ভৌতিক বা প্রেতের কোন অস্তিত্ব আছে কীনা সে সম্পর্কে আজো আমি যথেষ্ট সন্দিহান। তথাপি সেবার আমার ট্রেনের কামরায় রাত্রে যে ঘটনাটি ঘটেছিল সেটি আপনাদের আজ বলছি । কারণ আজো আমি ব্যাপারটার কোন মীমাংসা খুঁজে পাইনি । মনে হয়েছে কখনাে হয়তাে ব্যাপারটা আগাগােড়াই একটা উর্বর মস্তিষ্কের স্বপ্ন কিংবা আমার মনের ভুল । আবার এও মনে হয়েছে স্বপ্নটা ভুলই যদি হবে তবে এত details সে সব কিছু আজো মনে আছে কী করে । কিন্তু তাহলেও আমি কোন যুক্তি দিয়ে সেটাকে গ্রহণ করতে আজো পারিনি । জামসেদপুর থেকে ফিরছি । গ্রীষ্মের রাত ! রাউরকেল্লা টাটা কোচে আগে থাকতেই A . C – র একটা কুপ রিজার্ভ করা ছিল । আমার ও আমার এক বন্ধুর জন্য । শেষ মুহূর্তে সে এলাে না । আমি একাই রইলাম । রাত দশটা নাগাদ খাওয়া – দাওয়া করে এসে বার্থে শুয়েছিলাম — ট্রেন ছাড়বে রাত বারােটার পর । কখন ঘুমিয়েই পড়েছিলাম জানি না । এবং কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানি না । হঠাৎ একসময় ঘুম ভেঙে গেল । ট্রেন চলেছে তখন । কামরার মধ্যে মৃদু নীলাভ বাতিটা জ্বলছে । স্বপ্নের মতাে যেন একটা কালাে অন্ধকারের লুকোচুরি । ট্রেনটা কখন ছেড়েছে টের পাইনি । আবার ঘুমােবাে বলে চোখ বােঝবার চেষ্টা করি কিন্তু কেন যেন পারি না । এবং কেন যেন মনে হয় কুপের মধ্যে আমি একা নেই । তবে কী বন্ধু আমার ঘুমাবার পর কুপের মধ্যে এসে উঠেছে ট্রেন ছাড়বার আগে । — কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আলােটা জ্বাললাম — উপরের বার্থের দিকে তাকালাম কিন্তু কই কেউই নেইতাে , বার্থটা শূন্য। আমারই মনের ভুল মনে করে আলােটা নিবিয়ে শুয়ে পড়লাম । আবার সেই নীলাভ আলো কুপের মধ্যে । — কিন্তু . . . . . কেন যেন মনে হচ্ছে কেউ আছে কুপের মধ্যে । দেখতে পাচ্ছি না কাউকে কিন্তু স্পষ্ট অনুভব করছি কোন দ্বিতীয় প্রাণীর উপস্থিতি । শুধু তাই নয় , কেমন একটা মৃদু মিষ্টি সৌরভ যেন নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করে । মিষ্টি কোন ফুলের মৃদু সৌরভ যেন । কিন্তু সেই কূপের মধ্যে – দ্বিতীয় আর কোন প্রাণী নেই একটু আগেই দেখেছি । কূপের দরজাটাও বন্ধ — তবু যেন মনে হয় আশ্চর্য কেউ – আরাে কেউ ঐ মুহূর্তে কুপের মধ্যে আমার আশে – পাশে আছে । চোখ মেলে চেয়ে দেখি । কে যেন অত্যন্ত মৃদু নারী কন্ঠে বলল , একটু উঠে বসুন না — কে — আমাকে একটু বসতে দিন না । কই কোথাও তাে কেউ নেই । কাউকেই তাে দেখতে পাচ্ছি না , তবে কে একটু আগে কথা বললে । কই একটু উঠে বসুন না । কেমন যেন বােকার মতই এবারে উঠে বার্থের উপরে বসলাম । এবার স্পষ্ট মনে হলাে কে যেন ঠিক আমার পাশেই আমার শয্যার উপর উপবেশন করল । — ধন্যবাদ এদিক – ওদিক তাকাই আবার । এক কাজ করুন না—ইচ্ছে করলে উপরের বার্থে উঠে আপনি শুয়ে পড়ুন না — বার্থটাও খালি আছে । কোন জবাব আমি দিই না । ঘরের মৃদু নীলাভ আলােটা যেন ক্রমশঃ একটু একটু করে কমে আসছে – ইলেকট্রিক ফেল করছে নাকী । ট্রেনের আলাে মাঝে – মধ্যে কম বেশী ত হয়ই , হয়ত তাই ! একটু মৃদু খস্ খস্ শাড়ীর শব্দ যেন ঠিক পাশেই শুনতে পেলাম — কি হলাে ঘুমােবেন না । না !
ঘুম আসছে না বুঝি ?
না।
তবে ।
মনে হলাে এবার যেন অন্ধকারে অস্পষ্ট পাশেই দেখতে পাচ্ছি একজন বসে আছে ।
নিশ্চয়ই তাহলে কেউ উঠেছেন –
কিন্তু কনডাকটার আমি একা – একজন পুরুষ এই কুপের মধ্যে আছি জেনেও প্রবেশ করতে দিলে কী করে ?
তাতে কী হয়েছে — সাফ সাফ বলে উঠে আমার সহযাত্রিণী , হলেই বা পুরুষ আপনি ভদ্রলােক তাে –
কী বলছেন ?
তাছাড়া আমি তাে আপনার মেয়ের বয়েসী !
মনে হল সহযাত্রিণী কথাটা বলে মৃদু হাসল !
আপনি –
আমি আপনার চাইতে বয়সে অনেক ছােট , আমাকে তুমি বলেই ডাকবেন — আমার নাম নন্দিনী –
আমি কোন জবাব দিলাম না । মনে হচ্ছিল , এলাে কী করে আর কখনই বা এলাে মেয়েটি আমার এই কূপের মধ্যে –
আশ্চর্য লাগবারই কথা — সহযাত্রিণী বলে , যেন আমার মনের কথার জবাব দিলে , প্রতি রবিবারই তাে আমি আসি ।
প্রতি রবিবার ?
হুঁ-
কোথা থেকে আসছাে তুমি ? কেমন যেন কৌতুক বােধ করি । আলাপ শুরু করি । টাটানগর থেকে ?
না।
তবে ?
তারও আগে থেকে । কোথা থেকে ?
রাউরকেল্লা থেকে — ভাবছেন তাহলে টাটানগরে যখন আপনি কুপেতে উঠলেন আমাকে এখানে দেখতে পেলেন না কেন , তাই না ।
হুঁ
আমাকে সবাই দেখতে পায় না । দেখতে দিই না –
তবে ?
আপনাকে দেখা দিলাম কেন তাই না । আপনাকে যে আমি চিনি !
আমাকে চেনাে ।
হুঁ – কত লেখা আপনার পড়েছি — তাইতাে আলাপ করবার লােভটা সম্বরণ করতে পারলাম না । আমাকে নিয়ে একটা গল্প লিখবেন ?
গল্প !
হ্যাঁ — নন্দিনী নামের একটি মেয়ের গল্প । শুনবেন আমার গল্পটা ?
বল ।
সুকৃতি চৌধুরী একজন ইঞ্জিনীয়ার — আজ । কিন্তু একদিন যখন সে ছাত্র মাত্র তখন থেকেই আমাদের আলাপ ! ও বলেছিল আমায় বিয়ে করবে –
তারপর ?
হঠাৎ একদিন এসে বলল , চাকরি পেয়েছি রাউরকেল্লায় । সেখানে জয়েন করতে গেল , বলে গেল মাস দুয়ের মধ্যে ফিরে এসে আমায় বিয়ে করে নিয়ে যাবে ।
বিয়ে হলাে ?
কই হলাে । একমাস দুমাস — পাঁচ মাস যখন কেটে গেল ওর কোন সাড়া নেই । চিঠি দিয়েও কোন জবাব নেই । তখন আমি ব্যস্ত হয়ে উঠলাম ! কারণ আমার অবস্থা সংকটাপন্ন — আ – আমি মা হতে চলেছি –
বল কী ?
তাই অনন্যোপায় হয়ে ছুটে গেলাম রাউরকেল্লায় !
খুঁজে পেলে তাকে ?
হুঁ , সে তখন বিয়ে করে অন্য একটি মেয়েকে নিয়ে সংসার পেতেছে ।
মনের আনন্দে চাকরি করছে ।
তুমি কিছু জানতে পার নি ?
না । সন্দেহও করি নি ।
তাহলে ?
ফিরে এলাম ।
তাকে কিছু না বলেই ?
হ্যাঁ । কী হবে ! সে মেয়েটি ত কোন দোষ করে নি । তার সংসারটা ভেঙ্গে দেবাে কেন ? সেও তাে আমার মত একটি মেয়ে । চলে এলাম নিঃশব্দে —
চলে এলে ?
হ্যাঁ — সেও এমনি এক শনিবারের রাত ।
তারপর –
তারপর আর কী ? ফিরে যাবাে কোথায় ! বাড়িতে আমার পরে সন্দেহের দৃষ্টি বর্ষিত হতে শুরু করেছে । সবাই আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে —
অকস্মাৎ মেয়েটি কেঁদে উঠলে । ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল ।
আমি কী বলবাে বুঝে পাই না ।
হঠাৎ ঐ সময় নন্দিনী উঠে দাঁড়াল । কুপের দরজা খুলে বের হয়ে গেল ।
কোথায় গেল — তাড়াতাড়ি আমি উঠে পড়লাম ।
মৃদু আলাে করিডােরের !
দেখলাম মেয়েটি দরজা খুলে বাইরে চলে গেল ।
ফেমন কৌতূহল হলাে ।
দূর থেকে তাকে অনুসরণ করলাম ।
করিডােরের দরজা খুলে বাইরে এলাম ।
দেখি তখন সেখানে কেউ নেই — কেবল কামরার একটা দরজা হা – করে খােলা ।
ধ্বক করে উঠলাে বুকের মধ্যে ।
কী সর্বনাশ , মেয়েটি চলন্ত গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ল না ত !
খােলা দরজা পথে তাকালাম বাইরের অন্ধকারে –
হঠাৎ যেন নন্দিনীর গলা স্পষ্টকানের পাশে শুনতে পেলাম , যান গিয়ে শুয়ে পড়ুন –
আপনাকে কষ্ট দিলাম — মনে কিছু করবেন না ।
কখন ফিরে এসেছি কুপের মধ্যে ।
কখন শুয়ে পড়েছি কিছুই মনে নেই । ঘুম ভাঙল যখন ট্রেন হাওড়া স্টেশনে ইন করছে । আজ ট্রেন একটু আগেই পৌঁছেছে । যা রাউরকেল্লা সাধারণত পৌঁছায় না ।