রাতের কালো বিড়াল ভূত আছে কি নেই,এ নিয়ে বির্তকের কোনো শেষ নেই। সন্ধ্যাবেলার পার্ক থেকে নাড়ু দার চায়ের দোকান ,– ভূতেদের অতীত, ভবিষৎ নিয়ে তুমুল স্বরগরম। আমি অবশ্য ভূতে বিশ্বাসী নই। স্কুল লাইফে অনেকবার ভূত দেখার চেষ্টাও করেছি,কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। তবে একটা ঘটনা আমার সমস্ত বিশ্বাস কে তছনছ করে দিয়েছিল। ঘটনাটি ঘটে ছিল প্রায় সাত বছর আগে। এক শীতের সকালে বারান্দায় চেয়ার পেতে রোদ পোহাচ্ছিলাম। খবরের কাগজের এক একটা পাতা ওল্টাচ্ছি আর চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি।হঠাৎ ঘরের ভেতর ফোনটা বেজে উঠল। চায়ের কাপে শেষ চুমুক টা দিয়ে,উঠে পড়লাম। ঘরে গিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম, সমীরের ফোন। সমীর আমার কলেজের বন্ধু। এক সাথে তিনবছর, একই ক্লাসে পড়াশুনা করেছি। এই এক বছর হল রেলে চাকরী পেয়েছে সমীর। ঝাড়খন্ডের চক্রধরপুর পোস্টিং। ফোনটা রিসিভ করে বললাম, – কেমন আছিস বল?
– এই চলছে, মোটামুটি। তোরা আমার এখানে আয় না বেড়াতে একবার। সমীর ফোনের ওপার থেকে রিপ্লাই করল। বড় দিনের এক সপ্তাহ ছুটি। প্রস্তাব টা বেশ মন্দ নয়! একটা ছোটো খাটো ভ্রমন ও হয়ে যাবে। দীপু আর সোমু কে ব্যাপার টা জানাতেই , -ওরা এক কথায় রাজী। কিছু না হোক অনেকদিন পর চার বন্ধু তো এক জায়গায় হওয়া যাবে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, দীপু আর সোমু ও আমার কলেজ ফ্রেন্ড। দুজনই স্কুল মাস্টার। তবে একজন হাই স্কুল,আর অন্যজন প্রাইমারী। একটা ভাল দিন দেখে, সমীর কে জানিয়ে দিলাম যে আমরা তিন জন রওনা হচ্ছি। যথা সময়ে ব্যাগ-পওর গুছিয়ে হাওড়া স্টেশনে এসে হাজির হলাম। সকাল ছটা পঞ্চান্নর ইস্পাত এক্সপ্রেস। এই প্রথম বার আমি বাংলার বাইরে যাচ্ছি,তাই মনের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা হচ্ছে। উলুবেড়িয়া ছেড়ে যখন ট্রেন টা বেরোলো তখন চার পাশের বাড়িঘর আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। চারিদিকে বড় বড় ফাঁকা মাঠ। খড়গপুর পার হতেই বাড়িঘর আরও কমে আসতে লাগল। দুপাশের ইউক্যালিপটাসের জঙ্গল, কোথাও বা শালের জঙ্গল কে পেছনে ফেলে আমাদের ট্রেন ছুটে চলেছে। জানালার পাশে বসে একদৃষ্টে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। বেশ কিছুক্ষন পর দু দিকেই দেখতে পেলাম সবুজ গাছে ঢাকা পাহাড়। মনের ভেতর যেন কেমন একটা অ্যাডভেঞ্চার তৈরী হচ্ছে। সত্যি! কলকাতার বাইরেও অনেক কিছু দেখার আছে! টাটানগরে এসে হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম এগারোটা বাজে। চক্রধরপুর পৌঁছোতে এখনো এক ঘন্টা বাকি। চক্রধরপুর স্টেশনে সমীর আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল। দুপুর বারোটা বেজে পাঁচ মিনিটে ট্রেন চক্রধরপুর স্টেশনে এসে থামলো।প্লার্টফর্মে নেমে চারিদিক টা
একবার দেখলাম। খুব একটা বড় স্টেশন নয়। ফাঁকা ফাঁকা প্লাটফর্ম। বেশ কয়েকটা মালগাড়ি বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে। অনেক আর.পি.এফ কে দেখতে পেলাম। আমাদের দেখতেই সমীর ছুটে এল। অনেক দিন পর দেখা হলে যা হয় আর কি! নানান ধরনের কথাবার্তা। প্রাথমিক আলাপ সেরে আমরা চারজন প্লাটফর্ম থেকে নেমে স্টেশন রোডে উঠলাম। সমীরের থাকার কোয়ার্টার বেশী দুরে নয়। হেঁটে মিনিট পনেরো হবে। চারজন গল্প করতে করতে হাঁটতে লাগলাম। চক্রধরপুর জায়গাটার ভৌগলিক কিম্বা,হিস্টোরি ক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড আমার জানা নেই। তবে জায়গাটার পরিচিতি একটাই কারনে বোধহয়, – দক্ষিন পূর্ব রেলের একটা ডিভিশনের হেড অফিস এখানে রয়েছে এবং অল ইন্ডিয়া রেলের একটা ট্রেনিং সেন্টার ও এখানে অবস্থিত। দুপাশে বড় বড় গাছের রাস্তার মাঝের কালো পিচের ধরে সমীরের কোয়ার্টের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।কোয়ার্টারের সামনে যেতেই আমাদের তিনজনের চোখ দাঁড়িয়ে গেল। মনে হল সামনেই সবুজ মাঠ টা পেরোলেই জঙ্গলে ঢাকা পাহাড় দাঁড়িয়ে। এতকাছ থেকে পাহাড় দেখে আমার চোখের পলক পড়া বন্ধ হয়ে গেল। সমীর হেসে বলল,–
যতটা কাছে ভাবছিস, ঠিক তত কাছে নয়। একটু দূরে আছে পাহাড় টা। সমীর খাবারের ব্যবস্থা করতে গেল। দুপুরের খাওয়া-দাওয়া করে আমরা একটু বিশ্রাম নিলাম। ট্রেনের ধকল তো আর কম নয়! ঘটনাটা ঘটল সন্ধ্যাবেলায়। চারজন খাটের উপর বসে একসাথে গল্প করছি। শীতকাল, তাই বাইরে টা তাড়াতাড়ি অন্ধকার হয়ে এল। ঘড়িতে ছটা বাজে। সমীর উঠে তাড়াতাড়ি বাইরের গেট, জানালা – দরজা সব বন্ধ করে দিতে লাগল। সোমু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,– কি রে! এত তাড়াতাড়ি সব বন্ধ করে দিচ্ছিস? সমীর কোনো কথা বলল না। আমি ওর মুখের উপর একটা ভয়ের ছাপ পরিষ্কার লক্ষ্য করলাম। মানুষজনের বসবাস এখানে খুবই কম। যারা আছে সবাই রেলের কর্মচারী। বাইরেটা যেন কেমন নি:ঝুম হয়ে গেল এক মুহুর্তে। মনে হল চার জন যেন মনুষ্যজগত ছাড়িয়ে এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মধ্যে বসে আছি। নানা কথাবার্তা, হাসি ঠাট্টা চলছিল আমাদের মধ্যে। হঠাৎ সেই কথাবার্তা থামিয়ে একটা বিশ্রী শব্দ এল আমাদের কানে। শব্দ টা আমার পেছনে জানালার বাইরের ঝোপের মধ্যে থেকে আসছে সম্ভবত। একটা বিড়ালের বিকট ডাক,– ম্যাওওও! ম্যাওওওও! চারজনের কথাবার্তা থেমে গেল। নিস্তব্দ চারিদিক। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক ও পর্যন্ত নেই। সেই নিস্তব্দতা ভেদ করে
আবার শোনা গেল সেই বিকট শব্দটা,– ম্যাওওওও! ম্যাওওওও! সমীরের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ,এই শীতের সন্ধ্যায় ওর কপালে ঘাম জমতে শুরু করেছে। বুঝতে পারলাম ও একটা ভয় পাচ্ছে। আমি উঠে জানালা খুলে দেখতে যাব কিন্তু সমীর আমাকে চেপে ধরে । আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,– কোথায় ডাকছে দেখতে দে! – না দেখতে হবে না। ওটা বিড়ালের ডাক নয়,ভূতের ডাক। বলল সমীর। আমরা তিনজন অবাক হয়ে বললাম, – ভূত! দীপু হো হো হো করে হেসে উঠল। বলল,– সমীর, তুই তো আগে এত ভীতু ছিলিস না! এই জনমানুষ শূন্য জায়গায় এসে কি ভীতু হয়ে গেলি? সমীর কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,– না রে! ভাই, এখানে মানুষ নিজে চোখে দেখেছে,ওটা বিড়াল নয়,একটা ভূত। আমি বেশ মজা করেই বললাম,– অনেক বাঙালি ভূত দেখার চেষ্টা করেছি, কিন্তু দেখা পাইনি। তোর সৌভাগ্যে যদি এবার ঝাড়খন্ডের হিন্দিওয়ালি ভূতের
দেখা পাই,তাহলে ইচ্ছে টা পূরন হয়ে যায়। আমার কথা শুনে সোমু আর দীপু একসাথে হো হো করে উঠল। রাত্রে আর বিশেষ কিছু ঘটনা ঘটল না। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখলাম,সামনের সবুজ পাহাড় টিকে কুয়াশা পুরো ঘিরে রেখেছে। রাতের সেই ভয় টা আর নেই। বিকেল বেলা সমীর কে নিয়ে ঘুরতে বেরোলাম। শুধু অলিগলি রাস্তা আর তার দুপাশে লাল রঙের রেল কোয়ার্টার। বড় পিচ রাস্তাটার পাশে একটা বড় খেলার মাঠ আর তার এক প্রান্তে দোতালা স্কুল। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটত এগিয়ে যেতে লাগলাম চারজন। একটু পর রাস্তা টা এবড়ো খেবড়ো হয়ে এল। এদিকটাতে রেলের কোয়ার্টারের সংখ্যা খুব কম। কিছুটা এগিয়ে যেতেই একটা পোড়ো দোতলা বাড়ি দেখতে পেলাম। বুঝতে পারলাম একসময় রেলের কোয়ার্টার ছিল কিন্তু ব্যাবহার না হতে হতে বাড়িটিতে গাছ পালায় ভরে গেছে। এরকম একটা বাড়ি দেখে, আমার মনে আবার ভূত দেখার বাসনা জেগে উঠল।– এই বাড়িতে এক রাত কাটাতে হবেই! কথা টা বলতেই, সমীর থমকে গিয়ে পেছনে হাঁটা ধরল। আমরা তিনজনে ধরে ফেললাম। কোনো কথা শুনতে চাইল না সমীর। তারপর অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে রাজী করানো গেল।সন্ধ্যা বেলা হোটেল থেকে রুটি আর মাংস আনা হল। রাত নটা বাজতেই শীতের ড্রেস পরে, সমস্ত সরঞ্জাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের কাছে দুটো টর্চ আছে। পোড়ো বাড়িটার গেট খোলাই ছিল।গেটের দুধারে আগাছায় ঢাকা পাঁচিল,এক দিকের কিছুটা ইট খসে পড়েছে। একটু ঠেলতেই, ক্যাঁচচচচ…শব্দ করে আরও খুলে গেল। সোমু আর দীপু টর্চ মেরে দুপাশে দেখল,সাপ খোপ কিছু আছে কিনা! সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে নিজেদের পায়ের শব্দ গুলো যেন বার বার প্রতিধ্বনিত হয়ে আমাদের কাছে ফিরে আসতে লাগল। বুকের ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা গুড় গুড় করছে। দোতলায় দুটো ঘর। প্রথম ঘরটা ধাক্কা মেরেও খোলা গেল না। দ্বিতীয় ঘর টা খোলাই ছিল,তাই সেই ঘরেই চার জন ঢুকে পড়লাম। টর্চ লাইট জ্বালিয়ে, মাকড়শার জাল গুলো পরিষ্কার করে, মেঝেতে বিছানা করলাম। দীপু ব্যাগ থেকে দুটো মোমবাতি বের করে ধরালো। সারাটা ঘর বেশ
আলো হয়ে গেল। আমাদের প্লান ছিল খাওয়া দাওয়া সেরে, তাসের প্রতিটা ইভেন্ট খেলতে খেলতে সারাটা রাত কাটিয়ে দেওয়া। প্লান মাফিক খাওয়া দাওয়া সেরে, তাস খেলা শুরু করে দিলাম। বাইরে টা শশ্মানের মতো নিস্তব্দ। এতটাই নিস্তব্দ যে আমরা নিজেদের নিশ্বাস- প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলাম। ঘড়িতে বারোটা বাজতে মিনিট দশেক বাকি। হঠাৎ আমার চোখটা আধ খোলা দরজা দিয়ে বারান্দায় যেতেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল। লাল টকটকে দুটো চোখ জ্বল জ্বল করছে। ওরা তিনজন সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে তাকাল। সমীরের পা কাঁপছে। দীপু আস্তে আস্তে টর্চ টা নিয়ে বারান্দায় মারতেই দেখতে পেলাম,– একটা কালো বিড়াল আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা স্বস্তি পেলাম যেন! আমি হাত তুলে হ্যাট হ্যাট করতেই বিড়াল টা ভয়ে ম্যাওওও ম্যাওওও শব্দ করে ছুটে চলে গেল। সোমু, সমীরের দিকে তাকিয়ে রেগে বলল,– এই তোর ভূত? সমীর কোনো উত্তর দিল না। কিন্তু ওর মুখের ভাব দেখে বুঝতে পারলাম, আর এক মুহুর্ত ও এখানে থাকতে চায়না। আবার খেলা শুরু করলাম। বেশ কিছুক্ষন কাটলো। জমে উঠেছে তাস খেলা। অনেকদিন পর আবার চার বন্ধু মিলে তাসের আড্ডা হচ্ছে। হঠাৎ জিনিষ টা লক্ষ্য করলাম আমি। দেখলাম, দেওয়ালের বড় ছিদ্র দিয়ে ,পাশের ঘর থেকে একটা আলোর রশ্মি আমাদের মুখে এসে পড়ছে। আর সেই সাথে একটা গোঁ গোঁ শব্দ কানে এল। আমরা চারজনই মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে
লাগলাম। চারজনই উঠে পড়লাম। ব্যাপার টা কি! পাশের ঘর তো বন্ধ ছিল। আলো এলো কোথা থেকে। আমরা তাস রেখে উঠে গিয়ে একসাথে ছিদ্র দিয়ে পাশের ঘরে চোখ রাখলাম। আর চোখ রাখতেই আমার শিরা দিয়ে একটা ঠান্ডা হিমস্রোত নীচের দিকে নেমে গেল। দীপু আমার কাঁধের কাছে খামচে ধরেছে। হাত পা গুলো প্রত্যেকের থর থর করে কাঁপছে। পাশের ঘরে সেই কালো বিড়াল টা দু পায়ে ভর করে দাঁড়িয়ে উঠেছে। একটু একটু করে শরীর টা লম্বা হতে শুরু করেছে। গায়ের কালো কালো লোম গুলো আরও বড় হচ্ছে। আমাদের চারজনের গলা শুকিয়ে আসতে লাগল। গায়ের লোম গুলো ভয়ে সজারুর কাঁটার মতো হয়ে গেছে। দেখতে দেখতে বিড়ালটি মানুষের মতো হয়ে গেল। উফ! কি বিভৎস দৃশ্য! সামনের দাঁত দুটো বড় হয়ে সামনে বেরিয়ে এসছে। এখানে আর এক মুহুর্ত নয়! চারজন ছিটকে বারান্দায় বেরিয়ে এলাম। বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে নেমে ছুটে গেলাম গেটের কাছে। কিন্তু গেট বন্ধ।কে গেট বন্ধ করল? চারজন একসাথে ধাক্কা দিতে লাগলাম। চিৎকার করতে গিয়ে গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরুলো না। পিছন থেকে সেই ভারী পায়ের শব্দ টা সিঁড়ি ভেঙে নীচে নামতে লাগল। দিশেহারা হয়ে সর্বশক্তি দিয়ে গেট ঠেলতে
লাগলাম। শব্দটা আরও কাছে এসে পড়েছে। গেট ছেড়ে চারজন পাশের ভাঙা পাঁচিলের উপর দিয়ে,কাঁটা ঝোপ ঝাড় ভেঙে লাফিয়ে পড়লাম রাস্তার উপরে। তারপর একটা লম্বা ছুট। ঘুম ভাঙতে দেখি,আমরা সমীরের কোয়ার্টারের বাইরে গেটের কাছে পড়ে আছি। চারি পাশে পাঁচ ছজন লোক ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। জানিনা! সেদিন সেই অশরীরীর হাত থেকে কিভাবে বেঁচে গিয়েছিলাম! এরপর আর দেরী করিনি, বিকেলের ট্রেনে চেপে আমরা সোজা কলকাতা চলে এলাম। এর বেশ কিছুমাস পর, সমীর ও ট্রান্সফার নিয়ে, সাঁতরাগাছি চলে এল।