শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষকের স্থান ও তার গুণাবলি লিখুন । অথবা , শিক্ষকের বৈশিষ্ট্য লিখুন ।
উত্তর :–
শিক্ষকের স্থান :
শিক্ষার বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে শিক্ষক হলেন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর স্থান হল চালকের । শিক্ষকের সামর্থ্য , আন্তরিকতা , পেশাগত দক্ষতা এবং মানসিকতার উপরই সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার সাফল্য নির্ভর করে । মুদালিয়ার কমিশনের ( 1952-53 ) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে , যে – কোনো ধরনের শিক্ষামূলক পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে শিক্ষক হলেন গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ।
HG Wells- এর মতে , “ The teacher is the real maker of history ” অর্থাৎ শিক্ষকই হলেন প্রকৃত ইতিহাস রচয়িতা । John Adams শিক্ষকগণকে “ maker of man ” বলে অভিহিত করেছেন ।
প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকের স্থান : —
প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক ছিলেন শিক্ষার কেন্দ্রে । এই সময়ে মনে করা হত জ্ঞান শিক্ষকের দিক থেকে ছাত্রাভিমুখে প্রবাহিত হয় । এখানে শিক্ষক ছিলেন সক্রিয় উপাদান , আর শিক্ষার্থী ছিল নিষ্ক্রিয় উপাদানমাত্র । শিক্ষার্থীর পছন্দ , অপছন্দ , সামর্থ্য , আগ্রহ , প্রবণতা ইত্যাদি ছিল সম্পূর্ণ অবহেলিত । নিঃসন্দেহে বলা যায় , প্রাচীনকালের সমাজব্যবস্থায় শিক্ষকের স্থান ছিল অতি উচ্চে । প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য উভয় জগতেই শিক্ষককে যথেষ্ট সম্মান দেওয়া হত ।
আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষকের স্থান : —
আধুনিক শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু হল শিশু । শিশুকে কেন্দ্র করেই সমগ্র শিক্ষা পরিকল্পনা রচিত ও পরিচালিত হয় । শিক্ষার্থী তার নিজস্ব মানসিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জ্ঞান আহরণ করবে । শিক্ষকের কাজ হবে তাঁকে সহায়তা করা এবং প্রয়োজনমতো নির্দেশনা দেওয়া । অর্থাৎ আধুনিক অর্থে শিক্ষক হবেন শিক্ষার্থীর নির্দেশক মাত্র । এইভাবে প্রাচীন ও আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকের ভূমিকা ব্যাপক পরিবর্তন হলেও শিক্ষকের পদমর্যাদায় কোনো পার্থক্য হয়নি । মুদালিয়র কমিশন , কোঠারি কমিশন , জাতীয় শিক্ষানীতি ( 1986 ) প্রতিক্ষেত্রেই শিক্ষকের মর্যাদা সকলের ঊর্ধ্বে বলে স্বীকৃত হয়েছে ।
শিক্ষকের গুণাবলি বা বৈশিষ্ট্য
শিক্ষকের বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলিকে দুই ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা হয় । যথা
( a ) ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলি
( b ) পেশাগত বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলি ব্যক্তিগত
বৈশিষ্ট্যাবলি
( 1 ) চরিত্র ঃ শিক্ষক চরিত্রবান হবেন । শিক্ষক ‘ রোল মডেলের ’ ভূমিকা পালন করেন । তাঁর বিশ্বাস , আচার – আচরণ ইত্যাদি শিক্ষার্থীদের উপর প্রভাব বিস্তার করে । শিক্ষকের চরিত্র , আচার – আচরণ যাতে অনুকরণযোগ্য হয় সে ব্যাপারে শিক্ষক লক্ষ রাখবেন । শিক্ষকের উপদেশের সঙ্গে তাঁর আচরণের যেন সংগতি থাকে । গান্ধিজি তাই বলেন , “ Woe to the teacher who teaches one thing with the lips and carries another in the heart . ” অর্থাৎ যিনি কথায় যা বলেন কাজে তা করেন না সেই শিক্ষকের প্রতি দুঃখ হয় ।
( 2 ) পেশার প্রতি ভালোবাসাঃ—
কেবলমাত্র অর্থ উপার্জনের জন্য শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ করলে এই পেশার প্রতি সঠিক দায়িত্ব পালন করা হয় না । একজন শিক্ষক প্রথমে শিক্ষক হবেন এবং শেষেও শিক্ষক থাকবেন । বস্তুত , পরিসেবামূলক কাজের প্রতি আগ্রহী একদল একনিষ্ঠ শিক্ষক ব্যতীত সমস্ত রকম সুযোগ সুবিধাযুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেন প্রাণ ছাড়া সুন্দর মৃতদেহ , আত্মা ছাড়া কঙ্কাল ।
( 3 ) নিয়মানুবর্তিতা ঃ—
একজন সু – শিক্ষক প্রতিটি কাজেই সময়ানুবর্তিতার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন । শিক্ষকের বিলম্ব উপস্থিতি শিক্ষার্থীকেও বিলম্বে আসতে প্ররোচিত করতে পারে ।
( 4 ) শিক্ষার্থীকে মর্যাদাদানঃ—
শিশুকে অবহেলা না করে তাকে একজন পৃথক সত্তা বলে মনে করতে হবে । শিশুও চিন্তা করে , অনুভব করে । তার আত্মবোধকে কখনও আঘাত করা উচিত নয় । Emerson- এর মতে , শিক্ষার নীতি হল শিক্ষার্থীদের মর্যাদা দান । শিক্ষার্থীদের কথা শুনতে হবে । তার বয়স কম বলে তার মতামত উপেক্ষা করা ঠিক নয় ।
( 5 ) ন্যায় ও নিরপেক্ষতা ঃ—
কোনো শিক্ষকের পক্ষপাতিত্বের দোষ থাকা উচিত নয় । তাঁর চোখে সবাই সমান । কোনো বিশেষ শিক্ষার্থীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব অপর শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশার কারণ হয় ।
।( 6 ) ধৈর্য :— শিক্ষককে ধৈর্য ধরে এই রকম শিক্ষার্থীদের বোঝাতে হবে ।
( 7 ) সমবেতভাবে কাজ করার ইচ্ছা ঃ— শিক্ষককে প্রধানশিক্ষক এবং তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে কাজ করার মানসিকতার অধিকারী হতে হবে ।
( 8 ) জ্ঞানার্জনের স্পৃহা ঃ—
কবিগুরু বলেছেন , একজন শিক্ষক প্রকৃত শিক্ষাদান করতে পারেন না যদি তিনি নিজে অধ্যয়ন না করেন । জ্ঞানের কোনো সীমা নেই । আরও জ্ঞানী এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে তিনি নিজের জ্ঞানকে আরও সমৃদ্ধ করবেন । জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে লজ্জা বা সংকোচের কোনো প্রশ্ন উঠবে না । Martin- এর মতে , ( একজন ভালো শিক্ষক হতে গেলে ভালো ছাত্র হতে হবে ।
( 9 ) স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা :—
শিক্ষক তাঁর নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করবেন । তিনি অন্য কারোর চিন্তাভাবনার দ্বারা প্রভাবিত হবেন না ।
( 10 ) দৈহিক স্বাস্থ্য :—
শিক্ষককে নীরোগ শরীরের অধিকারী হতে হবে । শিক্ষকের গলার স্বর ও বাচনভঙ্গি শ্রুতিমধুর হলে ভালো হয় ।
( 11 ) মানসিক স্বাস্থ্য ঃ—
দৈহিক স্বাস্থ্যের মতো শিক্ষক মানসিক সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হবেন । প্রাক্ষোভিক ভারসাম্যতা তাঁর থাকা আবশ্যক ।
(পেশাগত বৈশিষ্ট্যাবলি )
পেশাগত বৈশিষ্ট্যাবলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—
( 1 ) শিশুর প্রতি আগ্রহ :– শিশুকে বোঝাবার বিশেষ একটা ক্ষমতা শিক্ষকের থাকা প্রয়োজন । শিশুর ক্ষমতা , দুর্বলতা , সুবিধা , অসুবিধা , যে পরিবার থেকে সে এসেছে তার বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি সম্পর্কে শিক্ষকের সচেতনতা শিক্ষকের কাজকে অনেক সহজ করে এবং সঠিকতা এনে দেয় । শিক্ষককে ছাত্রদের শুভাকাঙ্ক্ষী হিসাবে পরিচিত হতে হবে ।