প্রশ্ন : ভারতে ইংরেজরা আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলে কেন ? অথবা , ইংরেজ প্রবর্তিত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলি লিখুন । অথবা , ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলি লিখুন ।
উত্তর : উপনিবেশের অর্থনীতিকে পশ্চাৎপদ রেখে সেখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ এবং দরিদ্র উপনিবেশবাসীদের শ্রম স্বল্পমূল্যে ব্যবহার করে নিজের দেশের আর্থিক কলেবর বৃদ্ধি করাই ছিল ঔপনিবেশিক শক্তির লক্ষ্য । এর জন্য প্রয়োজন ছিল বিশেষ শাসনের একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা । শাসনের জন্য প্রয়োজন হল মানবশক্তি । বিলেত থেকে ইংরেজদের নিয়ে এসে শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করা ব্যয়সাধ্য । তাই উপনিবেশ থেকেই শাসন এবং শোষণের জন্য মানবশক্তি সংগ্রহের ব্যবস্থা দেখা দিয়েছিল । সেই কারণেই ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য ভারতবর্ষের মানবশক্তিকে যে ধরনের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন , তাকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠল ইংরেজের দেওয়া ভারতের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা ।
এই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য হল-
(ক) প্রাথমিক শিক্ষার অবহেলা ।
(খ) মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষার প্রতি অপেক্ষাকৃত অধিক গুরুত্বদান ।
(গ) মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষায় বিশেষ করে শাসকগোষ্ঠীর ভাষা অর্থাৎ ইংরেজির প্রতি দক্ষতা অর্জন ।
(ঘ) ইংরেজি সাহিত্য এবং ইংল্যান্ডের ইতিহাস ও ভূগোল বিষয়ে জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে শাসকগণের সন্তুষ্টি আনয়ন
(ঙ) এই ধরনের শিক্ষার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠবে জনজীবনের প্রতি সহানুভূতিহীন আমলা গোষ্ঠী ।
(চ) আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং কারিগরি বিদ্যাকে শিক্ষায় গুরুত্ব না দেওয়া ।
(ছ) শিক্ষার অভাবে জাতীয় চেতনার পথ রুদ্ধ করা ।
(জ) প্রয়োজনীয় শিক্ষার অভাবে জনতার উৎপাদনী শ্রমশক্তির পথ বন্ধ করা ।
(ঝ) শিক্ষার ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহর এবং ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান স্থায়ী করা ।
(ঞ) শিক্ষককে দরিদ্র রেখে তার মধ্যে হীনম্মন্যতার মানসিকতা তৈরি করা ।
(ট) শিক্ষার্থীদের আত্মসচেতনতা এবং সংঘবদ্ধতার পথ বন্ধ করা ।
(ঠ) উপনিবেশের দরিদ্র পিতা-মাতার উপার্জন থেকে শিক্ষার ব্যয় বহন করা ইত্যাদি । তবে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্য ভাগ থেকে ঔপনিবেশিক শোষণব্যবস্থার কিছু পরিবর্তন দেখা যায় । যেমন—
(ক) ভারত থেকে কৃষক এবং খনিজ কাঁচামাল ইংল্যান্ডে না পাঠিয়ে এবং ইংল্যান্ড থেকে উৎপাদিত শিল্পদ্রব্য ভারতে না নিয়ে এসে ভারতেই কাঁচামাল সস্তা শ্রমের মাধ্যমে (যাকে শোষণ বলা যায়) অতিরিক্ত মুনাফা করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় ।
(খ) কাঁচামাল নিয়ে আসা এবং উৎপাদিত শিল্পবা পৌঁছে দেবার জন্য আধুনিক রাস্তাঘাট , জলপথ এবং রেলপথ তৈরি হল ।
(গ) পাটকল এবং বস্ত্রকল অর্থাৎ ঔপনিবেশিক শোষণব্যবস্থা বজায় রাখতে ইংরেজদের এমন কতকগুলি ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হল যার ফলে তাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভারতবর্ষে বিলম্ব হলেও শিল্প উৎপাদনের প্রতি গুরুত্ব দেখা দেয় ।
(ঘ) ইংরেজদের মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত হল রেল , স্টিমার এবং কলকারখানার জন্য প্রয়োজন হল ইঞ্জিনিয়ার এবং প্রশিক্ষিত শ্রমিক । কাজেই ঔপনিবেশিক শোষণের রাস্তা বজায় রাখার জন্যই অর্থাৎ নিজেদের স্বার্থের খাতিরেই ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী ভারতবর্ষে কারিগরি ও বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থা করে । তেমনি নিজেদের শোষণের ফলে দুর্ভিক্ষের প্রতিবিধানের বিস্তারে আধুনিক কৃষি শিক্ষার ব্যবস্থা করে ।
(ঙ) তবে একই সময়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতার বীজ রোপণ করে শিক্ষা সমস্যা সৃষ্টি করে ঔপনিবেশিক শাসনকে করার চেষ্টা করে ।