প্রশ্ন : মৃদুমাত্রার মানসিক প্রতিবন্ধকতা কাকে বলে ? এদের বৈশিষ্ট্যগুলি লিখুন । এদের কীভাবে চিহ্নিত করবেন ? এদের শিক্ষাদানের নীতিগুলি লিখুন ।
উত্তর : যেসব মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুরা সাধারণ প্রথাগত বিদ্যালয়ের শিক্ষা থেকে উপকৃত হয় তাদেরকেই মৃদুমাত্রার মানসিক প্রতিবন্ধী শিক্ষাদানযোগ্য মানসিক প্রতিবন্ধী শিশু বলে । শতকরা 3 জন এই ধরনের শিক্ষার্থী দেখা যায় ।
মৃদুমাত্রার মানসিক প্রতিবন্ধীদের বৈশিষ্ট্য
1. দৈহিক বৈশিষ্ট্যাবলি : (ক) দৈহিক বৈশিষ্ট্য , যেমন- উচ্চতা , ওজন এবং অসঞ্চালনের দিক থেকে অর্থাৎ সাধারণ স্বাস্থ্যের নিরিখে এইসব শিশুরা স্বাভাবিক । তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের ত্রুটির জন্য এদের দৃষ্টি এবং চলাফেরায় ব্যক্তিক্রমী ভাব চোখে পড়ে । (খ) শিক্ষাদানযোগ্য মানসিক প্রতিবন্ধীদের মধ্যে অনেকের ইন্দ্রিয়জনিত , যেমন – শ্রবণ , দর্শন , স্পর্শ , স্বাদ ও গন্ধ এবং অঙ্গসঞ্চালনগত কিছু সমস্যা দেখা যায় । (গ) এই জাতীয় শিশুদের অধিকাংশই গরিব এবং নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আসে , যার ফলে স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা এদের মধ্যে প্রায়শই থাকে না । উপরন্তু বোঝাবার ক্ষমতার অভাব থাকায় স্বাস্থ্যের গুরুত্ব এবং স্বাস্থ্যবিধি পালনের উপায় সম্পর্কে এরা সচেতন নয় ।
2. বৌদ্ধিক বৈশিষ্ট্যাবলি : (ক) বুদ্ধির ঘাটতি এই ধরনের শিশুদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য । বস্তুতপক্ষে নিম্নমাত্রার বুদ্ধির ফলেই এদেরকে মানসিক প্রতিবন্ধী শিশু বলা হয় । বাচনিক , অবাচনিক এবং সামাজিক — সবরকমের বুদ্ধি অভীক্ষাতেই এরা সাধারণের থেকে পিছিয়ে থাকে । জ্ঞানমূলক বিকাশের দিক থেকে প্রাক্ – সক্রিয়তার স্তর পর্যন্ত এদের সীমা । স্মৃতি , কল্পনা , বিচারকরণ প্রভৃতি প্রায় সমস্ত রকমের মানসিক প্রক্রিয়াতেই এরা পিছিয়ে থাকে । (খ) কোনো কোনো সময়ে এদের মধ্যে দু – একজন বিশেষ কাজে উচ্চ মাত্রায় দক্ষতা দেখায় , যেমন — সংগীত , অঙ্কন , শিল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে । শিক্ষাযোগ্য মানসিক প্রতিবন্ধীদের মধ্যে এরা হল ব্যতিক্রমী । (গ) এদের সামান্যীকরণের ক্ষমতা অল্প । অর্জিত অভিজ্ঞতাকে নতুন পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করতে এরা অক্ষম । এরা নির্দিষ্ট এবং মূর্ত প্রতিক্রিয়া করে , পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া করতে পারে না । এরা মনে করে অর্থ চুরি করা অন্যায় কিন্তু না বলে খাদ্য গ্রহণ করা অন্যায় নয় । এরা কার্যকারণ সম্পর্কও ঠিক করতে পারে না , যেমন — অসুস্থতার জন্য এরা থার্মোমিটারকে দোষ দেয় । এদের সমন্বয় সাধনের ক্ষমতা কম থাকার জন্য অংশগুলিকে সম্পূর্ণ রূপ দিতে পারে না ।
3. শিক্ষাগত বৈশিষ্ট্যাবলি : (ক) 6 বছর বয়সের পর যখন শিক্ষাদান উপযোগী প্রতিবন্ধী শিশু প্রথাগত বিদ্যালয়ে ভরতি হয় তখন তাদের মধ্যে অধিকাংশই পড়তে , লিখতে বা অঙ্ক করতে অক্ষম থাকে । এই শিক্ষাসংক্রান্ত কাজগুলি 8-10 বছর বয়সের আগে তাদের পক্ষে করা সম্ভব নয় । (খ) এরা ধীরে ধীরে শেখে এবং এদের শিখনে স্পষ্টতা ও উৎকর্ষতার অভাব দেখা যায় । (গ) এই ধরনের শিশুরা তাদের বয়সের তুলনায় 2-3টি গ্রেড নীচে অবস্থান করে । অষ্টম শ্রেণিই হচ্ছে এদের শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তর । এদের অধিকাংশই পঞ্চম অথবা ষষ্ঠ শ্রেণির বেশি শিক্ষা অর্জন করতে সক্ষম হয় না ।
4. ব্যক্তিগত ও সামাজিক বৈশিষ্ট্যাবলি : (ক) এরা খুব আত্মকেন্দ্রিক হয় । দেওয়া এবং নেওয়ার মধ্যে সম্পর্ক (Give and Take Policy) এরা বুঝে উঠতে পারে না । (খ) সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার দিক থেকেও এরা পিছিয়ে থাকে ।
মৃদুমাত্রার মানলিক প্রতিবন্ধীদের শিক্ষাদানের নীতি
কেন্দ্রীয় সরকারের 1996 খ্রিস্টাব্দের IEDC প্রকল্প অনুসারে শিক্ষাদানযোগ্য মানসিক প্রতিবন্ধীদের সাধারণ বিদ্যালয়ে স্বাভাবিক শিশুদের সঙ্গে শিক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয় । এদের শিক্ষার উদ্দেশ্য হল
(ক) পঠনপাঠনে দক্ষতা বৃদ্ধি ;
(খ) সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি ;
(গ) অভিযোজনের ক্ষমতা বৃদ্ধি ;
(ঘ) পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি ।
এই ধরনের শিশুদের শিক্ষাদানের প্রাথমিক পর্বের পাঠক্রমে থাকে প্রস্তুতিমূলক দক্ষতা , ভাষার বিকাশ , ধারণা গঠন , সামাজিক অভিযোজন এবং পঠন – লিখন – পাটিগণিতে দক্ষতা (3R’s) । তবে পাঠক্রমের বিষয়বস্তু খুব সাধারণ মানের হবে ।
মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা নির্দেশনার প্রাথমিক শর্ত হল শিক্ষককে ধৈর্যশীল হতে হবে । ভালোবেসে , সহানুভূতিশীল হয়ে , কোনোরূপ বিরক্তি প্রকাশ না করে তাঁকে শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জন করতে হবে । নির্দেশনার দর্শন এবং অর্থ সম্পর্কে শিক্ষক – শিক্ষিকাদের সম্যক উপলব্ধি থাকা প্রয়োজন । শুধুমাত্র প্রশিক্ষণই তাঁদের পক্ষে যথেষ্ট নয় । এই ধরনের শিশুদের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত নীতিগুলি কার্যকরী বলে মনস্তত্ত্ববিদ এবং শিক্ষাবিদগণ মনে করেন—
(1) শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে যত অধিক সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করতে হবে ।
(2) এদের জন্য বিশেষ শ্রেণিশিক্ষণের প্রয়োজন । তবে এদের সম্পূর্ণভাবে পৃথক করাটা মনস্তত্ত্বসম্মত নয় , আংশিকভাবে করতে হবে । বিদ্যালয়ের সামগ্রিক ব্যবস্থার মধ্যে এদেরকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে । সকল শিক্ষার্থীর সঙ্গে এরাও নিয়মিতভাবে প্রার্থনা সভায় উপস্থিত থাকবে এবং অংশগ্রহণ করবে । খেলাধুলা ও অন্যান্য যৌথ কর্মসূচিতেও অন্যান্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এরা অংশগ্রহণ করবে ।
(3) সমস্যাকে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে । প্রয়োজনমতো উদাহরণের সাহায্য নিতে হবে ।
(4) নতুন বিষয়কে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে ।
(5) গৃহকাজ সহজ ও সরল হবে ।
(6) শিখনীয় বস্তুটিকে বিভিন্ন রকমের প্রদীপন ও উদাহরণের সাহায্যে পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলি বারংবার তাদের সামনে উপস্থাপিত করতে হবে ।
(7) বারংবার অনুশীলনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন ।
(৪) মাঝে মাঝেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির সংক্ষিপ্তসার উল্লেখ করা প্রয়োজন ।
(9) শিক্ষোপযোগী মানসিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের শিখনের জন্য যথেষ্ট সময় বরাদ্দ করতে হবে ।
(10) এদের আগ্রহের বিষয়গুলিকে নির্দিষ্ট করতে হবে ।
(11) কোনো কাজ যদি তারা আংশিকভাবেও ঠিক করতে পারে তাহলে এই ধরনের শিক্ষার্থীদের প্রশংসা করা প্রয়োজন ।
(12) শ্রবণ এবং দর্শন সহায়ক উপকরণের ব্যবহার এদের শিখনকে ত্বরান্বিত করে ।
(13) বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ণায়ক অভীক্ষা (Diagnostic test) দ্বারা এদের দুর্বল স্থানগুলি নির্দিষ্ট করে প্রয়োজনমতো সংশোধনমূলক শিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন ।
(14) শিক্ষক উপদেষ্টার সহযোগিতায় এদের আগ্রহ , চাহিদা এবং প্রবণতাকে ভিত্তি করে পাঠক্রম ও সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি নির্বাচন করা হবে ।
(15) এইসব শিক্ষার্থীদের উপর বৃত্তিমূলক কর্মসূচির ভার চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না । কারণ এদের মধ্যে অনেকেরই বৃত্তিমূলক কর্মসূচিতে দক্ষতা অর্জন করার সামর্থ্য থাকে না ।
(16) সাধারণ শিক্ষার্থীরা যেসব আমোদ – প্রমোদমূলক ব্যবস্থা খেলাধুলা , সংগীত , শিল্প , নাটক ইত্যাদি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগ পায় এবং উপভোগ করে , তেমনই সুযোগ এইসব শিক্ষাযোগ্য মানসিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদেরও দিতে হবে ।
পরিশেষে এ কথা বলা যায় যে , শিখনে পিছিয়ে পড়া শিশুরা সর্বদাই ধীরে ধীরে শেখে । পরিবেশের সঙ্গে প্রতিক্রিয়ায় তারা নিজেদের ক্ষমতা অনুযায়ী সময় নেয় । শিখন পরিস্থিতির সঙ্গে তাদের অনুভূতিশীলতা কম থাকে । শ্রেণিকক্ষে তারা অমনোযোগী শিক্ষার্থী বলে গণ্য হয় ।
পছন্দ – অপছন্দ , শিখন পরিকল্পনা অভিযোজনের ব্যাপারে এদের শিক্ষকের সাহায্য প্রয়োজন । এরা নিজেরা এ ব্যাপারে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে যায় না । এর কারণ হল , নিজের সম্পর্কে এদের ধারণা ও আত্মবিশ্বাসের অভাব থাকে । এই সমস্ত বিষয়কে সামনে রেখেই এদেরকে উপযুক্ত শিক্ষা নির্দেশনা দিতে হবে ।
এইসব শিক্ষার্থীর অভিযোজন সম্পর্কিত সমস্যা সাধারণের থেকে অধিক । শিখনের ক্ষেত্রে এদের পশ্চাদ্বর্তিতার জন্য অন্যান্য ক্ষেত্রে যে – কোনো উপায়ে এরা উৎকর্ষতা দেখাতে আগ্রহ প্রকাশ করে । কাজটি সমাজে বাঞ্ছিত না অবাঞ্ছিত , সে বিবেচনা এরা করে না । এরা সহজেই সহপাঠীদের আজ্ঞাবহ হয়ে ওঠে । সহপাঠীদের সমর্থন পাওয়ার জন্য যে – কোনো অসামাজিক আচরণ করতেও এরা দ্বিধাবোধ করে না ।
শ্রেণিকক্ষে অনুপস্থিত থাকার জন্য সমস্ত রকমের অজুহাত এরা তৈরি করে রাখে । এই অনুপস্থিতির জন্য পারদর্শিতায় এরা পিছিয়ে থাকে এবং নিম্নমানের গ্রেড পায় । সেইজন্য বিদ্যালয়ে এদের উপস্থিতিকে নিশ্চিত করার জন্য সমস্ত রকম আনন্দমূলক অভিজ্ঞতা এবং অনুকূল পরিবেশ রচনা করতে হবে । প্রয়োজনবোধে পিতামাতাকে এদেরকে সঙ্গে করে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসা এবং নিয়ে যাওয়ার কাজও করতে হতে পারে । শিক্ষককে ব্যক্তিগতভাবে এদের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে । দলের মধ্যে রেখেও এদের জন্য পৃথক শিক্ষা কর্মসূচির ব্যবস্থা করতে শিক্ষা নির্দেশনাকে এগিয়ে আসতে হবে ।