তাকে প্রথম বার দেখি যখন আমার বয়স ৯বছর। সেই বয়সের অনেক স্মৃতিই মনে নেই, কিন্তু তাকে আমার স্পস্ট মনে আছে। হয়ত নিউরন কোষে স্থায়ী দাগ পড়ে গেছে ওই ভয়ঙ্কর স্মৃতিটার।
আমাদের তখনকার বাসাটা ছিল টিনের ঘর, আম কাঠালের বাগানের এক পাশে বাসা; আরেক পাশ দিয়ে সরু গলি চলে গেছে মহল্লার ভেতর দিয়ে মসজিদের দিকে। ঠিক আমাদের বাসার যে দিক দিয়ে গলি চলে গেছে, তার অপর পাশেই একটি কবর। আমি জন্ম থেকেই এই কবরটি দেখে আসছি। মানুষের মনে কবর বা কবরস্থান ভয়ের একটি অনুভুতির জন্ম দেয়, বিশেষ করে বাচ্চাদের মধ্যেতো আরো বেশি। বাবা-মা বা দাদা-দাদির কাছে ছোটবেলায় ভুতের গল্প কে না শুনে বড় হয়েছে! শিশু মনে তাই কবরস্থান, শ্বশান এগুলো অন্যরকম ভয়ের অনুভুতির জন্ম দেয়। কিন্তু এই কবরটি আমার মনে কোন ভয়ের অনুভুতি কখনোই তৈরি করে নি কেন জানি, হয়তো বা জন্মের পর থেকেই দেখে আসছি বলেই।
আমার ছেলেবেলায় আমাদের বাসায় কোন টিভি ছিল না। আমি টিভি দেখতে যেতাম আমার চাচার বাসায়। আমাদের পুরো মহল্লাতে তখন হাতে গোনা ৫টি বাড়িতে টিভি ছিল। কার্টুন হোক বা অন্যকোন অনুষ্ঠান সন্ধ্যার পরে সপ্তাহে মাত্র ২দিন দেখার অনুমতি পেতাম বাসা থেকে, তাও চাচার বাড়িতে গিয়ে শুধু, অন্য কোন বাড়িতে গিয়ে টিভি দেখা আমার বারন ছিল। চাচার বাড়ি যেতে হত সেই সরু গলি ধরে, কবরটির পাশ ঘেসে আম কাঠালের বাগানের শেষ মাথায়। তখন ক্লাস ৪ এ পড়ি, হাফ ইয়ারলি পরিক্ষা শেষ, স্কুল ছুটি। কোন এক সন্ধ্যার পর টিভি দেখে দেখে চাচার বাড়ি থেকে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলাম একা একা। সাধারণত রাত হয়ে গেলে হয় চাচার বাড়ি থেকে বড় কেও আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিত। সেদিন আর বাড়ি পৌঁছে দেয়ার মত কেও ছিল না। চাচী একবার জিজ্ঞাসা করলেন – একা বাড়ি যেতে পারবি না আমি পৌছে দেব? আমি বললাম পারব তুমি একটু দরজায় দাড়াও আমি এক দৌড় দিয়ে চলে যাই। চাচি দরজায় দাঁড়িয়ে রইলেন আমি বাসা থেকে বের হয়ে দৌড় দেয়ার বদলে হাটতে লাগলাম সরুগলি পধ ধরে। গলি পথের অর্ধেক দূরত্বে একটা বিশাল কাঠাল গাছ, এ কাঠাল গাছটির নাম ছিল কালী কাঠাল গাছ। বিশাল আকারের কালো কুচকুচে রঙ এর কাঠাল ধরত এ গাছে। এই গাছটি পর্যন্ত চাচীকে দেখা যাচ্ছিল, তার পর গাছ পার হয়ে আরেকটু সামনে বাড়তেই চাচার বাড়ির দরজা আড়াল হয়ে গেল। অন্ধকার রাত, তখন রাস্তায় এত লাইটপোস্ট ছিল না, সরু গলির শেষ মাথায় আমাদের বাসার ঠিক সামনে একটা আগেকার দিনের টিমটিমে লাল লাইট জ্বলছিল, আমাদের বাড়ি দেখা যাচ্ছিল। আর একটু সামনে এগিয়ে যেতেই একপাশে আমাদের শোয়ার ঘর আরেক পাশে কবর। হঠাত করেই কেন জানি গা ছমছম করতে লাগল, ফাঁকা গলি – কোথাও কেও নেই। তবুও গা ছমছম ভাব বাড়ছে; কেমন জানি অস্থির লাগতে লাগল। ঠিক কবরের সামনে পৌঁছে থমকে গেলাম, আমার হাত পা সব অবশ হয়ে আসতে লাগল। কবর থেকে কে যেন উঠে আসছে সাদা চাদর গাঁয়ে। ওদিকে চাইব না চাইব না করেও চোখ যেন আটকে গেল। দৌড় দেই দেই করেও পা যেন মাটিতে কেও পেরেক দিয়ে আটকে দিল। পা থেকে কোমর পর্যন্ত সাদা চাদর গাঁয়ে কে যেন বের হয়ে আসল, কোমরের ওপর থেকে চাদর বা অন্য কিছু নেই, কেমন জানি সাদা মেঘের মত বা কুয়াশার মত একটা অবয়ব কাঁধ পর্যন্ত, কাঁধের ওপর কোন মাথা নেই, কিচ্ছু নেই, একদম ফাঁকা। লাইট পোস্টের হালকা আলোতে ঠিক মত দেখা যাচ্ছে না তবুও যেন আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি, আমার মাথার ভেতর তার পুরোটা অবয়ব যেন গেঁথে যেতে লাগল। আমার মাথা পুরো ফাঁকা হয়ে গেল, কি যে এক অনুভুতি গ্রাস করে নিল আমি ঠিক বোঝাতে পরব না। মুখদিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না আমার, পা চলছে না, আমি স্থবির হয়ে গেলাম সেখানেই। আমি চোখ বন্ধ করে হাটু ভাঁজ করে কখন যে বসে পড়েছি বলতে পারব না। কতক্ষন কেটেছে তা মনে নেই, কি করেছি তা মনে নেই শুধু অন্যরকম অন্যভুবনের এক অজানা ভয় জুড়ে ছিল আমার পুরো অস্তিত্ব জুড়ে, মাথায় কোন অনুভুতিই কাজ করছিল না শুধু অবর্ণনীয় এক ভয়ের অনুভুতি ছাড়া। হঠাৎ করেই অনেক দূরে পেছন থেকে কার জানি গলা শুনতে পেলাম। মানুষের গলার শব্দ আস্তে আস্তে এগিয়ে আসতে লাগল আমার কাছাকাছি। একটু সাহস নিয়ে চোখ খুললাম, সামনে কাওকে দেখতে পেলাম না। পেছন থেকে নামাজীরা এশার নামাজ শেষ করে এ পথ ধরে ফিরছেন। তখনো আমি কোন কথা বলতে পারছি না। আমাকে এভাবে এখানে দেখে মহল্লার এক মুরুব্বী বললেন – খোকা এত রাতে এখানে বসে আছ কেন? আমার মুখে কোন কথা নেই। কাপছিলাম বোধ হয় তখন আমি কিংবা কাঁদছিলাম। আমাকে হাতে ধরে নিয়ে আসলেন ল্যাম্পপোস্টের তলায়। তখনো কোন কথা বলতে পারছি না। একটু পরে দেখি ওনাদের পেছন পেছন নামাজ থেকে দাদা ফিরলেন, আমাকে কোলে করে বাসায় নিয়ে আসলেন।
কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করার পর ওনাকে বললাম সব ঘটনা। উনি কিছুক্ষন চুপ করে থেকে শুধু বললেন, “দাদাভাই এইটা নিয়া আর কারো লগে কোন কিছু কইও না, একলা আর ওই কবরের পাশ দিয়া চলাফেরা কইর না। তুমি যা দেকছ তা ভুইলা যাওয়ার চেস্টা কইর – তয়, এইটা তোমার চোখের কোন ধান্ধা না। এইটা সত্য, তুমি তারে আবার দেখবা কোন না কোন সময়, হয়তো অন্য কোন বেশ ধইরা। তয় ডরাইও না। সে তোমার কোন ক্ষতি করব না।“
দাদার কথাগুলো আমার আজো মনে আছে, আমি আবার তাকে দেখেছি। মাঝে মাঝে এখনো তাকে অনুভব করি। সে আসে আমার কাছে, কি চায় তা জানি না, কেন আসে তা জানি না, তবে সে আসে; আর যখন আসে আমার পুরো অস্তিত্ব ওলোটপালট হয়ে যায় তখন। সে কথা অন্য কোন সময় অন্য কোন গল্পে বলব। তবে এটা কোন গল্প নয়, আমার জীবনের সত্যি ঘটনা।
ভয় – দ্বিতীয় পর্ব
এস এস সি পরীক্ষা দেয়ার পর থেকেই আমি যাযাবর জীবন কাটাতে লাগলাম। আজ এখানে তো কাল ওখানে। ভয়ের এই বিষয়টা মনের মাঝে গেঁথে ছিল তবুও মনের কোন গভীর অনুভুতিতে তাকেই যেন আবার পেতে চাইছিলাম। দেশের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত ঘুরে বেড়ানোর সেই শুরু আমার। এরই ফাঁকে ফাঁকে যেন বিভিন্ন জায়গায় খুঁজে বেড়াতাম সেই আধুরা দেখা অপার্থিব তাঁকে কিংবা সেরকম অন্যকিছু। রাতের পর রাত ঘুরে বেরিয়েছি শ্বশান ঘাটে, কিংবা বিভিন্ন জায়াগার কবরস্থানে। রাত কাটিয়েছি কত নাম না জানা পোড়াবাড়িতে। শুধু ভয়ের রূপটা আরেকবার দেখার জন্য। কোথাও কিছু পাইনি, কোথাও গিয়ে কোন অনুভুতি জাগে নি সে রাতের মত। কিছুটা শংকা কিংবা একটু ভয় ভয় অনুভুতি কোথাও কোথাও কাজ করেছে সত্যি কিন্তু সেই অনুভুতি আর কখনো পাইনি কিংবা সেরকম কাওকে কোথাও দেখি নি।
কিন্তু আমার ভূবন আবার ওলোটপালোট হয়ে গেল ঠিক ৯ বছর পর, যখন আমার বয়স ১৮বছর। এইস এস সি পরীক্ষা দিয়ে মজার সময় কাটাচ্ছিলাম। মে মাসের শেষের দিক, কাঠাল পাকা গরম। আমাদের মহল্লার সেই আগের অবস্থা আর নেই। ইট কাঠ পাথরের নগরীতে পরিণত হয়ে গেছে সবুজ এই মহল্লাখানি। মোটামুটি সব খালি মাঠ বা প্লটেই বিল্ডিং উঠে গেছে। আমার দাদা গত হয়েছেন প্রায় ৬ বছর হয়ে গেছে। তার লাগানো আম কাঠালের বাগিচাখানি এখন মহল্লার একমাত্র সবুজ উদ্যান। মহল্লার বখাটে ছেলেপেলের হাত থেকে বাগানের ফল ফলাদি রক্ষা করতে প্রায় রাতেই বাগান পাহারা দিতে হয়। বাগান ছেয়ে আছে নানা পদের রকম আম কাঠালে। আমাদের এই বাগানে প্রায় ১০/১২ প্রকারের আম গাছ ছিল, দুই ধরনের লিচু, কয়েক ধরনে কাঠাল এছাড়াও নান রকম দেশি ফল ফলাদিতে ভরপুর ছিল, তাই পাড়ার উঠতি বয়সের ছেলেদের অত্যাচারেরও শেষ ছিল না। যদিও ঠিক বাগানের পাশেই সেই কবরস্থান তবুও এখন আর আগের সেই ভয় কাজ করে না, বরং ইদানিং কেমন জানি মজা লাগে। বন্ধু বান্ধবের সাথে অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা মেরে বাড়ি ফেরার সময় প্রতিদিনই একবার করে বাগানে ঢু মেরে আসি, দেখতে যে বাগানে কেও ফল চুরি করার প্রয়াসে ঢুকেছে কি না। বাগানটি নতুন বাউন্ডারি দিয়ে ঘেরা হয়েছে। যদিও একটি গেট আছে তবে তা সাধারণত তালাই মারা থাকে। চাবি থাকে বাসায়, তাই আমি ওয়াল টপকে বাগানে ঢুকি আর ওয়াল টপকে বের হই পাহারা দেয়ার নামে, আসলে রাতে আমতলা ঢু মারি যে কোন পাকা আম পড়ে আছে কি না। প্রতিদিনই প্রায় ২/৪টা পাকা আম রাতের ডেজার্ট হিসেবে আমার পেটে যায়। খেয়ে বেশি হলে তা পকেটে ভরে বাসায় নিয়ে আসি। ঠিক বাগান ঘেসেই কালি কাঠাল গাছের পাশে নতুন ল্যম্পপোস্ট বসানো হয়েছে। টিমটিমে হলুদ লাইটের বদলে এখন লম্বা টিউব লাইট রাস্তায় ঠাই করে নিয়েছে। তারই আলোতে বাগান ভরে থাকে, পড়ে থাকা আম কুড়োতে কোন সমস্যা হয় না।
এমনই এক রাতে তাঁকে আবার দেখলাম। রাত প্রায় একটার দিকে বাগান থেকে বের হয়ে ওয়াল টপকে ল্যাম্পপোস্টের দিকে না নেমে নামলাম কবরস্থানের দিক দিয়ে। এই জায়গাটি দুই ল্যাম্পপোস্টের মাঝখানে পড়েছে, একটি আমাদের বাড়ির সামনের দিকের আরেকটি বাগানের দিকের। দুই ল্যাম্পপোস্টের থেকেই টিউবলাইটের আলো হালকা করে এখানে পড়ে। পথচলায় কোন অসুবিধা হয় না। সে রাতে যেই দেয়াল টপকে কবরের সামনে নামলাম তখনি জানি হঠাত করেই অজানা এক ভয়ে পেটের ভেতর গুলিয়ে উঠল। রাস্তার দুদিকেই তাকালাম, কোন জনমনুষ্যির চিহ্ন নাই কোথাও। চোখ আপনা থেকেই চলে গেল কবরের দিকে। কালো কাপড়ে আপাদমস্তক ঢাকা কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। লম্বায় প্রায় আমার দ্বিগুণ। আমি তার মুখ দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু অনুভব করছি সে যেন তীব্র চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে। বোধ বুদ্ধি সব গুলিয়ে গেল আমার। সে যে কি তীব্র ভয়ের অনুভুতি তা ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না। হাত পা সব জমে গেছে আমার, কালো কাপড়ে ঢাকা মূর্তি ধীরে ধীরে নড়ছে, মনে হচ্ছে যেন আমার দিকে এগিয়ে আসছে যেন। চোখ মুখ বন্ধ করে কোন মতে দৌড় দিলাম। এখনো ভেবে পাই না কিভাবে যেন দৌড়েছি সে রাতে। দৌড়তে দৌড়তে বাসা ছেড়ে কখন মেইন রোডে উঠে এসেছি খেয়াল নেই, যেন দিগ্বিদিক হয়ে দৌড়ূচ্ছি – কে যেন পিছু তাড়া করেছে আমায়। রাস্তার গাড়ির হর্নের শব্দে ঘোর কাটল আমার। ঘেমে ভিজে উঠেছি। দৌড়তে দৌড়তে ওয়ারলেস মোড়ে চলে এসেছি। সুরুচি রেস্তোরার কথা হয়তো অনেকেরই মনে আছে, সারা রাত খোলা থাকত এটি। আমি রেস্তোরায় বসে গ্লাসের পর গ্লাস পানি খেয়ে একটু সুস্থির হলাম। হাত পা কাঁপছে তখনো আমার। কিছুক্ষণ বসে চা খেলাম, পর পর ৩/৪টি সিগারেট শেষ করলাম, তারপর ধীর পায়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম। ঘটনা এখানে শেষ হলে আর কিছু বালার ছিল না – নিছক ভয়ের একটি অভিজ্ঞতার গল্প হতে পারত একটি। এই ঘটনাটি বা আগের ঘটনাটি আসলে মনের ভুল, হালকা আলো আঁধারিতে চোখের ধান্ধা। ভয় নামক যে অপার্থিব অনুভুতি থাকে, হালকা আলোছায়ায় তারই চাক্ষুষ একটি ইলুশন কিংবা হেলুসিনেশন। আমার জন্য খুবই ভালো হত এমন কিছু হলে বা ভাবতে পারলে।
আমার জন্য বাস্তব ক্ষেত্রটা আসলে এমন নয়। বরং সম্পূর্ণ অন্যরকম। সেটা একটু বর্ণনা করি। আমার আগের লেখায় নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে আমার দাদার কথা। উনি আমাকে কিন্তু বলে গিয়েছিলেন আমি তাঁকে আবার দেখব। ওনার সেই কথাগুলোর সেখানেই শেষ নয়, আরো অনেক কিছুই আমাকে বলেছিলেন – ওনার বলা পরের অংশটুকু “সে” গল্পে আর করা হয় নি।
ভুত প্রেত বলে কিছু নেই পৃথিবীতে, কিন্তু জ্বীন নামক আল্লাহ তায়ালার আরেক স্মৃস্টির কথা বলা আছে পাক কোরআনে। কিছু কিছু মানুষ এই নাকি জ্বীন নামক এই প্রজাতিকে নিয়ে কাজ করেন, তাদের বশ মানানোর চেস্টা করেন। আমার দাদার বাবা ছিলেন তাঁদেরই একজন। ওনার সাথে নাকি ছিল এমন ই এক জ্বীন এর যোগাযোগ যিনি দাদার কথা শুনতেন। আমি এ সম্পর্কে একদমই অজ্ঞ। এখানে অনেক জ্ঞানীগুনি আছেন যারা এ সম্পর্কে ভালো বলতে পারবেন। দাদার কথায় আসছি, উনি শুধু আমাকে বলে গেছেন – বংশ পরম্পরায় এই জ্বীন আমাদের কারো না কারো দিকে নজর রাখবে, কেও না কেও ওনাকে অনুভব করতে পারবে। সেটা আমি কি না আজো জানি না।
সেই দ্বিতীয় বারের পরে আমি তাঁকে আর দেখি নি চোখাচোখি, কিন্তু এখনো প্রায় প্রতি বছর দুই থেকে তিন বার আমি তাঁকে অনুভব করি – আমার কল্পনায় নয়, বরং বাস্তবে। যখনই তাঁকে অনুভব করি বুঝি কে যেন তীব্র চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে, এর কোন সময় নেই, কোন রাত বা দুপুর নেই। কোন কারণ ছাড়াই তীব্র এক ভয় আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে হাঠাত হঠাতই – কখনো দিনে, কখনো রাতে, কখনো মধ্যরাতে বা সকাল বেলায় ঘুম ভাঙ্গে জড় উপড়ে ফেলা তীব্র ভয় নিয়ে – কে যেন এক ভয়ংকর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, শুধু অনুভব করি সেই তীব্র ভয়ধরানো দৃস্টি।
ভর দুপুর বেলায় আলসে সময় কাটাচ্ছি বই পড়ে, চা খাচ্ছি সাথে। হঠাত করেই যেন কেমন অনুভব করি কে যেন তাকিয়ে আছে আমার দিকে। অচেনা এক ভয় গ্রাস করে আমার পুরো অস্তিত্ব, হাত পা অবশ হয়ে যায়, ঘেমে ভিজে উঠি মাঘমাসের শীতের মাঝেও। ২/৩ মিনিট থাকে এই অনুভুতি, আবার আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যায় – যেন কোথাও কেও নেই। আমি বই পড়ছি একলা ঘরে, সামনে চায়ের পেয়ালা ঠান্ডা হয়।
রাতে ঘুমোতে যাচ্ছি, ওয়াশরুমে ঢুকলাম। তীব্র ভয়ে হাঠাত করেই জমে গেলাম, কে জানি তাকিয়ে আছে আমার দিকে কি এক তীব্র দৃস্টিতে। ভয়ের চোটে বাথরুমের মেঝেতেই বসে পড়ি কুকরে। ঘেমে অস্থির হয়ে যাই অজানা এক ভয়ে। ৩/৪ মিনিট পর আর কোন কিছু অনুভব করি না মনের মাঝে, অবশ হাত পা আস্তে আস্তে নরমাল হয়ে আসে। আমি যথারিতি ব্রাশ করি, হাত মুখ ধুই, বাইরে বের হয়ে আসি ফ্রেশ হয়ে।
ডরমিকাম খেয়ে ঘুমাতে গেছি গভীর রাতে, এ ঘুম কোন ভাবেই ৪ঘন্টার আগে ভাঙ্গার কথা না। হঠাত করেই ঘুমের মাঝে তীব্র নাম না জানা এক ভয়ের অনুভুতি কাজ করতে থাকে, আমার অস্তিত্ব নাড়িয়ে দিয়ে আমাকে অসহায় করে তোলে। হাত পা কুঁকড়ে কাঁথার ভেতর বা লেপের ভেতর ঢুকে যেতে চাই আপনা আপনি যেভাবে থাকে মায়ের পেটের ভেতর সন্তানেরা। কাঁথার ভেতর ঘেমে ভিজে যাচ্ছি, কে যেন তীব্র চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে – অনুভব, সে অনুভব যেন ঢুকে আছে আমার প্রতিটা ডি এন এ অনুকোষে। আমি তাঁকে চিনি খুব ভালো রূপে। ৩/৪ মিনিট পার হয়, দৃস্টিটা আর অনুভব করি না। শরীর হালকা হয়ে আসে, বিছানা থেকে নামি, লাইট জ্বালাই। ঘড়িতে সময় দেখি – ঘুমাতে গিয়েছি এখনো ১ঘন্টাও হয় নি, কখনো বা ৩০ মিনিট মাত্র, কখনো ভয় ভাঙ্গলে দেখি সকাল হচ্ছে, সূর্য কিরণ তেরছা ভাবে পড়ছে বিছানার ওপর।
দ্বিতীয় বার তাঁকে দেখার আজ পর্যন্ত তাঁকে আর দেখি নি, তারও ৪ বছর পর পর্যন্ত তার অস্তিত্বের কোন কিছুই অনুভব করি নি। কিন্তু ৪ বছর পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় প্রতিবছর দুই থেকে তিন বার এই তীব্র ভয়ের এক অনুভুতির ভেতর দিয়ে আমাকে পার করতে হয় কিছু সময়। লৌকিক ব্যাখ্যা হয়ত এর কিছু আছে, হেলুসিনেশন, স্কিসোফোনিয়া বা অন্য কোন নাম। আমি নিজে একজন যৌক্তিক মানুষ – যুক্তি খুঁজেছি এর। ডঃ এর সাথে পরামর্শও করেছি। মানসিক ডঃ অনেক ভাবে অনেক টেস্ট করেছেন। কিছু খুঁজে পাননি আমার নিউরণ কোষে কিংবা অন্য কোথাও। এখন আর এর কোন ব্যাখ্যা খুঁজি না কোথাও। থাক না কিছু অলৌকিক ঘটনা আমাদের জীবনে।
মানুষ কি পেরেছে তার অনুভুতিগুলোকে জয় করতে নাকি তার মন বাঁধা পড়ে আছে অনুভুতিগুলোর ভেতরে? মহান কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ এর লেখা হিমুর গল্পগুলোর কথা মনে পড়ে। মাহামানব গড়ার কারিগর হিমুর বাবা কি পেরেছিলেন ট্রেনিং দিয়ে হিমুকে অনুভুতিশুন্য করে গড়ে তুলতে? যদি পারতেনই তবে কেন বার বার হিমুর মন বাঁধা পড়ে বিভিন্ন অনুভুতির ফাঁদে? আসলে মানুষ তার বিবেক বুদ্ধি আর অনুভুতির মাঝেই বেড়ে ওঠে। জোর করে মন থেকে মানবীয় অনুভুতিগুলোকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে অনুভুতিহীন হওয়া যায় না।