মানব প্রকৃতির সামাজিক ভিত্তি সম্পর্কে লিখুন ।
উত্তর :– মানব প্রকৃতি বিষয়ে আগ্রহী কিছু দার্শনিক মনে করেন মানুষের প্রকৃতি হল তার সামাজিক আচরণের ভিত্তি , তাদের মতে সামাজিক আচরণের ভিত্তি হল সামাজিক প্রবৃত্তি । তবে বর্তমান শিক্ষা – দার্শনিকদের বক্তব্য হল মানুষের সামাজিক আচরণের ভিত্তি সামাজিক প্রবৃত্তি কিনা তা না বিচার করে এই মনে করা আরও যুক্তিপূর্ণ যে , মানুষ সর্বত্র , সবসময়ে সামাজিক সম্পর্কের মধ্যেই অবস্থান করে , তা না হলে সদ্যোজাত শিশুর পক্ষে বড়ো হওয়া সম্ভব নয় । শারীরিকভাবে শিশু যদিও স্বাধীনভাবেই বড়ো হয়ে উঠতে পারে তবে শৈশবকালে তাকে দীর্ঘ সময়ের জন্য সমাজের বয়স্কদের সাহায্য নিতে হয় মানুষের কাজের বিশেষীকরণ যত অধিক হবে বয়স্কদের প্রতি নির্ভরশীলতা তত বৃদ্ধি পাবে । পারস্পরিক নির্ভরশীলতা মানুষের সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য । শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই বিষয়টি এত গভীরে প্রবেশ করেছে যে , আমরা বলতে বাধ্য হই সামাজিক অভ্যাস হল দ্বিতীয় প্রকৃতি ।
মানব প্রকৃতির সামাজিক ভিত্তি প্রবৃত্তিজাত না অভ্যাসগত , এই প্রশ্নটি শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । অনেক সময় আমরা শুনতে পাই সামাজিক অন্যায় প্রতিরোধে মানুষ ব্যর্থ হয়েছে । তারা মনে করেন মনুষ্যপ্রকৃতি বর্তমানে যা আছে তা থাকলে আন্তর্জাতিক বিরোধ মেটাতে যুদ্ধ ব্যতীত অন্য কোনো পন্থা নেই । মানুষ যদি প্রকৃতিগতভাবে কলহপ্রিয় হয় তাহলে শিশুরা বিদ্যালয়ে একে অপরের সঙ্গে ঝগড়া করে এবং পরিণত বয়সে তারা যুদ্ধক্ষেত্রে যাবে । এখানে শিক্ষার কোনো ভূমিকা নেই । কিন্তু যুদ্ধ যদি অবাঞ্ছিত হয় , সেক্ষেত্রে আমরা এমন পরিবেশ তৈরি করতে পারি যেখানে যুদ্ধের কোনো প্রয়োজন হবে না । আমরা আন্তর্জাতিক কোর্টে গিয়ে সব বিবাদ মিটিয়ে ফেলতে পারি । এই ক্ষেত্রে শিক্ষার বিশেষ ভূমিকা দেখা যায় । প্রশাসনিক বিশেষ পদক্ষেপ এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অভ্যাস তৈরি করে সামাজিক ন্যায় – অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি ।
মানব প্রকৃতির সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি সামাজিক প্রক্রিয়া ও ব্যক্তি সকলের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের উপর প্রভাব বিস্তার করে । এই সম্পর্ক অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক উভয় হতে পারে । বাহ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যক্তিসকল সামাজিক সম্পর্কের একক হিসেবে গণ্য হয় এবং সকলের সঙ্গে সম্পর্ক গঠনে ব্যক্তিসকলের স্বাধীনতা থাকে । ব্যক্তি নিজের ব্যক্তি সত্তাকে বিসর্জন না দিয়ে সমাজের যে – কোনো ঐতিহ্যকে গ্রহণ করতে পারে ।
মনুষ্য প্রকৃতির এই ধরনের সামাজিক ভিত্তি বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা প্রক্রিয়ার সূচনা করে । কোনো কোনো বাধাবন্ধনহীন ( Laissez faire ) শিক্ষার সূচনা এর ফলেই দেখা যায় । সম্পর্ক বাহ্যিক হওয়ার ফলে সামাজিক দায়বদ্ধতা ব্যক্তির ইচ্ছানুযায়ী চালিত হয় । কোনো ব্যক্তি তার পুত্রকন্যাদের বেসরকারি শিক্ষাগ্রহণ করাতে পারে । সরকার তাতে কোনো বাধা আরোপ করবে না তবে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার জন্য তাকে কোনো ফিস্ দিতে হবে না । একইভাবে শিক্ষার্থীর পাঠক্রম হবে ঐচ্ছিক এবং পছন্দমতো , কোনোরকম শর্ত থাকবে না ।
অভ্যন্তরীণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য থাকে না । সব কিছুই এখানে এত সম্পর্কিত যে একটির পরিবর্তনে অন্যান্যদের মধ্যেও পরিবর্তন দেখা যায় । একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে — দৈহিক পরীক্ষায় দেখা গেছে কোন্ কোশ কোন্ অঙ্গকে বৃদ্ধি করবে তা অংশত নির্ভর করে কোশের প্রকৃতির উপর এবং কোন অঙ্গের পাশে কোশটি অবস্থিত । একটি কোশ মস্তিষ্ক গঠন করবে কি পা গঠন করবে তা নির্ভর করে কোশটির অবস্থান কোথায় তার উপর । মস্তিষ্ক বৃদ্ধিতে এর অবস্থান হবে মস্তিষ্কের নিকট এবং পা – এর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে পায়ের নিকট ।
মানুষের ক্ষেত্রে সম্পর্কগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ । মানবভ্রুণ কীভাবে বিকশিত হবে তা প্রাথমিকভাবে নির্ভর করে পিতা – মাতারা সেই ভ্রূণের উপর কী প্রভাব ফেলেছে তার উপর । পরে বড়ো হয়ে ব্যক্তিগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমাজ গঠন করে না , বাধ্য হয়েই সমাজের অনুশাসন মেনে চলতে হয় । তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক স্বাভাবিক পরিবেশে গড়ে ওঠে এবং পারস্পরিক উদ্দেশ্যকে সফল করে তোলার মধ্য দিয়েই সমাজ গড়ে ওঠে । প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তিসকলের মধ্যে যোগাযোগের ফলেই সমাজ গড়ে ওঠে এবং স্থায়ী হয় । প্রত্যেকেই প্রত্যেকের সঙ্গে এত জড়িত যে সমাজকে একটি শ্রেণি হিসাবে বিবেচনা করা যায় । যা প্রয়োজনমতো প্রাকৃতিক এবং জৈবিক প্রকৃতির পরিবর্তন করে মানুষের প্রকৃতির সামাজিক বৈশিষ্ট্যের এই বিশ্লেষণ যদি সঠিক বলে মনে করা যায় তাহলে মানুষের প্রকৃতি অপরিবর্তনীয় — এই ধারণাকে পরিবর্তন করতে হয় ।
ডারউইন ( Darwin ) – এর ‘ বিবর্তন তত্ত্ব ’ সঠিক হলে বলতে হয় প্রাকৃতিক গঠনের ন্যায় মানুষের সামাজিক গুণাবলিও খুব ধীরগতিতে পরিবর্তন ঘটে । পরিবর্তনের গতির মধ্যে দ্রুততা আসতে পারে যদি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে উদার হতে পারা যায় । তাই ব্যক্তিগত মানুষের প্রকৃতি নির্ভর করে কী ধরনের মানুষের প্রকৃতি বর্তমানে দেখা যাচ্ছে তার উপর । শিক্ষা প্রক্রিয়ায় নিজের ও অন্যান্যদের সম্পর্কে ধারণা একই সময়ে গড়ে ওঠে । অন্যরা কীভাবে আচরণ করছে , কীভাবে নিজের অনুভূতি দিয়ে অপরের অনুভূতিকে দেখছে এবং বিচার করছে তাও এর অন্তর্ভুক্ত , প্রত্যেকেই প্রত্যেকের নিকট অপরিহার্য ।