ভূতের গল্প : ফেব্রুয়ারি মাসের ১১ তারিখ

আজকে আপনাদের যেই ঘটনাটির কথা বলবো সেটি যখন ঘটেছিলো তখন আমি ক্লাস টেনে পড়ি। কিছুদিন পরেই মেট্রিক পরীক্ষা। তাই অনেক রাত জেগে পরতাম। আমি আবার দিনের বেলা পড়তে পাড়ি না। তাই আম্মু আমার জন্য চা বানিয়ে রাখতেন যেনও আমি রাতে খেতে পারি। যাই হোক, সেদিন ছিল ফেব্রুয়ারি মাসের ১১ তারিখ। বরাবরের মতই সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর আমি পড়া শুরু করলাম। ২ দিন পরে স্যারের বাসায় একটা মডেল টেস্ট পরীক্ষা। তাই, ঠিক করেছিলাম পড়া একদম শেষ করে ঘুমাব। তার জন্য দরকার হয় ভোর পর্যন্ত পড়বো। তখন আনুমানিক রাত ৩ টা। পড়তে পড়তে মাথা কেমন যেনও ভারী ভারী ঠেকছিল। তাই ভাবলাম একটু রেস্ট নিয়ে নেই। আমার বারান্দায় একটা ইজি চেয়ার পাতা আছে। আমি বিকেলে অনেকটা সময় সেখানে কাটাই। বাবা আমার পছন্দের কথা মনে করেই চেয়ারটি বারান্দায় বসিয়েছিলেন। যাই হোক, আমি বারান্দায় গিয়ে ইজি চেয়ারে বসলাম। পড়ার মধ্যে বিরতি নিলে আমি সাধারণত চোখ বন্ধ করে এতক্ষণ যা যা পড়েছি তা মাথার মধ্যে একবার রিভিশন দেয়ার চেষ্টা করি। বরাবরের মতই আমি ইজি চেয়ারে শুয়ে মাথার মধ্যে তখনের পড়াগুলো নিয়ে ভাবছিলাম। এমন করে প্রায় মিনিট ৫-৭ যাবার পর হটাত একটা আওয়াজে আমি চমকে চোখ মেলে তাকাই। বলা বাহুল্য, আমরা ক্যান্টনমেন্টে আর্মিদের জন্য যেই কোয়ার্টার গুলো আছে সেখানে থাকতাম। চোর ডাকাতের কোনও বালাই ছিল না। আর গার্ড যিনি ছিলেন তিনি থাকতেন একদম গেটের সামনের ঢোকার পথে। সিকিউরিটি সিস্টেম অনেক হাই ছিল। যাই হোক, আমি চমকে চোখ মেলে তাকিয়ে এদিক সেদিক দেখলাম। কিছুই চোখে পড়লো না। অথচ আমি স্পষ্ট একটা শব্দ পেয়েছি। শব্দটা কিসের ছিল জানি না। তবে অনেকটা কোমল গলায় কাউকে ডাকলে যেমন আওয়াজ হয় তেমন আওয়াজ। আমাদের বাড়ির আসে পাশেই কোথাও হয়েছে। আমরা ২ তালায় থাকতাম, তাই বারান্দা থেকে উকি দিলে নিচের দিকটা স্পষ্ট দেখা যেত। আমি প্রথমে ভাবলাম বারান্দার দরজা আটকে দিয়ে রুমে চলে যাই। কিন্তু পরক্ষনেই মনের মধ্যে কেমন যেনও একটা খুঁতখুঁতানি চলতে লাগলো। কিসের আওয়াজ ছিল সেটা? যদি কেউ আমার নাম ধরে ডাক দেয় তাহলে এতো গভীর রাতে কেন আসবে? মাথায় কিছুই ঢুকছিল না। বারান্দার দরজা আটকে দিয়ে রুমে ঢুকলাম। ভাবলাম পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে ভুলে যাবো। কিতু ১০ মিনিটের মত শুধু শুধুই বই নিয়ে বসে থাকলাম। মাথার মধ্যে চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। অবশেষে ঠিক করলাম আবার যাবো বারান্দায়। সাহস করে দরজা খুলে বারান্দায় দাঁড়ালাম। আসে পাশে আবারো ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। নাহ, কেউ নেই। ধীরে ধীরে গিয়ে বসে পড়লাম ইজি চেয়ারটায়। অন্যান্য দিন যখন বসি তখন মনটা খুব শান্ত হয়ে যায়। আজকে হল উল্টো। ইজি চেয়ারে বসার সাথে সাথে কেমন যেনও কেঁপে উঠলাম। আমি ইজি চেয়ার ছেড়ে রুমে গিয়েছি প্রায় মিনিট দশেক হবে। এখনও ঢাকা শহরে শীত ভালোই আছে। যেই সময়ের ব্যবধানে আমি চেয়ারে আবার ফিরে এসেছি, তাতে চেয়ারটা ঠাণ্ডা হয়ে যাবার কথা। কিন্তু, চেয়ারে বসা মাত্রই অনুভব করলাম সেটা অনেক গরম। যেনও এই মাত্র কেউ চেয়ারটা থেকে উঠে দাঁড়ালো। বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ড ধক ধক করে হাতুরির মত পিটাচ্ছিল। চোখ বন্ধ করে আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগলাম। তখন অনেক ছোট ছিলাম, কিন্তু তারপরও বলতে গেলে আমার বয়সী অন্য যে কোনও মেয়ের চেয়ে আমার সাহস বেশি ছিল। এমনভাবে প্রায় মিনিট দুয়েক কাটল। হটাত আমাকে চমকে দিয়ে কে যেনও আমার নাম ধরে ডেকে উঠলো। ভয়ে শরীরের পশমগুলো দাঁড়িয়ে গেছে। এবার আমি স্পষ্ট শুনতে পেয়েছি। অনেকটা বাতাসে ভর করে যেনও আসছিলো কথাগুলো। “মিম”, “মিম” “দেখো”, এমন বিক্ষিপ্ত কয়েকটা শব্দ। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে চোখ মেললাম। এবারো কিছু চোখে পড়লো না। তাকালাম বাইরের দিকে। আসে পাশের বেশিরভাগ বাসায় আলো নিভানো। শুধু দূরে এফ ব্লকে একটা বাড়িতে আলো জ্বলছে। হটাত মনে সন্দেহ হল, আওয়াজটা নিচ থেকে আসছে না তো? আমাদের বারান্দায় কোনও গ্রিল লাগানো ছিল না। তাই ইচ্ছে করলেই ঝুঁকে নিছতা দেখা যেত। আমি সাহস করে, আল্লাহর নাম নিয়ে বুকে ফুঁ দিয়ে বারান্দার ওয়ালে ঝুঁকে নিচে উঁকি দিলাম।

নিচে কলিংবেল লাগানো, তাই রাতে সুবিধা হবে ভেবে একটা লাইট সবসময় জ্বালানো থাকে। সেই আলো মেইন গেটের সেখান থেকে শুরু হয়ে গেটের সামনের অনেকটুকু রাস্তা পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। সেই আলোয় আমি যা দেখলাম তা জীবনেও ভুলার মত নয়।
আমি উঁকি দিয়েই দেখলাম নিচে কে যেনও ঠিক আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। যেনও জানত আমি এই মুহূর্তে উঁকি দিবো। ঐ জিনিসটা এমন জায়গায় দাঁড়ানো ছিল যে গেটের আলোটা প্রায় তার মুখের উপর এসে পড়েছে। ওর মুখটা দেখে ভয়ে কেঁপে উঠলাম।
ছেলে না মেয়ে তা পরিষ্কার করে বোঝা যাচ্ছিল না। আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো, এরপর আমার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিল। আমি ভয়ে জ্ঞান হারানোর মত অবস্থা। চিৎকার করতে চাচ্ছি, কিন্তু মুখ দিয়ে কোনও আওয়াজ বের হচ্ছে না। এবার দেখলাম সেই আকৃতিটি আস্তে আস্তে হাওয়ায় ভেসে আমার দিকে আসতে লাগলো। আমি পাগলের মত চেষ্টা করছি চিৎকার দেয়ার জন্য কিন্তু পারছি না। দৌড়ে যে ভেতরে চলে যাবো তারও উপায় নেই।

জিনিসটা প্রায় আমার সামনে চলে এসেছে। আমার থেকে তার দূরত্ব আনুমানিক ৩-৪ হাতের মত হবে। শেষবারের মত একবার চেষ্টা করলাম চিৎকার দেয়ার জন্য। হটাত কোয়ার্টারের পাশের মসজিদ থেকে আজানের শব্দ ভেসে এলো। সাথে সাথে দেখলাম আকৃতিটা আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। হেঁটে যাচ্ছে না, অনেকটা ঘুড়ি যেমন উড়ে তেমনি করে। যতদূর পর্যন্ত আলো যায় ততদুর পর্যন্ত দেখতে পারলাম। শেষ মুহূর্তে একবার আমার দিকে ঐটা মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। স্পষ্ট দেখতে পেলাম অন্ধকারে সবুজ রঙ্গের আলো বের হচ্ছে ঐটার চোখ দিয়ে।

পরদিন যখন আমি চোখ মেলি তখন আমাকে নিজের রুমে দেখতে পাই। খাটে শোয়ানো। মাথার উপর ফ্যানটা তুমুল স্পীডে ঘুরছে। উঠার চেষ্টা করলাম। কিন্তু শরীরে শক্তি পেলাম না উঠার মত। গলা দিয়ে চিৎকার করে মাকে ডাকার চেষ্টা করলাম। কেমন যেনও গড়গড় আওয়াজ বের হল। ভাগ্য ভালো, মা পাশেই ছিল। দৌড়ে এসে হাজির। রান্না করছিলো মনে হয়। আমাকে দেখেই মাথায় হাত রাখল।

মা আমাকে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে? আমি খুবই দুর্বল অনুভব করছিলাম। মাকে বললাম পরে বলবো। আগে বল, আমি ঘরে এলাম কিভাবে।

পরে মা বলল, সকালে নামাজের জন্য উঠার পর আমাকে রুমে না পেয়ে তিনি বারান্দায় যান। সেখানে গিয়ে দেখেন আমি ইজি চেয়ারের পাশে মেঝেতে পড়ে আছি।

মা আরো জানান, আমাদের বাসায় একটা বিড়াল পালতাম আমরা, সেই বিড়ালটাকে নাকি আজকে সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে উপর তালার আঙ্কেল বাজার থেকে আসার পথে বিড়ালটিকে বাসার পাশের ঝোপের মধ্যে মৃত দেখতে পান। কে যেনও সেটাকে মেরে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলে রেখেছে। নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে গেছে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, বিড়ালটার গায়ে এক ফোঁটাও রক্ত ছিল না। যেনও কেউ চুষে বিড়ালটার দেহের সব রক্ত শেষ করে ফেলেছে।

এই ঘটনাটি আমার জীবনটাকে এলোমেলো করে দেয়। একটানা ১৫দিন ভয়াবহ জ্বরে আক্রান্ত ছিলাম আমি। এক পর্যায়ে ডাক্তাররা বলছিলেন হয়তো এ বছর পরীক্ষা দিতে পারবো না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আল্লাহর ইচ্ছায় আমি সুস্থ হয়ে উঠি এবং সে বছরই পরীক্ষা দেই।

জানি অনেকেই বলবেন হালুসিনেসন অনেকেই বলবেন পড়ার প্রেসার ছিল তাই উল্টা পাল্টা দেখেছি। কিন্তু আমি জানি আমি যা দেখেছিলাম সত্যই দেখেছি।

ঘটনাটি ঘটেছিলো ৫ বছর আগে। কিন্তু আজ লিখতে গিয়েও বারবার ফিরে যাচ্ছিলাম সেই রাত্রিতে।

Related posts:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page