প্রশ্ন : স্বাধীন ভারতবর্ষের সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গির পূর্ব ও বর্তমান অবস্থা লিখুন অথবা ভারতীয় সংবিধানের বৈশিষ্ট্য গুলি লিখুন ।
উত্তর : ভারতবর্ষের সংবিধানের বয়স প্রায় 66 বছর হতে চলেছে । স্বাভাবিকভাবেই প্রথম দিকের সংবিধানের রূপ থেকে বর্তমানে বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে । এই সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি নিম্নে ব্যক্ত হল । আলোচনায় প্রথমেই জানা প্রয়োজন সংবিধানের রূপটি কী ছিল । অর্থাৎ সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি উল্লেখ করা প্রয়োজন । নিম্নে আলোচনা সংক্ষিপ্ত করার জন্য কেবলমাত্র বিশেষ
(1) বিশ্বের বৃহত্তম সংবিধান: ভারতের সংবিধান বিশ্বের সর্ববৃহৎ ও জটিল সংবিধান । বর্তমানে এই সংবিধানের 394 টি ধারা , অসংখ্য উপধারা এবং 12 টি তপশিলি বা তালিকা আছে । বিশ্বের অন্য কোনো দেশের সংবিধানে এত বেশি ধারা এবং উপধারা নেই ।
(2) সংবিধানের উপর ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব স্পষ্ট: 1909 , 1919 এবং 1935 খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন সংবিধান প্রণেতাদের প্রভাবিত করেছে । সংসদীয় বা মন্ত্রিসভাচালিত সরকার , বিচার বিভাগের কাঠামো , যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা , আমলাতান্ত্রিক কাঠামো এবং জরুরি অবস্থাজনিত বিধিব্যবস্থা হল ইংরেজশাসিত ভারতের শাসনতান্ত্রিক বিকাশেরই পরিণতি ।
(3) সংবিধান প্রস্তাবনা: ভারতের সংবিধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এর প্রস্তাবনা । সংবিধান প্রণেতাগণ ভারতবর্ষকে একটি সার্বভৌম , গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে পরিণত করার শপথ গ্রহণ করেছিলেন । সামাজিক , অর্থনৈতিক , ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা , মতপ্রকাশ , বিশ্বাস ও উপাসনার স্বাধীনতা এবং প্রতিটি ব্যক্তির সমান মর্যাদা ও সুযোগ এবং জাতীয় ঐক্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ভ্রাতৃত্ব আদর্শের রূপায়ণের ঘোষণা তারা করেছিলেন । 1976 খ্রিস্টাব্দের সংবিধানের 42 তম সংশোধন আইনের মাধ্যমে সামাজিক , ধর্মনিরপেক্ষ এবং সংহতি শব্দটি প্রস্তাবনায় যুক্ত করা হয়েছে । সুতরাং বর্তমান প্রস্তাবনা অনুযায়ী ভারত একটি সার্বভৌম , সমাজতান্ত্রিক , ধর্মনিরপেক্ষ , গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ।
(4) মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি: সংবিধানের তৃতীয় অংশে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে । এই অধিকারগুলি হল সমতার অধিকার , ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার , সম্পত্তির অধিকার , সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার । 1978 খ্রিস্টাব্দে সংবিধানের 44 তম সংশোধনের মাধ্যমে সম্পত্তির অধিকার মৌলিক অধ্যায় থেকে অপসারণ করা হয় । বর্তমানে সম্পত্তির অধিকারকে একটা আইনসিদ্ধ অধিকারে (Statutory right) পরিণত করা হয়েছে ।
(5) নির্দেশমূলক নীতি সংযোজন: ভারতের সংবিধানের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল রাষ্ট্রীয় কর্ম পরিচালনার নির্দেশমূলক নীতিসমূহ । এই নীতিগুলি হল সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের প্রতীক । নির্দেশমূলক নীতির মধ্যে জাতীয় আয় ও সম্পদের কেন্দ্রীকরণের বিরোধিতা , নারী- পুরুষের সমান মজুরি লাভের অধিকার , কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখা , পঞ্চায়েত ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা , সমাজের অনুন্নত অংশের কল্যাণসাধন , আন্তর্জাতিক শান্তি বজায় রাখা ইত্যাদি । 1973 খ্রিস্টাব্দের সংশোধনে নির্দেশমূলক নীতিগুলিকে মৌলিক ১ হয়েছে । অধিকারের উপর প্রাধান্য দেওয়া
(6) ভারতীয় সংবিধানের সুপরিবর্তনীয়তা এবং দুষ্পরিবর্তনীয়তা: ভারতীয় সংবিধানকে সুপরিবর্তনীয়তা এবং দুষ্পরিবর্তনীয়তার সমন্বয় বলা যায় । সংবিধান প্রণেতাগণ যথেষ্ট নূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে সঠিকভাবেই চিন্তা করেছিলেন যে , সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাশা ও প্রয়োজনের পরিবর্তন ঘটে । সেই পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সংবিধান সংশোধন করা প্রয়োজন । তার জন্যই সংবিধান সংশোধনের তিনটি প্রক্রিয়া নির্দিষ্ট করেছেন । প্রক্রিয়াগুলি হল
(ক) ভারতের সংবিধানের এমন অংশ আছে যাকে সংসদ সাধারণ আইন-প্রণয়নের পদ্ধতি অর্থাৎ সংসদের উভয়কক্ষের উপস্থিত এবং ভোটদানকারী অধিকাংশ সদস্যদের ভোটে সংশোধন করা যায় । সংশোধনের এই পদ্ধতি অত্যন্ত নমনীয় ।
(খ) মৌলিক অধিকার এবং নির্দেশমূলক নীতিসহ সংবিধানের বেশিরভাগ অংশ সংশোধনের জন্য সংসদের প্রতিটি কক্ষের মোট সদস্য সংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং উপস্থিত ভোটদানকারীর দুই – তৃতীয়াংশের সম্মতি প্রয়োজন ।
(গ) তৃতীয়ত সংবিধানের কোনো কোনো অংশ , যেমন—কেন্দ্র ও রাজ্যের ক্ষমতা বণ্টন , রাষ্ট্রপতি নির্বাচন , সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে সংসদের প্রতিটি কক্ষের মোট সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন প্রয়োজন । এ ছাড়া ন্যূনতম অর্ধেক রাজ্যের সমর্থন প্রয়োজন । এই দুটি ধারাই দুষ্পরিবর্তনীয়তার অন্তর্ভুক্ত ।
সংবিধানের বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে উপরোক্ত বক্তব্য ছাড়া আরও অনেক বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা যায় , যা এই আলোচনায় প্রয়োজন নেই । সবশেষে বলা যায় সংবিধান সংশোধনের ব্যবস্থা থাকার ফলে সংবিধান চালু হওয়ার পর থেকে (যা প্রায় 66 বছর অতিক্রান্ত) বর্তমান সময় পর্যন্ত সংগত কারণেই অনেক পরিবর্তন করা হয়েছে (প্রায় 78 বার) যার ফলে 1950 খ্রিস্টাব্দে সংবিধানের যে রূপটি ছিল তার পরিবর্তন হয়েছে এবং আগামী বছরগুলিতেও এর সম্ভাবনা আছে ।