প্রশ্ন : রাজ্যসরকারের বিভিন্ন বিভাগ- এর উল্লেখ করে বিভাগগুলির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিন ।
উত্তর: ভারতবর্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের ন্যায় রাজ্যসরকারের একাধিক বিভাগ আছে যার কার্যাবলি অনেকাংশে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুরূপ । নিম্নে ওই সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হল—
(1) রাজ্যের শাসন বিভাগ : রাজ্যপাল (Governor) এবং রাজ্যের মন্ত্রীপরিষদ (Council of Minister) নিয়ে রাজ্যের শাসন বিভাগ গঠিত । রাজ্যের ক্ষেত্রে রাজ্যপাল হলেন রাজ্যের শাসন বিভাগের নিয়মতান্ত্রিক বা আলংকারিক প্রধান । তার নামেই রাজ্যের শাসন বিষয়ক কার্যাবলি সম্পাদিত হয় । সংবিধান (155 নং ধারা) অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি রাজ্যপালকে নিয়োগ করেন ।
সাধারণভাবে রাজ্যপালের মেয়াদ 5 বছর । রাজ্যপালকে বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন হতে হয় তাঁর বেতন ও ভাতা আছে ।
রাজ্যপালের কার্যাবলি : রাজ্যপালের কার্যাবলিগুলি হল—
(ক) শাসন বিষয়ক ক্ষমতা : রাজ্যপালের নামেই শাসন বিভাগের কার্যাবলি পরিচালিত হয় । মুখ্যমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীদের নিয়োগ রাজ্যপালই করে থাকেন । তবে মুখ্যমন্ত্রী ব্যতীত অন্যান্য মন্ত্রীদের নিয়োগ মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শমতো হয়ে থাকে । মন্ত্রীদের দপ্তর বণ্টন মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শমতো রাজ্যপাল করেন । এ ব্যতীত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্যের যা ভূমিকা , গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অপসারণের ক্ষমতা , কেন্দ্রের প্রতিনিধির ভূমিকা । প্রয়োজনবোধে রাজ্যে রাষ্ট্রপতির শাসন পরিচালনা ইত্যাদিও রাজ্যপালকে করতে হয় ।
(খ) রাজ্যপালের আইন বিষয়ক ক্ষমতা : রাজ্যপাল হলেন রাজ্যের আইনসভার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ । রাজ্যপাল , বিধানসভা ও বিধান পরিষদ (যে রাজ্যে আছে) নিয়ে রাজ্য আইনসভা বা বিধানসভা গঠিত ।
রাজ্যপালের আইন বিষয়ক ক্ষমতাগুলি হল—
• রাজ্য আইনসভার উত্তরকক্ষে রাজ্যপালকে সদস্য মনোনয়নের ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছে।
রাজ্যপাল রাজ্য আইনসভার অধিবেশন আহ্বান ও তার সমাপ্তি ঘোষণা করেন ।
• রাজ্য বিধানসভার কার্যকালের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বেই বিধানসভা ভেঙে দিতে পারেন ।
• অর্থ বিষয়ক ক্ষনতা রাজ্যপালের আছে ।
• রাজ্যপাল রাজ্য আইনসভার যে-কোনো কঙ্গে বা উভয়কদের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দিতে পারেন ।
উপরোক্ত ক্ষনতাগুলি ছাড়াও বিলে সম্মতিদান , অর্ডিন্যান্স জারি , আইনসভা পরিচালনা , প্রতিবেদন পেশ , বিশেষ আর্থিক ক্ষনতা ইত্যাদি রাজ্যপালকে দেওয়া হয়েছে ।
(গ) রাজ্যপালের বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা : রাজ্যপালের বিচার বিভাগীর ক্ষমতার মধ্যে অন্য হল- জেলা জজ এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মচারী নিয়োগ , পদোন্নতি , পদচ্যুতি সম্পর্কে তিনিই সিদ্ধান্ত নেন । রাজ্যপাল দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ক্ষমা প্রদর্শন , দণ্ডাদেশ স্থগিত বা পরিমাণ হ্রাস করতে পারেন ।
রাজ্য মন্ত্রীপরিষদ : ভারতের সংবিধানে প্রতিটি রাজ্যের জন্য একটি মন্ত্রীপরিষদ গঠনের ব্যবস্থা আছে । এই মন্ত্রীপরিষদ হল রাজ্য প্রশাসন পরিচালনার প্রধান কর্তৃত্বসম্পন্ন সংস্থা ।
মন্ত্রীপরিষদ গঠন : রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনের পর রাজ্যপালের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হল মন্ত্রীপরিষদ গঠন । রাজ্যপাল প্রথমে মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়োগ এবং পরে মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী মন্ত্রীপরিষদের অন্যান্য সভ্যদের নিয়োগ করেন ।
মন্ত্রীদের স্তরবিন্যাস : মন্ত্রীদের তিনটি স্তর আছে—পূর্ণ বা ক্যাবিনেট মন্ত্রী , রাষ্ট্রমন্ত্রী এবং উপমন্ত্রী । এদের মধ্যে পূর্ণমন্ত্রীরাই হল নীতি নির্ধারক । মুখ্যমন্ত্রীই মন্ত্রীদের স্তর স্থির করেন ।
মন্ত্রীদের দপ্তর বণ্টন : মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শেই সংবিধান অনুযায়ী রাজ্যপাল মন্ত্রীদের দপ্তর বণ্টন করেন ।
মন্ত্রী পরিষদের মেয়াদ : মন্ত্রীসভার সদস্যগণ পাঁচ বছরের জন্য নিযুক্ত হন । তবে মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছেমতো পাঁচ বছরের পূর্বেই মন্ত্রীপরিষদ ভেঙে দিতে পারেন । বিশেষ পরিস্থিতিতে রাজ্যপালও মন্ত্রীপরিষদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন করার জন্য সুপারিশ করতে পারেন ।
মন্ত্রী পরিষদের কার্যাবলি : মন্ত্রীপরিষদের কার্যাবলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—
• নীতি নির্ধারণ , প্রয়োগ এবং সাধারণ প্রশাসন পরিচালনা ।
• শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করা ।
● অর্থ বিষয়ক ক্ষমতা যেমন বার্ষিক বাজেট পেশ করা এবং অর্থবিল উত্থাপন করা ।
• মন্ত্রীপরিষদ রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকার নিয়োগ করা , বিভিন্ন কমিশন গঠন করা , বিধানসভায় ইঙ্গ – ভারতীয় সদস্য মনোনয়ন এবং বিধান পরিষদের সদস্য মনোনয়নের ক্ষেত্রে রাজ্যপালকে পরামর্শ দেন ।
(2) রাজ্য আইনসভার ক্ষমতা এবং কার্যাবলি : ভারতবর্ষে যে কটি রাজ্য আছে তার প্রত্যেকটিতে আইনসভা আছে । কয়েকটি রাজ্যে যেমন বিহার , মহারাষ্ট্র , কর্ণাটক , উত্তরপ্রদেশ ইত্যাদিতে আইনসভা দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট , পশ্চিমবঙ্গসহ অনেক রাজ্যে আইনসভা এককক্ষ বিশিষ্ট ।
আইনসভার ক্ষমতা : আইনসভার ক্ষমতাগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল—
• অর্থ বিষয়ক ক্ষমতা যেমন — বিধানসভার অনুমতি ব্যতীত সরকার কোনো কর ধার্য করতে পারবে না এবং সরকারি তহবিল থেকে কোনো অর্থ ব্যয় করতে পারবে না ।
• শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ , যেমন — রাজ্যের মন্ত্রীপরিষদ গঠন সম্পূর্ণরূপে বিধানসভার উপর নির্ভরশীল । মন্ত্রীপরিষদ পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হলেও তার প্রকৃত কার্যকাল বিধানসভার সদস্যদের উপর নির্ভর করে । মন্ত্রীপরিষদ যতদিন বিধানসভার সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ততদিন পর্যন্ত তার পক্ষে ক্ষমতায় থাকা সম্ভব । উপরোক্ত কার্যাবলি ছাড়াও বিধানসভাকে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপালন করতে হয় যেমন — তথ্য ও সংবাদ পরিবেশন এবং জনসংযোগমূলক কার্যাবলি সম্পাদন ।
(3) রাজ্যের বিচারব্যবস্থা : হাইকোর্ট রাজ্যের বিচারব্যবস্থার শীর্ষে অবস্থিত , সংবিধানের 214 নং ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রতিটি রাজ্যের জন্য একটি করে হাইকোর্ট থাকবে । হাইকোর্টের গঠন , বিচারপতিদের নিয়োগ , নিয়োগে যোগ্যতাবলি , বেতন – ভাতা ইত্যাদি সবই সংবিধানে নির্দিষ্ট আছে এবং প্রয়োজনবোধে তা সংশোধন করা হয় ।
হাইকোর্টের ক্ষমতা এবং কার্যাবলি : সংবিধানে হাইকোর্টের ক্ষমতা এবং কার্যাবলি বিস্তৃতভাবে উল্লেখ করা হয়নি । সংবিধান চালু হওয়ার পূর্বে যেসব ক্ষমতা প্রয়োগ করা হত , বর্তমানেও সেইসব ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে । সংবিধান এবং আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইনের সীমার মধ্যে থেকে হাইকোর্ট তার ক্ষমতা প্রয়োগ করবে । কলকাতা , মাদ্রাজ এবং বোম্বাই এর হাইকোর্টের মূল এলাকা এবং আপিল এলাকা আছে—
(1) মূল এলাকা : রাজস্বসংক্রান্ত বিষয় হাইকোর্টের মূল এলাকার অন্তর্ভুক্ত ছিল । 1976 খ্রিস্টাব্দে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে এই ক্ষমতা ট্রাইব্যুনালের হাতে অর্পণ করা হয়েছে । এই সংশোধন অনুসারে ওই ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে কোনো আপিল করা যাবে না । 1978 খ্রিস্টাব্দের 43 তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ওই অংশ বাতিল করে পুনরায় হাইকোর্টের হাতে প্রত্যর্পণ করা হয়েছে ।
(2) আপিল এলাকা : হাইকোর্ট রাজ্যের সর্বোচ্চ আদালত । দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে হাইকোর্টে আপিল সংক্রান্ত ক্ষমতা আছে । হাইকোর্টের অন্যান্য ক্ষমতাগুলির মধ্যে আছে হাইকোর্ট অভিলেখ আদালতরূপে কার্য পরিচালনা করেন , যেমন – আদালত অবমাননার জন্য শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা , লেখ জারির ক্ষমতা , বৈধতা বিচারের ক্ষমতা ইত্যাদি ।
রাজ্যের নিম্নতর আদালতসমূহ : রাজ্যের বিচার ব্যবস্থার কাঠামোগত দিক থেকে সর্বনিম্নে অবস্থিত ন্যায় পঞ্চায়েত । 1971 খ্রিস্টাব্দের পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত আইন অনুযায়ী রাজ্যসরকারের অনুমতি নিয়ে কোনো গ্রাম পঞ্চায়েত বিচারকার্য সমাধানের জন্য ন্যায়-পঞ্চায়েত গঠন করতে পারে । নতুন পঞ্চায়েত আইন অনুযায়ী প্রত্যেক গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার পাঁচজন বিচারপতি নিয়ে ন্যায় পঞ্চায়েত গঠিত হয় । বিচারপতিগণ গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হন । বিচাকরকগণ নিজেদের মধ্য থেকে একজন প্রধান বিচারপতি নির্বাচিত করেন । তিনিই ন্যায়-পঞ্চায়েতের সভাপতিত্ব করেন । ন্যায় পঞ্চায়েতের হাতে গ্রামের ছোটোখাটো দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার বিচারের ভার ন্যস্ত করা হয়েছে ।