প্রশ্ন : শিক্ষণবিজ্ঞানের দার্শনিক ভিত্তি ও ঐতিহাসিক বিকাশ সম্পর্কে লিখুন ।
উত্তর : সাধারণভাবে আমরা Pedagogy বা শিক্ষণবিজ্ঞান বলতে যা বুঝি তা হল ‘ Pedagogy is the art and science of teaching ‘ অর্থাৎ শিক্ষণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত বা সম্পৃক্ত বিজ্ঞানই হল ‘ Pedagogy ‘ । কিন্তু এইভাবে ব্যাখ্যা দিলে ‘ Pedagogy’- এর দার্শনিক
ভিত্তি তথা ঐতিহাসিক বিকাশের কোনো সন্ধান পাওয়া যায় না । সুতরাং Pedagogy’- কে আমরা এইভাবে ব্যাখ্যা করলে যে ত্রুটি হল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সহযোগিতাপূর্বক শিখনকে জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তোলার শৈলী ’ — তার প্রকৃত চিত্রটি আমাদের নিকট ধরা পড়ে । ওইখানে শিক্ষা বলতে আমরা ঠিক কী বুঝি সে প্রসঙ্গও এসে পড়ে । আমরা বলতে পারি শিক্ষা হল আবিষ্কার – এ উদ্বুদ্ধ করা এবং তার পশ্চাতে সময়দানের একটি অবশ্যম্ভাবী প্রক্রিয়া । এটি একটি প্রবৃত্তিমূলক ক্রিয়া । আবার John Dewey একে একটি সামাজিক প্রক্রিয়ারূপে তুলে ধরেছেন । এটি একটি সত্য অনুসন্ধানের উপায় । ঠিক তেমনই শিখন হল সত্য ও সম্ভাব্য বিষয়কে অনুসন্ধানের একটি উপায় । এটি কতকগুলি মূল্যবোধ ও প্রতিশ্রুতির উপর প্রতিষ্ঠিত , যা অন্যদের প্রতি সম্মানবোধকে তুলে ধরে । শিক্ষা হল একটি সামগ্রিকতার পরিচয় । পেস্তালাৎজি বলেছেন যে , শিক্ষা মানুষের চরিত্রগত । এটি হল হৃদয় , মস্তিষ্ক ও হস্তদ্বয়ের বিষয় । কারণ আমরা প্রতিটি মানুষ প্রকৃতি , সমাজ ও আধ্যাত্মিকতার মধ্যে সম্পর্ক রচনার মধ্য দিয়ে নিজেদের জীবনের অর্থ ও অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে পারি । শিক্ষিত করে তোলার অর্থ হল এমন স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি , নির্মাণ ও ধারণ যার মধ্যে দিয়ে শিখন স্বতঃস্ফূর্ততা লাভ করে । এর অর্থ কেবল কতকগুলি বিষয় সম্পর্কে জানা নয় তার সঙ্গে সঙ্গে আমরা যে পৃথিবীতে বসবাস করি তার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানের ক্ষমতার বিকাশও এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য । শিক্ষা হল দৃঢ়ভাবে একটি ব্যাবহারিক ক্রিয়া সেখানে আমরা নিজেদের জন্য কী করতে পারি এবং অন্যদের সঙ্গে কী করতে পারি তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । এর থেকে উপলব্ধি করা যায় যে শিক্ষা শিখন , শিক্ষণবিজ্ঞান এই ধারণাগুলি ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত ।
এখন আমরা আলোচনা করব ‘ Pedagogy’- এর উৎপত্তির ইতিহাস । ইংরেজি ‘ Pedagogy ‘ শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ Pedagogues ‘ থেকে । এটি প্রাচীন গ্রিক সমাজের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধারণা । গ্রিক দার্শনিক প্লেটো Pedagogues সম্পর্কে বলেছেন , এদের নিযুক্ত করা প্রাচীন গ্রিক সমাজের অন্যতম ঐতিহ্য ছিল । এরা শিশুদের তত্ত্বাবধান করত এবং নৈতিক শিক্ষাদান করত । অনেক সময় এদের ভূমিকা বিদ্যালয় শিক্ষক অপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ছিল । ক্যাসেল উল্লেখ করেছেন অনেকক্ষেত্রে বিদ্যালয় শিক্ষক অপেক্ষা এরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত ছিল । ইমানুয়েল কান্টও এদের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেছেন ।
এখন আমাদের আলোচ্য বিষয় হল কীভাবে Pedagogy’- এর ধারণাটি ‘ Teaching ’ বা শিখনের প্রতি আলোকপাত করে । ইউরোপে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে শিক্ষণ ও নির্দেশদান – এর প্রক্রিয়া ও বিষয়বস্তু নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয় । বিগত 300-400 বছর পূর্বে এই নিয়ে চিন্তাভাবনা ও আন্দোলন শুরু হয় । নির্দেশদান পদ্ধতির উপরেও গুরুত্ব দেওয়া হতে থাকে । বিদ্যালয়ের সংগঠন ও বিকাশের উপর গুরুত্বদান করা হয় । পাঠক্রমে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানের আন্তর সম্পর্কগত দিকটিতে গুরুত্ব দেওয়া হতে থাকে । এই সময় ‘ পাঠ্য বিষয় ’ থেকে শিক্ষণের ক্রিয়াটিকে পৃথক করা হয় । ইউরোপে ‘ শিক্ষণের প্রক্রিয়া ’ সম্পর্কে আগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকে । 1896 – এ ইংরেজিতে John Amos Comenius- এর বই ‘ The Great Didactic প্রকাশিত হয় যার অন্যতম বার্তা ছিল সমস্ত বিষয় সম্পর্কে সবিস্তারে সকলকে সর্বাপেক্ষা সম্ভাব্য উপায়ে শিক্ষণদান – এর মুল নীতি । কমেনিয়াস বিশ্বাস করতেন যে প্রতি মানুষ জীবনের সমস্ত বিষয় নিখুঁতভাবে এবং সবিস্তারে লাভ করতে চায় এবং এই ক্ষেত্রে তিনি শিক্ষণের কতকগুলি নীতিকে তুলে ধরেছেন যেমন—
• শিক্ষণ অবশ্যই শিক্ষার্থীর জীবনবিকাশের ধারার সঙ্গে সামস্যপূর্ণ হবে ।
• সমস্ত রকম শিখন ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সম্ভব ।
• যে – কোনো কাউকে নির্দিষ্ট থেকে সাধারণ , সহজ থেকে কঠিন ও জানা থেকে অজানার দিকে যেতে হবে ।
• শিখনের ক্ষেত্রে কখনোই একই সঙ্গে একাধিক বিষয় বা ধারণা সম্পর্কে শিক্ষাদান সম্ভবপর নয় ।
• শিক্ষণ অবশ্যই উদার ও পদ্ধতিমাফিক হবে । এর পরবর্তী ক্ষেত্রে Herbert ও শিক্ষণ ও শিক্ষার ধারণাকে পৃথক করেন । তিনি উল্লেখ করেছেন , “ Teaching is the central activity of education . ” তিনি বলেছেন যথাযথ শিক্ষণই শিক্ষার সাফল্য নিয়ে আসতে পারে । এই সময় আরও কিছু চিন্তাবিদ ছিলেন যারা শিক্ষণকে কেবলমাত্র বিজ্ঞান – এর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অধিকতর ব্যাপক ক্ষেত্রে এর মানসিক দিকটির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন । এই সময় থেকে শিখন , শিক্ষণ ও বিদ্যালয়ের উপর মানসিক অভিজ্ঞতা আরোপের দিকটিতে গুরুত্ব দেওয়া হয় । Learning by doing’- এর ধারণাটিও তখন থেকে গুরুত্ব লাভ করে । কী পরিবেশে ও পরিস্থিতিতে শিক্ষার ধারণাটি বিকশিত হয় তার উপরেও গুরুত্ব দেওয়া হয় । জার্মানিতে শিক্ষার পদ্ধতি ও পাঠক্রমে এর সামাজিক শিক্ষণবিজ্ঞানগত দিকটির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয় ।
এর পরবর্তীতে Simon ( 1981 : 1 ) উল্লেখ করেন “ The most striking aspect of current thinking and discussion about education is its eclectic character reflecting deep confusion of thought and of aims and purposes , relating to learning and teaching – to pedagogy ” তিনি Pedagogy- কে শিক্ষণের বিজ্ঞানের সঙ্গে তুলনা করেছেন । ইউরোপে Pedagogy সংক্রান্ত বিভিন্ন চিন্তাভাবনা বিকাশলাভ করে । সেই তুলনায় ব্রিটেন ও উত্তর আমেরিকায় সাত ও আট – এর দশকে সেইভাবে আলোকপাত করা হয়নি ।
তাৎক্ষণিকভাবে Pedagogy’- র ধারণাটি জনপ্রিয়তা লাভ করে 1970 – এ ইংরেজিতে প্রকাশিত Paulo Freire- এর Pedagogy of the Oppressed ‘ বইটির মাধ্যমে । এই উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও কার্যক্রমে সহায়ক পাঠ হিসাবে গুরুত্ব পায় । এর পরবর্তীকালে Basil Berntein ( 1971 ) -এর ‘ On the classification and framing of educational knowledge ‘ বইটিও গুরুত্বপূর্ণ ধারণা তুলে ধরে । এই প্রসঙ্গে Jerome Bruner- এর ‘ Culture of Education ( 1996 ) ও একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা । এখানে তিনি শিক্ষকগণ যে সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে কাজ করছে তার গুরুত্ব উপলব্ধি করার কথা বলেছেন । তিনি ‘ Pedagogy ’ সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন , “ It is a medium that carries its own message ” ইংল্যান্ডে ‘ Pedagogy’- এর ধারণাটির জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ হল এর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষ নিয়ন্ত্রণের ধারণাকে যুক্ত করা । পাঠক্রমের মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষের ক্রিয়াকর্মকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ‘ Pedagogy’- এর বিষয়টি উঠে আসে । এই প্রসঙ্গে পাঠ পর্যবেক্ষণ ও শ্রেণি পর্যবেক্ষণ এর ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের শিখনশৈলীর উল্লেখ পাওয়া যায় , যেমন — বক্তৃতা , স্ব – শিখন প্রভৃতি । কিন্তু এই পদ্ধতিতে ‘ Pedagogy’- কে দেখার ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি 200 বছর পূর্বের Herbert- এর দৃষ্টিভঙ্গির সমধর্মী হয়ে যায় ।
বর্তমানে শিক্ষণকে একটি জটিল প্রক্রিয়ারূপে দেখা হয় যার অন্যতম দিক হল শিক্ষণের কাজ । কেবল শিক্ষার সরবরাহ নয় বরং তার সঙ্গে এটি যে বিষয়গুলিকে তুলে ধরে , সেগুলি হল—
• শিক্ষণের কলা – প্রতিক্রিয়ামূলক , অনুমানমূলক ও সৃজনাত্মক দিক ।
• শিক্ষণের শিল্প – দক্ষতা ও ব্যাবহারিক দিক ।
• শিক্ষণের বিজ্ঞান – গবেষণাগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তাত্ত্বিক দিক । শিক্ষণ বর্তমানে কেবল যান্ত্রিক একটি ক্রিয়া বা কৌশল নয় বরং একটি নীতিগত দিক ও নৈতিক দায়বন্ধতা । এর পরবর্তী থেকে Robin Alexander ( 2004 : 11 ) Pedagogy সম্পর্কে যা বলেছেন তা হল আমাদের কী জানার প্রয়োজন , কী ধরনের দক্ষতা অর্জনের প্রয়োজন এবং যে দায়বদ্ধতা আমাদের সুষ্ঠু জীবনযাপনকে নির্ধারিত করে সেই দৃষ্টিতে ক্ষেত্রবিচার করেছেন । এখানে Bruhlmeier ( 2010 : 5 ) পেস্তালাৎজি – এর কথা উল্লেখ করে বলেছেন যে শিক্ষার কাজ কেবল শিখন ফলশ্রুতির বিচার করা নয় , এটি মানুষের মানসিক । তথা তাদের দৈহিক-মানসিক ও মনোবৈজ্ঞানিক বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ।
আধুনিককালে ‘ Pedagogy’- এর ধারণাটি আরও বিকাশলাভ করেছে । Nodding উল্লেখ করেছেন যে ‘ Pedagogy ‘ এর ধারণাটির অন্যতম ভিত্তি হল সম্পর্ক । আমরা যদি শিক্ষার্থীদের বক্তব্য শুনি আমরা তাদের বিশ্বাস অর্জন করব এবং আমরা যা পড়াব তারাও সেটি সহজে গ্রহণ করতে পারবে । দ্বিতীয়ত আমরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বক্তব্য আদানপ্রদানের মধ্য দিয়ে তাদের কাজ করার অভ্যাস , আগ্রহ ও প্রতিভা সম্পর্কে জানতে পারব যার ফলে সহজেই আমরা কী ধরনের পাঠদান করব তার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে এবং তাদের ব্যক্তিগত উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ সম্ভবপর হবে । সর্বোপরি আমরা যদি শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে । ধারণা লাভ করি এবং কী ধরনের পাঠক্রম উপযুক্ত হবে তা উপলব্ধি করতে পারি তাহলে তা আমাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে ।
‘ Pedagogy’- এর ধারণাটি বর্তমানে যে ধারণাকে গুরুত্ব দেয় তা হল এটি শিখনকে জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত করার একটি প্রক্রিয়া , যা সম্ভব নতুন অভিজ্ঞতাদান , জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত অভিজ্ঞতা নির্মাণের উপযুক্ত পরিসর সৃষ্টি ও শিক্ষার্থী যাতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে পারে তার জন্য তাদের সঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে । এতক্ষণ আমরা ‘ Pedagogy’- এর ঐতিহাসিক বিকাশ নিয়ে আলোচনা করলাম , এবার দার্শনিক ভিত্তি সম্পর্কে আলোচনা করব । ‘ Pedagogy’- এর দার্শনিক ভিত্তি শিখনের বিভিন্ন তত্ত্বগুলির ধারাবাহিক বিকাশের মধ্যে নিহিত আছে ।