বেশ কয়েক বছর আগে বর্ষাকালে বর্ধমান জেলার বলগনার কাছে এক গ্রামে গিয়েছিলাম । উপলক্ষ ছিল বিয়েবাড়ি । বন্ধুর বােনের বিয়ে । এত দূর বলে কেউই যেতে রাজি হয়নি । রাজি না হওয়ার কারণও ছিল । একে বর্ষাকাল , তায় যাতায়াতের অসুবিধে । যে সময়কার কথা বলছি , তখন এত উন্নতমানের রাস্তাঘাট , বা যানবাহনের সুবিধে হয়নি । তার ওপরে গ্রামে বিয়েবাড়িতে লােকজনের আধিক্যের জন্য থাকারও অসুবিধে হতে পারে । তাই অনেকেই যাব স্থির করেও যেতে রাজি হন না শেষ পর্যন্ত । কিন্তু একেবারেই কেউ না গেলে তাে খারাপ দেখায় , তাই আমি আর বলাই নামে আমাদের এক বন্ধু চললাম নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে ।
সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই এলাম হাওড়া স্টেশনে । সেখান থেকে লােকাল ট্রেনে বর্ধমান । বর্ধমানে সর্বমঙ্গলা মন্দির দর্শন করে একটা হােটেলে খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে দুপুরের বাসে বলগনা । বলগনায় বাস থেকে নেমে যে গ্রামে আমরা যাব , সেই গ্রামের দূরত্ব হচ্ছে সাত মাইল । এ পথে যাতায়াতের জন্য একমাত্র গােরুর গাড়িই ভরসা । তাও আগে থেকে বলে রাখলে তবেই । নয়তাে আচমকা গিয়ে পাওয়া যায় না । এ তাে রিকশা নয় যে , ভাড়া খাটার জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে ।
যাই হােক , আমরা যখন বলগনার মােড়ে বাস থেকে নামলাম তখন বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যে হয় হয় । আকাশ ঘন মেঘে ঢাকা । মেঘের মূর্তি এমনই যে , এই নামে বুঝি ! তাই কী যে করব কিছু ভেবে পেলাম না ।
বলাই বলল , “ এখনও ভেবে দ্যাখ যাবি কি না , আকাশের যা অবস্থা তাতে আমার মনে হয় আর না এগিয়ে এইখান থেকেই কেটে পড়ি চল । এই অচেনা জায়গায় পথে কোনও লােকজন নেই । সন্ধ্যে হয়ে আসছে । কাদার পথ । আর এগােলে দুর্ভোগের শেষ থাকবে না ।
কথাটা ঠিক । তবে কিনা সত্যি – সত্যিই কি এতদূর এসে দুর্যোগের ভয়ে ফিরে যাওয়া যায় ? তাই বললাম , “ তাতে কী ? বর্ষাকালে বৃষ্টি হবেই । সব জেনেই তাে ঘর থেকে বেরিয়েছি । এখন ভয়ে পিছােলে কী হবে ? অতএব আর দেরি না করে রওনা দিই চল ।’
চল তাে চল । একটা দোকানে শেষবারের মতাে দু কাপ চা খেয়ে চলা শুরু করলাম । আগের বৃষ্টির কাদা এখনও শুকোয় নি । তার ওপর আকাশে এই মেঘের ঘনঘটা । কী যে কপালে আছে কে জানে ?
আমরা নিজেদের মধ্যেই কথা বলতে-বলতে পথচলা শুরু করলাম । লােকালয় ছেড়ে যখন আমরা মাঠের মাঝখানে এসেছি , তখনই শুরু হল বৃষ্টিপাত । প্রথমে বড় – বড় ফোঁটা । তারপরই মুষলধারায় । ছাতা মানল না । সেই দারুণ বৃষ্টিতে স্নান করে গেলাম দুজনে ।
বলাই বলল , “ আমরা বােধ হয় দুমাইল পথও আসিনি । এখনও কত পথ বাকি । কী করে যাব রে ভাই ? ” আমি তখন চুপসে গেছি । বললাম , “ তাই তাে রে ! বলগনাতেও বলে কয়ে কারও বাড়িতে থেকে গেলেই হত । এখন তাে দেখছি আর এগনােই যাচ্ছে না । ” তা শুধু যে বৃষ্টি তা নয় । সেই সঙ্গে কড়কড় করে বাজ পড়ার শব্দ । সন্ধ্যার ঘন অন্ধকার এবং মেঘের কালিমায় এক হাত দূরের পথও দেখা যাচ্ছে না । কালাে কুটিল যাকে বলে , তাই । পথে এমন কোনও জন মানুষ নেই , যার কাছে একটু আশ্রয় প্রার্থনা করি , বা পথনির্দেশ পাই । সে যে কী বিপজ্জনক পরিস্থিতি , তা বলে বােঝানাে যাবে না ।
এইভাবে জলে – কাদায় টালমাটাল হতে হতে কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ একসময় মনে হল আমাদের পেছু পেছু কেউ যেন আসছে । কে আসে ? এই অন্ধকার নির্জন রাতে কে ও ? কেমন এক অশরীরী আতকে বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল । আমরা দুজনেই ভয় পেয়ে থমকে দাঁড়ালাম ।
অমনই শুনতে পেলাম , “ এ – পথে নতুন মনে হচ্ছে ।” আমি বললাম , “ হ্যাঁ , একেবারেই নতুন । ”
“ আসা হচ্ছে কোথা থেকে ? ”
“ আমরা কলকাতা থেকে আসছি । ”
“ যাওয়া হবে কোথায় ?”
আমরা গ্রামের নাম বললাম ।
বলার সঙ্গে – কঙ্গেই একটি বজ্রপাত । আর সেই সঙ্গে বিদ্যুতের চমক । তারই ক্ষণপ্রভায় মুহূর্তের জন্য দেখলাম লােকটিকে । কালাে বর্ষাতিতে ঢাকা দীর্ঘ উন্নত বলিষ্ট চেহারা । গায়ের রং এত কালাে যে , ছাতার কাপড়কে হার মানায় । ভদ্রলােক বললেন , “ ওরে বাবা ! ও তাে অনেক দূর । এই দুর্যোগে যাবেন কী করে ? ”
“ লগনসার বাজার ! বিয়েবাড়ি বুঝি ? ”
“ আজ্ঞে হ্যা । আমাদের বন্ধুর বােনের বিয়ে । ‘ তা ওঁরা একটা গোরুর গাড়ির ব্যবস্থা করে রাখেননি কেন ? ”
“ সে দোষ ওঁদের নয় । আসলে আমাদেরই আসবার কোন ঠিক ছিল না । ”
“ এই ভাবে রাতদুপুরে গ্রামে – ঘরে কেউ আসে ? বিয়েটা কবে ? ”
“ আগামীকাল । ”
“ হু । তা হলে কাল ভােরে গেলেও চলবে ।”
“ কিন্তু আজকের রাত্রিটা কাটাই কোথায় বলুন তাে ? ”
“ ব্যবস্থা একটা করছি । এখন , আসুন তাে আমার সঙ্গে ।”
আমি বলাইয়ের দিকে তাকালাম । বলাই আমার দিকে । যা আছে কপালে । আর যখন এগােনাে সম্ভব নয় , তখন এঁর আশ্রয় কিছুতেই ছাড়া নয় ।
আমরা সেই ভদ্রলােকের পেছু – পেছু এক বিশাল বটগাছের নীচে এসে দাঁড়ালাম । তারপর বাঁধা রাস্তায় ঢালু বেয়ে ছােট্ট একটি গ্রাম । মাটির দেওয়াল , খড়ের চাল , ঘন বসতির গ্রাম । গােয়ালে গােরুর চোখ জ্বলছে । বৃষ্টিও সমানে চলছে । ভদ্রলােক একটি মেটে ঘরের দরজা খুলে আমাদের ঢুকতে বললেন । তারপর বললেন , “ একটু বসুন । এখনই আলাের ব্যবস্থা হচ্ছে ।”
আমরা ভিজে পােশাকেই কাদা মাখা পা নিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকলাম । তারপর অন্ধকারে হাতড়ে একটি তক্তাপােশ পেয়ে তাতে পা ঝুলিয়ে বসলাম । কিন্তু ভদ্রলােক সেই যে গেলেন , আর আসার নাম নেই ।
অনেক পরে ক্ষীণ একটু আলাে দেখা গেল । মনে হল লণ্ঠন দুলিয়ে কেউ আসছে । সত্যিই তাই । টাক মাথায় বেঁটেখাটো একজন গ্রামের লোক এক বালতি জল , একটি গামছা আর হ্যারিকেন নিয়ে ঘরে ঢুকল । লােকটি বলল , ‘ নিন , পা ধুয়ে ভাল করে বসুন । বাবু এখনি আসবেন । ” বলেই চলে গেল লােকটি ।
ঘরের সামনে দাওয়া ছিল । আমরা সেখানে পা ধুয়ে কিট – ব্যাগ থেকে শুকনাে জামাকাপড় বের করে নিলাম । তারপর আলােটা একটা টেবিলের ওপর রেখে তক্তপােশের বিছানায় বসলাম গুছিয়ে । এই ভয়ঙ্কর দুর্যোগের রাতে এমন একটি আশ্রয় প্রত্যাশারও বাইরে ।
অনেক পরে ভদ্রলােক এলেন । সঙ্গে সেই লােকটি । হাতে বাটিভর্তি মুড়ি আর গরম তেলেভাজা । লােকটির হাতে চা ।
ভদ্রলােক বললেন , “ আপনাদের অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম ভাই , কিছু মনে করবেন না । আসলে ঘরে কেরােসিন একফোটাও ছিল না । জোগাড় করতে দেরি হয়ে গেল । ”
বলাই বলল , “ কিন্তু এই দুর্যোগে গরম তেলেভাজা পেলেন কোথায় ? ”
“ কেন ঘরেই ভাজা হল । কুমড়াে , পােস্ত আর বেসন বর্ষাকালে গ্রামের মানুষদের ঘরে সব সময়ই মজুত থাকে । যাক , জুড়িয়ে যাওয়ার আগে খেয়ে নিন ।”
আমরা বিনা বাক্যব্যয়ে খেতে লাগলাম ।
ভদ্রলােক বললেন , “ আশা করি আমার এই ঘরে রাত কাটাতে আপনাদের কোনও অসুবিধে হবে না । কাল খুব ভােরে বৃষ্টি থামুক আর না থামুক , আপনাদের রওনা করিয়ে দেব । আমার কাছের লােক এই জনাই গােরুর গাড়িতে করে এগিয়ে দেবে আপনাদের ।’
আমি বললাম , “ তা হলে তাে খুব ভাল হয় । ”
কথা বলতে বলতেই ভদ্রলােকের মুখের দিকে তাকালাম আমরা । এমন মিষ্টি কথার লােক অথচ চেহারা দেখলে মনে হয় কী রাশভারী । বুকের ভেতরটা যেন ছ্যাঁত করে ওঠে ।
ভদ্রলােক বললেন , বৃষ্টি কমলে আজ রাত্রেই পাঠাতাম আপনাদের , তবে কি এসব – জায়গা তাে ভাল নয় , তাই কাল ভােরেই যাবেন । ”
আমি বললাম , “ ভােরে যাওয়াই ভাল । কেননা আমার আবার ভূতের ভয় খুব । এই গ্রামে অন্ধকার রাতে পথের মাঝখানে যদি কেউ দেখা দেন , তা হলেই তাে গেছি । ”
ভদ্রলােক হেসে বললেন , “ আপনি ভূত বিশ্বাস করেন ? আমিও করি । আগে করতাম । এখন করি । আর এইজন্য তাে পথে – ঘাটে যাতে কারাে পাল্লায় না পড়েন তাই টেনে আনলাম এখানে । ”
বলাই বলল , “ ঠিকই করেছেন ! ওই যে আপনি বললেন আগে ভূত বিশ্বাস করতেন , এখন করেন , এর মানেটা কী ? সেরকম কোনও অভিজ্ঞতা কী আপনার হয়েছিল ?”
ভদ্রলােক একষ্টু চুপ করে রইলেন । তারপর বললেন , ‘হয়েছিল বইকী ! আমার জীবনে ভূত দেখার অভিজ্ঞতা যা ঘটেছে তা শুনলে ভয় পেয়ে যাবেন ।”
আমি বললাম , “ তবু শুনিই না ? এই বর্ষার রাতে তেলেভাজার সঙ্গে ভূতের গল্প ভালই জমবে ।”
ভদ্রলােক আমাদের দুজনের দিকেই একবার ভাল করে তাকিয়ে বললেন , “ ওই যে দেওয়ালে ছবিটা ঝুলছে ওই ছবিটা কার বলুন দেখি ? ”
এতক্ষণ লক্ষ্য করিনি । এবার ভাল করে তাকিয়ে দেখে বললাম , “ একজন দারােগার । ”
“ ওই দারােগার সঙ্গে আমার চেহারা মেলে ? ”
দুজনেই বিস্ময় প্রকাশ করে বললাম , ‘ আরে ! তাই তাে ! এই তাে আপনারই ছবি দেখছি । ”
“ হ্যা , আমারই ছবি । তবে যৌবনের । ”
আমরা দুজনে ভদ্রলােকের মুখের দিকে চেয়ে রইলাম চমকপ্রদ কিছু শােনার আশায় ।
ভদ্রলােক বলতে শুরু করলেন । তিনি যা বললেন তা এই রকমঃ
‘ আমার নাম জলধর দত্ত । জলভরা মেঘের মতনই চেহারা আমার । আমায় দেখলে অনেক আসামিরও বুকের রক্ত জল হয়ে যেত । কাল ভােরে যে গ্রামের দিকে রওনা হবেন আপনারা অনেকদিন আগে সেই গ্রামের একটি ঘটনার কথা আপনাদের বলব ।
‘ আমি তখন এই অঞ্চলে নতুন এসেছি । একদিন সন্ধ্যেবেলা থানায় বসে প্রবীণ ভদ্রলােকের সঙ্গে গল্প করছি , এমন সময় দু ’ জন লােক এসে খবর দিল ওদের গ্রামে বিষয় – সম্পত্তির ব্যাপার নিয়ে দু ’ ভাই নাকি নিজেদের মধ্যে মারামারি করে অবশেষে দুজনেই আত্মঘাতী হয়েছে ।
“ শুনেই মেজাজটা গেল খারাপ হয়ে । এই ধরনের কেস এলে কোনও পুলিশ অফিসারই শান্তিরক্ষার দায় এড়াতে পারেন না । আদৌ এটা আত্মহত্যা না কেউ খুন করে সাজাচ্ছে তাই – বা কে বলতে পারে ? অতএব যেতেই হল ।
এইভাবে রাতদুপুরে যাওয়ার ব্যাপারে প্রবীণ ভদ্রলােক আমাকে অনেক বাধা দিলেন । বললেন , ‘ গেলে কাল সকালে যাবেন , এই রাত – দুপুরে কখনও না । একে এই সমস্ত অঞ্চল ভাল নয় , তার ওপর আপনি পুলিশের লােক । কার মনে কী আছে কে জানে ?’
“ আমি তাঁর কথা না শুনেই রওনা দিলাম । বললাম , পুলিশের লােকের প্রাণের ভয় থাকলে কি চাকরি করা চলে ? তা ছাড়া আমার নাম জলধর । জলভরা মেঘ আমি । কেউ কিছু করতে এলে ভাসিয়ে দেব তাকে । এই বলে আমার কনস্টেবল জনাকে নিয়ে ওদেরই গােরুর গাড়িতে চেপে রওনা হলাম ওদের সঙ্গে ।
“ তখন গ্রীষ্মকাল । তাই পথযাত্রায় কোনও অসুবিধে হল না ।
‘ যাই হােক , গ্রামে পৌঁছতে রাত অনেক হয়ে গেল । গিয়ে দেখলাম ছেলেমেয়ে । বৃদ্ধ – বৃদ্ধার একটি দল একটি ঘরের সামনে ভিড় করে আছে ।
“ আমি গিয়ে ঘরের শিকল খুলে ভেতরে তাকিয়েই শিউরে উঠলাম । রক্তমাখা দুটো দেহ ঘরের ভেতর গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে । লােক দুটোকে আমার খুবই চেনা বলে মনে হল । কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলাম না কোথায় এদের দেখেছি । যাই হােক , এই ধরনের লাশকে তাে পােস্টমর্টেম করতেই হবে , তাই গ্রামবাসীদের সাহায্য নিয়ে লাশ দুটোকে নামিয়ে আর একটি গােরুর গাড়িতে চাপিয়ে আবার ফিরে আসার প্রস্তুতি নিলাম । ওদের পরিবারের দুজন লােককেও সঙ্গে নিলাম লাশের পাহারায় ।
“ ফিরে আসছি আর বারবার মনে করবার চেষ্টা করছি কোথায় যেন দেখেছি লােক দুটোকে ।
“ এমন সময় জনা বলল , আমি কিন্তু চিনেছি বাবু । আমার খুব ভয় করছে এই রাত দুপুরে না এলেই পারতেন !’
“ আমি বিস্মিত হয়ে বললাম , তুই চিনেছিস ? এরা কারা ?”
“ ভুলে যাচ্ছেন কেন ? সন্ধ্যেবেলা এরাই তাে আমাদের থানা থেকে ডেকে আনল । “ এইবার মনে পড়েছে । সত্যিই তাে ! কিন্তু এমন বিস্মরণ আমার কেন হল ? আমার মতন লােকেরও শিরদাঁড়ায় তখন ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল একটা । লােক দুটোকে গােরুর গাড়ি থেকে নামার পর আর তাে দেখিনি !
“আমাদের এই চাপা কথাবার্তা গাড়ােয়ানের কানে গেল কিনা কে জানে ? হঠাৎ গাড়ির গতি থেমে গেল । ”
“ বললাম , কী হল ! থামলে কেন , চালাও ? ”
“ একটু চার তেষ্টা পেয়েছে বাবু । গলাটা একটু ভিজিয়ে নিই । ”
“ এখানে চা কোথায় পাবে ? এই ফাকা মাঠে এত রাতে ? ”
“ এখানেই তাে চা পাব বাবু । ওই দেখুন । ”
“ চেয়ে দেখলাম , দূরের একটা চালাঘরে টিমটিম করে আলাে জ্বলছে । গাড়ােয়ান পেছনের গাড়ির লােক দুজনকে ডেকে নিয়ে চা খেতে গেল । যাওয়ার আগে বলল , ‘ আপনারা খাবেন নাকি বাবু ?’
“ বললাম না । তােমরাই খাও । আর একটু তাড়াতাড়ি করাে । ”
ওরা চলে গেল । পরক্ষণেই যা দেখলাম তা সত্যিই ভয় পাওয়ার মতন । দেখলাম পেছনের গােরুর গাড়ির থেকে সেই লাশ দুটো দড়ির বাঁধন খুলে দিব্যি উঠে ওদের সঙ্গে চা খেতে চলে গেল । সে গাড়িতে কোনও গাড়ােয়ান ছিল না । এই গাড়ির সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল সেটা । সে যাই হােক , ভয়ে আমাদের অন্তরাত্মা খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড় হল । তখন আমরা সবিস্ময়ে ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম , সেই দুজনই । দিব্যি হেসে হেসে গল্প করতে করতে চা খাচ্ছে । এই দৃশ্য দেখার পর আর গােরুর গাড়িতে থাকা নয় । আমি ইশারায় জনাকে নামতে বলে নিজেও নামলাম । তারপর ওদের নজর এড়িয়ে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চললাম মাঠের ওপর দিয়ে । একটু পরেই দেখি গােরুর গাড়ি দুটোও লরির গতিতে ছুটে আসছে আমাদের দিকে । গােরু দুটোর চোখ জ্বলছে । কী ভয়ঙ্কর দৃশ্য । ”
জলধরবাবু তাঁর গল্প এই পর্যন্ত বলেছেন এমন সময় জনা এল । ভাতের থালা হাতে । বলল , “ ওসব গল্প আর নয় । এখন খেয়ে নিন দেখি । নিয়ে শুয়ে পড়ুন তাড়াতাড়ি ! কাল খুব ভােরে উঠতে হবে । ”
বৃষ্টি তখন থেমে গেছে ।
আমরা জলধরবাবুকে বললাম , ‘তারপর !’
জলধরবাবু বললেন , “ তারপর আর কী ? নিন , খেয়ে নিন । ওই গল্প কাউকে বললে জনাটা খুব ভয় পায় ।
গল্প শুনে ভয় আমাদেরও যে পায়নি , তা নয় । তবু কৌতূহল হচ্ছিল । যাইহােক , আমরা চটপট খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লাম ।
জলধরবাবু বললেন , “ আপনাদের ভয়ের কোনও কারণ নেই । জনা আপনাদের পাহারায় থাকবে । কোনও প্রয়ােজন হলে ডাকবেন । বাইরেটায় থাকবে ও । ”
আমরা শুয়ে পড়লাম এবং সারাদিনের ক্লান্তির জেরে ঘুমিয়ে পড়লাম ।
পরদিন খুব ভােরে অন্ধকার থাকতেই জনা এসে ডেকে তুলল আমাদের । জলধরবাবুও এলেন । আমরা তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জনার গােরুর গাড়িতে চেপে রওনা হলাম গন্তব্যস্থলের দিকে ।
ভােরের আলাে যখন আরও স্পষ্ট হয়ে আসছে তখনই একটা গাছতলায় গাড়ি থামিয়ে জনা বলল , “ এটুকু পথ এবার আপনাদের হেঁটেই যেতে হবে বাবু । ওই দেখা যাচ্ছে গ্রাম । এই গ্রামে আমি আর যাব না । ”
কেন যাবে না তা জানি । আসলে ওই গ্রামের সেই অভিশপ্ত রাতকে আজও ভুলতে পারছে না ও ।
আমরা দুজনেই গাড়ি থেকে নেমে বললাম , “ বেশ তাে , অসুবিধে থাকে যেয়াে না । এটুকু পথ হেঁটেই চলে যাবাে আমরা , কিন্তু সে – রাতে শেষপর্যন্ত কী যে হল , সেটুকু জানার দরকার ছিল যে ? ”
জনা বলল , “ শুনলে ভয় পাবেন না তাে ? ”
“ না কাল রাতে জলধরবাবুর মুখে অত কিছু শুনেও কি ভয় পেলাম ?”
“ সে – রাতে আমরা ওদের হাতেই প্রাণ হারিয়েছিলাম । ” আমাদের দুজনের গায়েই কাঁটা দিয়ে উঠল এবার । সর্বনাশ ! এ কী শুনছি ? জলধরবাবু , জনা , এরা তা হলে কারা ? আমরা নড়াচড়া ভুলে দাঁড়িয়ে রইলাম তাই । আমাদের বিস্ময়ের ঘাের কাটল যখন , তখন জনাও নেই , গােরুর গাড়িরও চিহ্ন নেই । ভাগ্যিস , একটু একটু করে দিনের আলাে ফুটে উঠেছিল তখন ! না হলে এই অন্ধকার গাছতলায় কী যে হত , কে জানে ? এর পর আমরা নিরাপদেই গ্রামে পৌঁছলাম এবং বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে যােগ দিলাম ওদের অনুষ্ঠানে । বন্ধু তাে বেজায় খুশি আমাদের পেয়ে । তবে গত রাতের ওই চরম অভিজ্ঞতার কথা আমরা ভুলেও বলিনি ওদের ।