শীতটা কি একটু বেশী পরলো আজ? তিন দিন আগে কিনে আনা শীর্ষেন্দুর বই এর প্রায় মাঝামাঝি এসে রিফাতের মনে হলো, তার গায়ে রাখা লেপটা শীত মানছেনা। উপরে কি কাঁথাটা দিয়ে দেবে? যদিও নড়তে মন চাইছিলোনা একদম। মঙ্গলমারার হাওরে নতুন লাইনের কাজ চলছে তাই দুদিন ধরে ইলেক্ট্রিসিটিও নেই, মোবাইল চার্জ দেয়াটা যদিও কঠিন.., তবুও হ্যারিকেন জ্বেলে বই পড়তে মন্দ লাগছেনা,বরং তার কাছে মনে হলো প্রতি মাসে এভাবে দুচারদিন কারেন্ট না থাকা ভালো। কম্পিউটার চলবেনা, মোবাইল অফ থাকবে, টিভি চলবেনা, বেশ আয়োজন করে বই পড়া যাবে। ভাবতে ভালো লাগছিলো রিফাতের! বই এর ফাঁকে আঙুল, হ্যারিকেনের হলুদাভ আলো, শীত না মানা লেপ, হীম হীম আবেশ, পরিচিত একটা গন্ধ, সব ভালো লাগছিলো তার। ঘড়ির দিকে তাকালো রিফাত, ২:২০মিনিট… মফশ্বলের জন্য অনেক রাত। তার উপর ইলেক্ট্রিসিটি না থাকলে সন্ধ্যাতেই সব নিশুথী হয়ে যায়।লোকজন যেনো ভয় পায়। রিফাত বই পড়ায় মন দিলো। বই এর পৃষ্ঠাটা ওল্টাতেই নিচের দিকে লেখা নাম্বারে চোখ পড়লো তার। ৩৩৩… শয়তানের প্রিয় সংখ্যা। সংখ্যাটাতে আসলেই অশুভ একটা ব্যাপার আছে। সংখ্যাতত্ব নিয়ে লেখা কোনো বই কি পাওয়া যাবে? তার হঠাৎ করেই আগ্রহ জাগলো। রিফাত এ নিয়ে বেশীক্ষন ভাবার সময় পেলনা, খাটের বাঁ পাশের আলমিরার উপরে রাখা স্যুটকেসটা ধপাস করে মাটিতে পরে গেল।
যদিও এর কোনো কারন ছিলোনা, এটা একমাত্র তখুনি পরা সম্ভব যদি কেউ এটাকে ঠেলে ফেলে দেয়, তাছাড়া খুব ভারি জিনিসটা। তাহলে কি তিনশত তেত্রিশওয়ালা কেউ নিজেকে জানান দিতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল? চিন্তাটা মাথায় আসতেই হাসি পেলো রিফাতের। ভাবনাগুলো মাঝে মাঝে নিজের অজান্তেই রসালো হয়ে ধরা দেয়। তখন মনে হয় ভাবনাটা আসলে নিজের না,মাথার ভেতরে বসে আর কেউ ভাবছে। এমন কি আসলেই হতে পারে? ট্যালিপ্যাথি নিয়ে তো অনেকেই গবেষনা করেছেন,সফলও হয়েছেন অনেকে। কোন মাধ্যম ছাড়াই আরেকজনের চিন্তা চেতনায় চেপে বসা সম্ভব, এমনকি জড় পদার্থও।উইলফোর্স…ইচ্ছা শক্তি…। যা দিয়ে বিছানায় শুয়ে বন্ধ দরজা খুলে ফেলা যায়, শূন্যে ভেসে থাকা যায়। প্রখ্যাত ম্যাজিশিয়ান পি.সি. দাসের উইল ফোর্সের আশ্চর্য্য ক্ষমতা ছিলো।তিনি চোখের পলকে মানুষকে সম্মোহিত করতে পারতেন। রিফাত স্বীদ্ধান্ত নিল সম্মোহন বিদ্যা নিয়ে সে কিছু একটা পড়ে দেখবে। স্যুটকেসটা পরে ছিলো, একগাদা ভারি কাপড়ে ঠাসা এই দানবটাকে আবার উপরে রাখা একা সম্ভব না। তবে এটাকে এখান থেকে সরিয়ে রাখতে হবে। রিফাত অগত্যা উঠে দাঁড়ালো। একেই সম্ভবত শীতের কামড় বলে। মোটেও রোমান্টিক নয়। রিফাতের মনে হলো কেউ তাকে বিনা নোটিশে এন্টার্কটিকায় ফেলে দিয়েছে। দরজার ফাঁক দিয়ে ধোঁয়ার মতো কুয়াশা এসে ঢুকছে। হ্যারিকেনের আলোয় ভৌতিক লাগছিলো দৃশ্যটা।আমি ভুতে বিশ্বাস করিনা, ভুত ফুত হলো ফাউল ব্যাপার! বোগাস। স্বগতোক্তি করে নিজেকে শোনালো রিফাত। কেনো শোনালো নিজেই বুঝতে পারলোনা। তাহলে কি সে ভয় পাচ্ছে?দরজার নীচ থেকে ভেসে আসা কুয়াশার স্রোতে ভয় পাবার কি এলিমেন্ট থাকতে পারে? ব্যাপারটা তার কাছে ভুতের গল্পের মতোই রগরগে আর হাস্যকর মনে হলো। অথচ এই সস্তা সাবজেক্ট নিয়ে বিভুতিভুষন রবীন্দ্রনাথেরাও লিখে গেছেন। মানুষ তাই লিখে যা সে কিছুটা হলেও বিশ্বাস করে। ইশ্বরে বিশ্বাস করলে ভুতে অবিশ্বাস করার কিছু নেই। মুসলিম ধর্মমতে জ্বীনে বিশ্বাস না করলে ধর্মনষ্ট হয়। ধারনা করা হয় খারাপ প্রজাতির জ্বীনেরা ভুত সেজে মানুষকে ভয় দেখায়।
…হয়তোবা জ্বীনদের ভুত সাজতে হয়না, এরা আজন্ম ভুতহয়েই বেঁচে আছে। রিফাত তার কালো চাদরটা গায়ে জড়িয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো,যদিও এই শীতের কাছে নিতান্ত শিশু লাগছিলো চাদরটাকে। হাত দিয়ে হাতি আটকানোর মতো। টানা বারান্দা পেরিয়ে বাথরুমের পাশেই রান্নাঘর। হ্যারিকেনের আলোটা একটু বাড়িয়ে দিলো রিফাত। একগ্লাস জল খেয়ে ঢুকে পড়লো বাথরুমে, ঢুকেই মনে পড়লো ট্যাপে জল নেই। বালতিতে জল থাকার কথা, নইলে টিউবওয়েল চেপে দুনিয়া সজাগ করার মানে হয়না, এর চেয়ে টিস্যু দিয়ে কাজ সারাই ভালো। বালতি কাত করে এক বদনার মতো জল পেয়ে গেলো রিফাত,কিছুটা মুখ ধুবার জন্য মগে রেখে দিলো। আনমনে কমোডের উপর বসেছিলো রিফাত। হঠাৎ করেই মনে হলো,বাথরুমে বাইরে দরজার পাশেই কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে, রিফাত তার নিঃশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত ষ্পষ্ট শুনতে পেলো। মনের ভুল, নিজেকে বোঝালো সে, তবুও কেমন যেনো একটা ভ্রান্তি একটা ভয় এসে নিজের অজান্তে তাকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। রিফাত স্বীদ্ধান্ত নিলো ভোর হবার আগে সে বাথরুম থেকে বাইরে বেরুবেনা।
ব্যাপারটা সাংঘাতিক হাস্যকর এটা মাথায় আসতেই সে দরজার পাশে চলে এলো। এখনো আছে ওটা। ওপাশে কারো একটু নড়ে ওঠার শব্দ শুনতে পেলো রিফাত, ফোশ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলার শব্দও ভেসে এলো। যেনো কেউ অনেকক্ষণ আটকে রাখা দম ফেললো। সাতপাঁচ না ভেবে দরজার নব ঘুরালো সে, হ্যাচকা টানে খুলে ফেললো দরজা। …………….কেউ নেই। শীতের বাতাস উপেক্ষা করে সামনের বারান্দায় দৌঁড়ে এলো রিফাত….., রান্নাঘরের দিকে তাকাতেই দ্রুত একটা ছায়াকে যেনো দেয়ালের সাথে মিশে যেতে দেখলো। এই প্রথম রিফাতের সত্যিকারের ভয় লাগলো, তার মনে হলো অনেকগুলো মানুষ অথবা অন্যকিছু তারদিকে তাকিয়ে আছে। হ্যারিকেনটা শক্ত মুঠোয় ধরে পায়ে পায়ে বারান্দা পেরুলো রিফাত, বাবা মার ঘরের সামনে এসে একবার মনে হলো নক করে, কিন্তু কি বলবে ভেবে না পেয়ে নিজের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো সে। ঘরে ঢুকে বিছানার পাশে। হ্যারিকেনটা কেমন নিভু নিভু, তেল ফুরোচ্ছে সম্ভবত। চারদিক নিস্তব্দ। শুনশান নীরবতা আর নিভু নিভু আলোর আবছা অন্ধকারেই রিফাত দেখতে পেলো বিছানায় লেপের নিচে কে যেনো শুয়ে আছে। রিফাতের শরীর ঠান্ডা হয়ে গেলো। প্রায় নিভতে যাওয়া হ্যারিকেনটা তখনো ঝাপসা আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে, হারিকেনটা টেবিল থেকে নামিয়ে টেবিলের উপরে রাখতেই, লেপের নিচে গুটিশুটি জিনিসটা যেনো নড়ে উঠলো একটু। রিফাত নিজেকে প্রবোধ দিল, এটা কল্পনা। এসব প্রশ্রয় দেয়া মানে পাগলামি। ভ্রান্তি কাটানোর সবচেয়ে বড় পথ হলো ষ্পর্শ, রিফাত পায়ে পায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো। শরীর ভেসে যাচ্ছে ঘামে।
বুকের ভেতর কে যেনো ঢেঁকি দিয়ে ধানভানছে। গা করলোনা রিফাত,সাহসে ভর করে বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। হাত দিয়ে কাত করতেই….। দেখতে পেলো একটি বিভৎস মুখ,ঠিক মানুষের মতো নয়, তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ধপ করে নিভে গেলো হারিকেন শিখা। কেরোসিন পোড়া বিকট গন্ধে ভরে গেলো ঘর তার সাথে পঁচা মাংসের গন্ধ। এতো মানসিক চাপ রিফাতের আর সহ্য হলোনা, সে চিৎকার দিতে যাবে এসময় তার গলা চেপে ধরলো একটা লোমশ হাত। তিক্ষ্ণ নখর বসে গেলো গলার দুপাশে। তার চিৎকারের শব্দ মিশে গেলো শীতের রাতের কুয়াশা আর নিস্তব্দতায়,চার দেয়ালের বাঁধা অতিক্রম করতে পারলোনা। রিফাত অজ্ঞান হয়ে পড়ল বিছানায়।