জীবনে কত অবাক করা ব্যাপার দেখলাম । সরাসরি ভূত কখনও দেখলাম না । তােমরা নিশ্চয় জান যে , ভূতের গল্প মানেই হল আমি দেখিনি । তবে একজনই বলেছিলেন . . . .
আমি তেমন গল্পই শােনাব । যাঁরা দেখেছিলেন , তাদের কাছেই শােনা । যেমনটি শুনেছি তেমন বলাই ঠিক হবে । তাঁরা দুটো গল্প বলেছিলেন , দুটোই বলব । একটা তাে ভীষণ ভয়ের । তবে সেটা যে কোন্টা , তা তােমাদের ওপরেই ছেড়ে দিচ্ছি ।
১৯৫৭ – ৫৮ সালে আমি দক্ষিণ কলকাতার একটা স্কুলে এক বছর পড়াই । সেখানে আমার অনেক বন্ধু হয়েছিল । কয়েকজন বন্ধুর ছিল বেড়াবার নেশা । প্রতি বছর পূজো আর বড়দিনের ছুটিতে ওরা চার – পাঁচ জন দল বেঁধে বেড়াতে যেত ।
সেবারে নতুন বছরে স্কুল খুলতে দেখি ওরা বেশ চুপচাপ । বেড়ানাের গল্পও করে না , ছবিও দেখায় না । বেড়াবার কথা তুললেই এ ওর পানে চায় আর চুপ করে যায় ।
রীতিমত রহস্য যাকে বলে । অবশেষে সন্ধ্যেবেলা আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর বাড়িতে গেলাম । না , ছাড়ব না । এবারে কী দেখে এসেছ তা বলতেই হবে ।
বলল , বটে । তবে ওর জবানীতেই শােন । সেটাই ঠিক হবে ।
আমরা কোথায় কোথায় যাব ভেবে শেষ অবধি বিহারের একটা নামকরা জায়গায় গেলাম ।
গিয়েই ধাক্কা খেলাম । ওই প্রচণ্ড শীতে ওখানে লােকজন আসে কম । যারা আসে তারা দূরে থাকে । সেখানে গরম জলের ঝর্ণায় স্নান করে । সেখানে চটি , ধর্মশালা , বাজার সবই আছে ।
আমরা উঠলাম পর্যটন বিভাগের গেস্ট হাউসে । মস্ত দোতলা বাড়ি । একেবারে খালি । চারজনে একটা ঘরে আছি । চৌকিদারটা বলে গেল , এসেছেন তাে , ঘুরবেন ফিরবেন সাবধানে । অন্তত সামনের নদীটার ওপারে যে আমবাগান আর ভাঙা মন্দির , সেখানে সরকারি নােটিশ আছে , দেখেও নেবেন , আর সূর্য ডুবলে ওদিকে যাবেন না ।
— চোর ডাকাতের ভয় আছে ?
— না মাতাজী ।
— জীবজন্তুর ভয় ?
— চোর ডাকাতের বা জীবজন্তুর নয় ।
— তবে কিসের ভয় ?
— আপনাদের খাবার ঘরে পৌঁছে দেব তাে ?
লােকটা কিছু বলতে চাইল না । তাতেই তাে আমাদের ভয় বেড়ে গেল । ঘুটঘুটে রাত , দোতালার সব ঘর বন্ধ , শুধু আমরা কয়েকজন !
খেয়ে – দেয়ে ঘুম তাে আসে না । তখন আমরা গল্প শুরু করলাম । গল্প করে রাত কাটাব । যত গল্পই করি , কেমন করে যেন ভয়ের গল্পই এসে পড়ে ।
মােক্ষম গল্পটি বললেন আমাদেরই একজন । জান , আমার দিদির কী ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হয়েছে । বড় অফিসারের বউ । আর সে ফাট ক্লাসে চড়ে না ।
– কেন চড়েন না ?
— সেবার দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে স্বামীর কাছে যাচ্ছে ফার্স্ট ক্লাস রিজার্ভ করে । বেরিলি স্টেশন ছাড়ে ছাড়ে । হঠাৎ একজন বৃদ্ধ অথচ বলিষ্ঠ চেহারার লােক আর একটি যুবক , বােরখা – পরা একটি মেয়ের হাত ধরে টানতে টানতে এসে দমাদম দরজায় ধাক্কা মারে ।
— মা ! দরজা খােল , বড় বিপদ ।
আমার দিদি বললেন , কি হয়েছে ?
বৃদ্ধ কেঁদেদেটে বলল , আমার মেয়ের বড় অসুখ । প্রায় অজ্ঞান বললে হয় । ওকে বড় হাসপাতালে নেব । তা কেউ দরজা খােলে না ।
দিদি দোনামােনা করছিলেন । ওরা বলল , শুধু মেয়েটা শুয়ে থাকুক । আমরা অন্য কামরায় থাকব । এ দয়াটুকু কর মা ! তােমার ছেলেমেয়ের মঙ্গল হবে । আল্লা তােমাকে অনেক আর্শীবাদ করবেন ।
দিদির মনটা গলে গেল । সত্যিই তাে অমন অসুস্থ একটা মেয়ে !
এরা বােধহয় বাপ আর ভাই হবে । উনি দরজা খুলে দিলেন । লােক দুটো মেয়েটিকে নিচের বার্থে শােয়াল । কম্বল চাপা দিল । দিদিকে সেলাম করে ওরা নেমে গেল ।
চারটে বার্থ । ছােট কামরা । ছেলেমেয়ে ওপরে উঠে গেল । দিদি নিচের বার্থে শুয়ে আছেন । ট্রেন খুব জোরে চলছে ।
দিদি দেখেন , মেয়েটি অস্বাভাবিক গড়াচ্ছে । পড়ে যাবে , পড়ে যাবে , বলতে বলতে সে গড়িয়ে মেঝেতে পড়ল ।
ওঁর একার সাধ্যি নয় । ছেলেকে ডাকলেন । মা আর ছেলে ওকে তুলতে যাবেন , হঠাৎ দেখা গেল বােরখা ঢাকা শরীরের মাথার দিকটা ওঁর হাতে । ছেলের হাতে কোমর থেকে কাটা শরীরের বাকিটা ।
দিদি তাে অজ্ঞান । ছেলে চেন টানে । গাড়ি থেমে যায় লােকজন আসে । দেখা গেল । একটি মেয়েকে খুন করা হয়েছে আগেই । তারপর কোমর থেকে আধাআধি কেটে রক্ত বের করা হয়েছে । তারপর হাত আর উরু দড়ি দিয়ে বেঁধে বােরখা পরান হয়েছে ।
সে বৃদ্ধ আর জোয়ানের হদিশও নেই ।
এ হেন গল্প শুনে বাকি রাতটা কেঁপে মরি । ঘুম তাে হল না , কোনমতে সকাল হলে যেন বাঁচি ।
সকাল হতে আমরা বেরােলাম ঝর্ণাতলার সন্ধানে । গরম জলে স্নান করে বাজারে বসে গরম পুরী , তরকারি , আচার আর খাসা প্যাঁড়া পেট ভরে খেয়ে যেন বাঁচলাম । রেস্ট হাউসে ফিরেই লম্বা ঘুম । একেবারে বিকেল অবধি ।
বিকেলে আমরা বেজায় সাহসী । আমরা বললাম , হাঁটতে হাঁটতে নদী পেরােই ।
একজন বলল , চৌকিদার যে মানা করল ?
আমরা বললাম , কি হবে ? ভূত দেখব ? দেখলে তাে ভালই হয় । এত জায়গা ঘুরি , কই ভূত তাে দেখতে পাই না কোথায়ও ।
নদী মানে কি , ছােট নদী । যতটা বালি তত জল নেই । গােড়ালিও ডােবে না যেন । কিন্তু কাচের মত স্বচ্ছ জল । দুটো ছেলে মেয়ে ওই জলই কলসিতে ভরছিল । জল নিয়ে ওরা নদী পেরিয়ে চলে গেল ।
দূরে পাহাড় । শীতের বিকেল । আলাে পড়ে আসছে । নদী পেরােতে দেখি ভাঙা মন্দির । মন্দির বলতে তিনটে দেয়াল আর ভিত ।
তাও ভেতরে গিয়ে দেখলাম দেয়াঁলে কোন কারুকার্য আছে কিনা । কিছুই নেই । শুকনাে পাতা আর ধুলাের পাহাড় ।
বীণাদি বললেন , হল মন্দির দেখা ?
– হল ।
— এবার চল । প্রেতপুরীতে ঢুকি ।
হাঁটছি , হাঁটছি , সামনে আমবাগান । গাছের গায়ে গাছ । এমন ঝুপসি অন্ধকার যে ভাল করে চোখ চলে না । কোন মানুষ যে পায়ে হেঁটে যায় , তেমন পথের চিহ্নও নেই । গাছের শুকনাে ডাল , মরা পাতায় বনতল ঢেকে গেছে । কী আশ্চর্য । কেউ কি এখানে জ্বালানির জন্যে কাঠ নিতেও আসে না । হঠাৎ লিলি বলল , এই দেখ ।
সত্যিই একটা টিনের বাের্ড । তার গায়ে কী সব লেখা । আমরা এগােলাম ।
যা লেখা আছে তার বঙ্গানুবাদ হলঃ এই জায়গাটি প্রেততাড়িত বলে মনে করা হয় । এখানে যে বা যাহারা ঢুকবে , তারা স্ব – দায়িত্বে ঢুকবে । সূর্যাস্তের পর ঢােকা নিষেধ ।
আমরা পড়ছি , পড়ছি । হঠাৎ যেন সব গাছগুলাে বাতাস পেয়ে চঞ্চল হয়ে উঠল । যেন নিঃশ্বাস ফেলছে পাতাগুলাে । বাইরে বাতাস বইছে না , বাগানে গাছ দুলছে । আমরা তখনি পেছনে ফিরলাম । পাহাড়ের ওপারে সূর্য নেমে গেছে ।
তবে আকাশে যেন আভা লেগে আছে ।
দ্রুত পা চালিয়ে নদীর দিকে যাব , বীণাদি বললেন , ওটা কী ?
মন্দিরের চাতালে জঞ্জালের স্তুপ ঠেলে গেরুয়া রঙের একটা কী যেন উঠে আসছে ।
ভয়েই আমরা পাথর ।
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল ছেঁড়া গেরুয়া আলখাল্লা পরা একটা লোক । মাথায় জটা ঝুলছে , মুখ বােঝাই দাড়ি – গোঁফ । সে কোথায় ছিল জানি না । ওই পাতার পাহাড়ের ওপরেই আমরা হেঁটেছি । আমরা থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম ।
লােকটা হয়ত লম্বা , কিন্তু অত লম্বা মানুষ হয় ? হঠাৎ ও হাত বাড়িয়ে আমাদের হাত নেড়ে ডাকতে থাকল আর আকাশ পানে মুখ তুলে হা হা করে হাসতে থাকল ।
হাসিতে কোনও শব্দ নেই ।
হাসছে ও বীভৎস হাসি , হাত বাড়াচ্ছে , ডাকছে আঙুল নেড়ে।
আমবাগানে গাছগুলাে যেন ক্ষেপে উঠল । গাছগুলাে এ – ওর গায়ে আছড়াচ্ছে , বাতাস যেন চাবুক মারছে ওদের , লােকটা নেমে আসছে আমাদের দিকে — যেন ভেসে আসছে –
আমরা প্রাণপণে দৌড় লাগালাম ।
সূর্য ডুবে গেছে , অন্ধকার নামছে , আমরা দৌঁড়াচ্ছি । নদী পেরিয়ে সেদিন কেমন করে রেস্ট হাউসে পৌঁছলাম তা আজও জানি না ।
তারপর বেদম বকুনি দিল চৌকিদার । যদি কিছু না থাকবে সরকার কেন নােটিশ দেবে ? ওই বাগানের ফল কোনও পাখি বা বাদুড়ও খায় না । আর ওই মন্দির ! কে জানে কী হবে এখন ।
এমন ভয় পেলাম আমরা যে রাতটা কাটিয়ে পরদিনই চলে এলাম ।
আমবাগানেই বা কেন ঝড় বইল ?
কাকে দেখলাম ? পাগল ? বােবা ?
জানি না , আজও জানি না । কিন্তু ভাবতে গেলেই ভয়ে শিউরে উঠি ।
এরকম চোখে দেখা আধ ভূতুড়ে গল্প আরও আছে । সে – সব কোনও দিন , কখনও পরে বলা যাবে ।
মজা হচ্ছে , পরের বছরই আমার প্রাণের বন্ধু রেবা আর ওর স্বামী হেমন্ত উত্তরবঙ্গে কোথাও বেড়াতে গিয়ে একটা বাংলােয় উঠেছিল । রাত যখন দুটো , তখন হঠাৎ বাচ্চার কান্না শুনে চমকে ঘুম ভেঙে ওরা দেখেছিল , ওদের দুজনের মাঝখানে একটা এক বছরের বাচ্চা হামা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে জায়গা খুঁজছে ।
ঘরের জানলা দরজা প্রবল শীতেই বন্ধই ছিল ।
ছেলেটা একটু যেন ভেসে আসছিল , বাতাসে হামা দিয়ে , নইলে আর কী !
তারপর তার মা অবধি ওই ভাবেই এসেছিল , মা আর ছেলের ঘাড় ভাঙা , লটকান , সে গল্প পরে কখনও বলা যাবে ।