
আলোকরশ্মিগুচ্ছ বলতে কী বোঝায় ? এটি কয়প্রকার ও কী কী ?
একটি সাদা কাগজকে কীভাবে তুমি অস্বচ্ছ অথবা ঈষৎ স্বচ্ছ মাধ্যমে পরিণত করবে ?
ঈষৎ স্বচ্ছ মাধ্যম কাকে বলে ? উদাহরণ দাও ।
অস্বচ্ছ মাধ্যম কাকে বলে ? উদাহরণ দাও ।
স্বচ্ছ মাধ্যম কাকে বলে ? উদাহরণ দাও ।
অপ্রভ বস্তুও কি আলোর উৎস হিসেবে কাজ করতে পারে?
বিন্দু আলোক - উৎস কীভাবে পাওয়া যেতে পারে ?
বিন্দু আলোক - উৎস ও বিস্তৃত আলোক - উৎস কী ?
অপ্রভ বস্তু কাকে বলে ? উদাহরণ দাও ।
স্বপ্নভ বস্তু কাকে বলে ? উদাহরণ দাও ।
দিনেরবেলা আমরা ঘরের ভিতর সবকিছু দেখতে পাই , কিন্তু রাত্রিবেলা আলোর অনুপস্থিতিতে কোনো জিনিসই দেখতে পা...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page